

দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১ হাজার ১৮৬ জাল সনদধারী শিক্ষককে শনাক্ত করা হয়েছে। জাতির কারিগর হিসেবে যারা খ্যাতি ও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত, সেই শিক্ষক যদি পেশাজীবন শুরুই করেন অসদুপায় কিংবা জালিয়াতির মাধ্যমে, তা জাতি হিসেবেই আমাদের জন্য বড় লজ্জা ও হতাশার। পাশাপাশি এ ঘটনা যে নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতিপ্রবণতা ও ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতারই সাক্ষ্য বহন করে, তা নিঃসন্দেহ।
বুধবার কালবেলায় প্রকাশিত এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন অনুসারে, সম্প্রতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাল সনদধারী শিক্ষকদের বিরুদ্ধে যে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ), সেই অভিযানে এ বিরাটসংখ্যক ভুয়া সনদধারী শিক্ষককে শনাক্ত করা হয়। এর মধ্যে চার শতাধিক শিক্ষকের সনদ জাল ও ভুয়া এবং তিন শতাধিক শিক্ষকের সনদ অগ্রহণযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এসব শিক্ষকের কাছ থেকে বেতন-ভাতা হিসেবে তাদের নেওয়া ২৫৩ কোটি টাকা আদায় করতে সুপারিশও করেছে অধিদপ্তর।
এর চেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে, যেই প্রতিষ্ঠানের কাজই ছিল জাল সনদসহ বেশ কিছু নিরীক্ষামূলক কাজ, সেই প্রতিষ্ঠান বিগত দেড় দশকে এ ব্যাপারে সম্পাদন করেনি তেমন কোনো কার্যকর অভিযান। বরং করেছে উল্টোটা! অর্থাৎ, অভিযোগ উঠেছে, অনেক ক্ষেত্রে জাল সনদ ধরা হলেও ঘুষের বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়ার। শুধু তাই নয়, এর আগে খোদ পরিদর্শকদের একটি চক্রই শিক্ষকদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে ভুয়া সনদধারীদের ছাড় দিত। জাল সনদের সাড়ে ১২ হাজার আটকে থাকা ফাইল নতুন করে যাচাই করতে গিয়েই বেরিয়ে এসেছে ভয়াবহ এ চিত্র।
ডিআইএর প্রধান কাজ হচ্ছে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন দপ্তর বা সংস্থায় পরিদর্শন ও নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা। পরিদর্শন শেষে প্রতিবেদনে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ও প্রশাসনিক অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা তুলে ধরার পাশাপাশি ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা। তার ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিয়ে থাকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আবার জাল সনদ জানার পরও অবৈধ সুবিধা নিয়ে বিষয়টি চেপে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের কিছু অসাধু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। দেখা যাচ্ছে, যে বা যারা ভূত তাড়াবে, তারা নিজেরাই স্বয়ং ভূত হয়ে গেড়ে বসেছেন।
আমরা মনে করি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘিরে এ দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা যেমন ওই শিক্ষকদের নৈতিক অবক্ষয়ের দৃষ্টান্ত; একইভাবে প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা ও জবাবদিহির অভাবকেই সামনে আনে। শিক্ষার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে এমন ছেলেখেলা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, একজন শিক্ষক যদি জাল সনদে চাকরি নেন, তিনি শিক্ষার্থীদের কী শিক্ষা দিতে পারেন? একজন শিক্ষক মানে নীতিনৈতিকতা-আদর্শের প্রতীক। তার সব গুণাবলি ও জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। তিনিই যদি হন নীতিভ্রষ্ট, তা অত্যন্ত হতাশার। এটা পুরো জাতির সঙ্গেই ধোঁকাবাজি। এ ধোঁকাবাজরা শিক্ষকতা নামের এই পবিত্র পেশাকেই কলঙ্কিত করেছেন। আর এ ধোঁকাবাজির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারা করেছেন আরও বড় অন্যায়। কেননা, তাদের অসততার কারণেই নীতিহীন, মানহীন, অদক্ষদের শিক্ষাক্ষেত্রে প্রবেশ সম্ভব হয়েছে, যা সার্বিকভাবে শিক্ষার জন্য অমঙ্গলের। আমাদের প্রত্যাশা, দ্রুত তদন্তের মাধ্যমে জড়িত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। ভুয়া সনদধারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে এসব অনিয়ম-দুর্নীতি হ্রাসে নেওয়া হবে কার্যকর পদক্ষেপ।
মন্তব্য করুন