

টি-টোয়েন্টি ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের সবচেয়ে ভয়ংকর নামগুলোর একটি—যার ব্যাট নামলেই বদলে যেত ম্যাচের গতিপথ, যার বোলিংয়ে শেষ ওভারেও থাকত অজানা শঙ্কা। সেই আন্দ্রে রাসেল এবার আইপিএল ক্রিকেটার হিসেবে নিজের অধ্যায় বন্ধ করলেন। তবে নিঃশব্দে সরে যাওয়া নয়, বরং উত্তরাধিকার রেখে যাওয়ার দৃঢ় সিদ্ধান্ত থেকেই আইপিএলকে বিদায় বললেন ক্যারিবীয় অলরাউন্ডার।
কলকাতা নাইট রাইডার্স তাকে ছেড়ে দেওয়ায় যেমন চমক তৈরি হয়েছিল, তার চেয়েও বড় বিস্ময় ছিল রাসেলের অবসরের ঘোষণা এবং একই সঙ্গে কেকেআরের কোচিং স্টাফে ‘পাওয়ার কোচ’ হিসেবে যুক্ত হওয়া। নিজের কথাতেই স্পষ্ট—অন্য কোনো জার্সিতে তাকে দেখার প্রশ্নই ওঠে না।
ক্রিকবাজকে দেওয়া দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে রাসেল জানালেন কেন আইপিএল থেকে সরে দাঁড়ালেও অন্য লিগে খেলা চালিয়ে যাবেন। তার মতে, আইপিএলের শারীরিক ও মানসিক চাপ আলাদা।
‘ম্যাচের সংখ্যা, এক শহর থেকে আরেক শহরে সফর, তার সঙ্গে ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং—একজন অলরাউন্ডারের জন্য শরীরকে সতেজ রাখা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ,’ বলেন রাসেল। অনুশীলন, জিম আর ম্যাচের ভারসাম্য ঠিক রাখতে না পারলে পারফরম্যান্সে প্রভাব পড়তে বাধ্য—এমনটাই উপলব্ধি তার।
শুধু ব্যাটার হিসেবে ক্যারিয়ার টেনে নেওয়ার ভাবনাও মাথায় আসেনি কখনো। রাসেলের ব্যাখ্যা পরিষ্কার—‘আমার ব্যাটিং আর বোলিং একে অন্যের পরিপূরক। আমি অন্তত দুই ওভার বল করতে পারলে ব্যাটিংটা আপনাতেই ভালো আসে। ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হয়ে শুধু ছক্কা মারার জন্য আমি তৈরি নই।’
১২ বছরের আইপিএল যাত্রায় স্মরণের পাতা খুললে আবেগ ধরে রাখতে পারেন না রাসেল। ২০১৪ সালে কেকেআরের আইপিএল জয়ের মুহূর্ত—ড্রেসিংরুমে কাঁদতে থাকা ‘বড় বড় মানুষদের’ ছবি আজও চোখে ভাসে তার। এরপর ২০১৯ সালে চিন্নাস্বামীর সেই অবিশ্বাস্য ইনিংস, যেখানে প্রায় হেরে যাওয়া ম্যাচ একাই ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন, কিংবা ২০২১ সালে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের বিরুদ্ধে পাঁচ উইকেট—সব মিলিয়ে আইপিএল তার কাছে কেবল টুর্নামেন্ট নয়, আবেগের সমাহার।
প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা উঠলে এক মুহূর্তও না ভেবে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের কথা বলেন রাসেল। আর সবচেয়ে কঠিন বোলার? উত্তর একটাই—জাসপ্রীত বুমরাহ। ‘সে আমাকে কয়েকবার আউট করেছে, আমিও ওকে বাউন্ডারি মেরেছি। কিন্তু ওই চ্যালেঞ্জটাই আমাকে টানে,’ স্বীকারোক্তি তার।
আইপিএলে ছক্কা মারার ক্ষেত্রে সেরা বল-পিছু ছক্কার অনুপাত, ১৭৪-এর বেশি ক্যারিয়ার স্ট্রাইক রেট—সবই এসেছে নির্দিষ্ট প্রস্তুতি থেকে। রাসেল বলেন, ‘আমি ফিনিশার হিসেবে অনুশীলন করি। প্রথম বল থেকেই ছক্কা মারার মানসিকতা নিয়েই প্র্যাকটিসে নামি। ১৮ বল পেলে ছয়টা ছক্কা—এটাই আমার হিসাব।’
ডেটা আর ম্যাচ-আপেও বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। ম্যাচের আগের রাতে অন্য দলের খেলা দেখে বোলাররা চাপের মুখে কী করে—সেটা লক্ষ্য করাই ছিল তার প্রস্তুতির বড় অংশ।
তবে সবচেয়ে অবমূল্যায়িত পারফরম্যান্স কোনটা? নিজেই হেসে শোনালেন গল্প—দীর্ঘ ফ্লাইট মিস করে, জেট ল্যাগ নিয়েই নেমে তিন উইকেট আর ৬০-এর বেশি রান করা সেই ম্যাচ, যা খুব কমই আলোচিত।
অবসর নেওয়ার সিদ্ধান্তে রাসেলের দৃষ্টান্ত উসাইন বোল্ট বা এবি ডি ভিলিয়ার্স। ‘আমি চাইনি ফিকে হয়ে যেতে। মানুষ যেন প্রশ্ন তোলে—‘এখনই কেন?’ এই প্রশ্নটাই প্রমাণ করবে সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
এখন মাঠের ভেতরে নয়, মাঠের পেছনে নতুন ভূমিকা—‘পাওয়ার কোচ’। নামটা পছন্দও হয়েছে তার। ব্যাটে শক্তি, বল হাতে এনার্জি—সব মিলিয়ে নতুন এই ভূমিকা যেন আন্দ্রে রাসেলের পরিচয়েরই আরেক রূপ।
ক্রিকেটার রাসেলের অধ্যায় শেষ, কিন্তু আইপিএলে তার শক্তির ছাপ রয়ে গেল—এটাই তার রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার।
মন্তব্য করুন