এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া
প্রকাশ : ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:৪৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ করতে হবে

পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ করতে হবে

খাগড়াছড়ির ধর্ষণের ঘটনা পুঁজি করে পাহাড়কে অশান্ত করার পরিকল্পনা করেছে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা—এটি দিবালোকের মতো স্পষ্ট। পাহাড় তথা পার্বত্য অঞ্চলকে অশান্ত করে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র চলছে দীর্ঘ সময় ধরেই। যে ধর্ষণের ঘটনা কেন্দ্র করে পাহাড় উত্তপ্ত করার চেষ্টা হয়েছে, তা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সিসিটিভি ফুটেজ অনুযায়ী, মামলার এজাহারে উল্লিখিত সময়ে গ্রেপ্তারকৃত শয়ন শীল খাগড়াছড়ি বাজারের বিভিন্ন দোকানে কেনাকাটা করছিলেন। এ ছাড়া এ ঘটনায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রধান চিকিৎসক ডা. জয়া চাকমা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, ‘ওই ছাত্রীর শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। এমনকি সে ধর্ষণের শিকারও হয়নি।’ প্রতিবেদনে আলামত পরীক্ষার ১০টি সূচকের সবকটিই ‘স্বাভাবিক’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

এ ঘটনা কেন্দ্র করে নিয়মতান্ত্রিক ও আইনানুগ প্রক্রিয়া না মেনে সুসংগঠিতভাবে অবরোধ, অ্যাম্বুলেন্সে হামলা, দোকান ভাঙচুর ও লুটপাট, ঘরবাড়ি পোড়ানো, পর্যটক হয়রানি এবং একে জাতিগত সংঘাতের দিকে ঠেলে দেওয়া দুঃখজনক। পরবর্তীকালে চলমান অস্থিরতা ও সংঘাতে আথুই মারমা, আথ্রাউ মারমা ও তৈইচিং মারমা নামে তিনজন নাগরিক নিহত এবং বেশ কয়েকজন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য গুরুতর আহত হন। পার্বত্য অঞ্চলে সংঘটিত হামলা, সশস্ত্র সংঘাত ও হত্যাকাণ্ডের পেছনের রহস্য উদঘাটন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, পার্বত্য চট্টগ্রামকে নিয়ে ষড়যন্ত্র চলছে দীর্ঘদিন। বিভিন্ন স্থান থেকে এ বিষয়ে সরকারকে সতর্ক করা হলেও দুঃখজনকভাবে প্রশাসন কিংবা সরকার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করেনি। আর সেই অবহেলার ফলে আজ পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূখণ্ডের প্রতি এমন উদাসীনতা কখনোই কাম্য নয়। এ ষড়যন্ত্রকে কোনোভাবেই সফল হতে দেওয়া যাবে না। সেজন্য সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। শুধু রাজনৈতিক কারণে হালকা কথাবার্তা বলে দায় এড়ানোর চেষ্টা করলে হবে না। অখণ্ড বাংলাদেশ ও সবাই বাংলাদেশি—এ পরিচয়কে ধারণ করতে হবে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে-বিপক্ষে এ বক্তব্য দিয়ে ঐক্যবদ্ধ জাতিকে বিভক্ত করা কাম্য হতে পারে না। আমরা কেউই স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর এটা কামনা করতে পারি না। বিভিন্ন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এ জাতিকে বিভক্ত করার মানসিকতা দেখেছি। এখানে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ বলে বিভক্তি সৃষ্টি করা হয়েছে স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে যে বাণিজ্য হয়েছে, রাজনীতিকরণ হয়েছে, রাজনৈতিকভাবে বাণিজ্য হয়েছে, চেতনা বিক্রি করতে করতে যে বিভক্তি সৃষ্টি করা হয়েছে, সেই জায়গা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করেছে। মুক্তিযুদ্ধে সবাই সশস্ত্র সংগ্রামে না থাকলেও মানসিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল এবং দেশের সব মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে ছিল। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে অনেক আগে থেকেই একটি আন্তর্জাতিক পরিকল্পনা চালু রয়েছে, সবাইকে এ বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। সম্প্রত কুকি-চিনের ঘটনা দেশবাসী ও নিরাপত্তা বাহিনীকেও চিন্তিত করেছে। যেটা আমরা সাদা চোখে দেখছি, সেটার পেছনেও পর্দার অন্তরালের কারণ আছে। এখানে আমাদের পার্বত্য অঞ্চল ও ভারতের একটি অঞ্চল, মিয়ানমারের একটি অঞ্চল নিয়ে আরেকটি বৈশ্বিক কোনো কোনো শক্তির পরিকল্পনা আছে। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য এ ভূখণ্ডকে হয়তোবা তারা অন্যভাবে সাজাতে চায় বলেই ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা। সেজন্য আমাদের সজাগ থাকতে হবে; যাতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যে কোনো পরিকল্পনা আমাদের ভূখণ্ডকে নিয়ে সফল হতে না পারে। সব ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী, উপজাতি ও আধা উপজাতি—সব জনসমষ্টি, সব সত্তাকে বাংলাদেশি হতে হবে একটি ঐক্যবদ্ধ নেশন (জাতি) তৈরিতে। সেই ঐক্যবদ্ধ জাতি, সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন্যই আমরা একাত্তরের পর চব্বিশে আবার রক্ত দিয়েছি।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে ‘তিন পার্বত্য জেলা নিয়ে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের প্রস্তাব’ দাবির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে বলেই বিশ্লেষকরা মনে করেন।

দীর্ঘ সময় দলেই পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোকে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করছে ষড়যন্ত্রকারী আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী। কোনো এক অজ্ঞাত কারণেই বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় সেনা চৌকিগুলো উঠিয়ে নেওয়া হয়েছিল। ফলে সহিংসতা ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মাত্রা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পায়। সবচয়ে আশঙ্কাজনক ও ভয়ংকর দুঃসংবাদ হচ্ছে, এই উগ্রবাদী পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা পাহাড়িদের সঙ্গে মিশে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার জন্য লোকালয়ে চলে যাচ্ছে। এতে করে স্থানীয় লোকজনের মধ্য ভয়-আতঙ্ক তৈরি হয়েছে এবং দেশের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ অস্তিত্ব সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে। এসব সন্ত্রাসী কার্যকলাপের কারণে পাহাড়ি কৃষকরা ঝুমচাষ, গাছ-বাগান পরিচর্যা, কৃষি খামার, মৎস্য ও গরু-মহিষের খামার এবং ফলের বাগান পরিচর্যার জন্য পাহাড়ে যেতে পারছে না। সাধারণ মানুষ আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠার মধ্যে জীবনযাপন করছে। এমতাবস্থায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবিলম্বে পাহাড়ি সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করে পাহাড়ি এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নিতে হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে বাইরে থেকে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, এটা অনেকটাই দিবালোকের মতো স্পষ্ট। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে এবং স্থানীয় অনেকেই বলেছেন, পাহাড়কে অশান্ত করতে একটি মহল ষড়যন্ত্র করছে। যার যার অবস্থান থেকে দলমত-নির্বিশেষে ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেভাবে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হচ্ছে, তাতে ষড়যন্ত্র রোধ করা কঠিন। বেশি প্রয়োজন ধৈর্য ও ঐক্যের। আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। উগ্র সন্ত্রাসীদের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে চিরতরে বিতাড়িত ও নিষিদ্ধ করতে হবে। এ অঞ্চলে দীর্ঘদিনের বৈষম্য দূর করে ন্যায় ও সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। একই সঙ্গে বাঙালি ও উপজাতি—উভয়ের জন্য শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। সবাইকে মনে রাখতে হবে, পার্বত্য চট্টগ্রাম শুধু উপজাতিদের জন্যও নয়, শুধু বাঙালিদের জন্যও নয়; এটি বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ—এটি সবার, সমগ্র জাতির সম্পদ। তাই সরকারের উচিত হবে, এ ষড়যন্ত্র রুখে দিতে হবে জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে, বৈষম্যের অবসান ঘটাতে হবে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামকে সন্ত্রাসমুক্ত করে শান্তি ও স্থিতিশীলতার পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের এ সংকট আপাতদৃষ্টিতে সশস্ত্র সংগঠনগুলোর আধিপত্যের লড়াই মনে হলেও এটি মূলত আধিপত্যবাদী শক্তির ষড়যন্ত্রের অংশ, যা এ অঞ্চলের মানুষের জনজীবনকে বিপন্ন করার পাশাপাশি অনগ্রসর এলাকার উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির স্বপ্নকেও বাধাগ্রস্ত করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিরতা তৈরি হলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রভাব পড়বে খুব সহজেই। পাহাড়ে বসবাসকারী বাঙালি ছাড়াও ১৮টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষকে আস্থায় নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে সরকারকে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কাবুলে বিস্ফোরণ, ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে যা বললেন জবিউল্লাহ মুজাহিদ

‘ওলামা-মাশায়েখদের ত্যাগ-কোরবানি স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে’

যুদ্ধবিরতিতে গাজার ঘরে ঘরে আনন্দ, রাস্তায় মিছিল

সচেতন হলে ব্রেস্ট ক্যানসার প্রতিরোধ সম্ভব : চসিক মেয়র

২০ মাসে মামলার রায়, স্ত্রী হত্যায় স্বামীর যাবজ্জীবন

ভোটের অধিকার পুনরুদ্ধারই জাতির একমাত্র লক্ষ্য : গয়েশ্বর

ঘুষি মেরে বিমানের মনিটর ভেঙে ফেললেন লন্ডন প্রবাসী

ইসরায়েলের যে কারাগারে বন্দি শহিদুল আলম

আফগানিস্তানে বিমান হামলা চালিয়েছে পাকিস্তান, টিটিপি প্রধান নিহতের গুঞ্জন

বিকট বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল কাবুল

১০

এককভাবে সরকার গঠন করবে বিএনপি : এমরান চৌধুরী

১১

‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হলে রংপুর অচল করে দিতে বাধ্য হবো’

১২

নির্বাচন নিয়ে কোনো ষড়যন্ত্র সহ্য করা হবে না : লায়ন ফারুক

১৩

ট্রেনে কাটা পড়ে যুবকের পা বিচ্ছিন্ন

১৪

বৃহত্তর মিরপুরে সম্মিলিত খতমে নবুওয়ত ওলামা সম্মেলন অনুষ্ঠিত

১৫

দেশ বাঁচাতে হলে বিএনপির বিকল্প নেই : টুকু

১৬

গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা / বস্তিবাসী ও শহীদ পরিবারের ন্যায্য দাবি মেনে নিন

১৭

মা-মেয়েকে গলা কেটে হত্যা

১৮

রাজধানীতে ১৭ ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে জাগপা ছাত্রলীগের বৈঠক

১৯

হাত-মুখ বেঁধে শিশুকে ধর্ষণ, যুবককে খুঁজছে পুলিশ

২০
X