

বাজারে গেলেই আজকাল মনে হয় রান্না নয়, চলছে আগুন সামলানোর মহড়া। চুলায় আগুন জ্বালানোর আগেই প্রথম ধাক্কা লাগে বাজারদরের আগুনে। পেঁয়াজের ঝাঁজ আর তেলের তেজ মিলে এমন এক অবস্থা তৈরি করেছে যে, সবজি, ডাল, মাংস তো দূরের কথা—সাধারণ রান্নাই এখন অনেকের জন্য চ্যালেঞ্জ। প্রতিদিনের বাজার যেন এক নতুন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র আর ভোক্তা সেই পরীক্ষায় অসহায়ের মতো লিখছে—‘আমি চেষ্টা করেছি, কিন্তু বাজেট আমাকে ফেল করে দিয়েছে।’ মানুষের আস্থা যেন বারবার ভেঙে পড়ছে বাজারের অস্বচ্ছতার কারণে।
পেঁয়াজের দাম বেড়েছে, এ যেন আমাদের এক চিরচেনা গল্প। কারও মনে নেই কবে পেঁয়াজের বাজার স্থির ছিল! যেন প্রতি বছরই কোনো না কোনো অজুহাতে এর দাম আকাশ ছোঁয়ার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। কখনো আমদানি মন্থর, কখনো উৎপাদন কম, কখনো বৃষ্টি বেশি, কখনো খরা। কিন্তু এসব কারণের আড়ালেও একটা অদৃশ্য শক্তি বাজারে থাকে—যাকে আমরা মমতাভরে বলি ‘সিন্ডিকেট’। এদের কাজই হলো সাধারণ মানুষের নুন-ভাতের থালায় চাপ বাড়ানো। পেঁয়াজের দাম এক লাফে ৪০ টাকা বেড়েছে। বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা কেজিতে, যা বেশ কিছুদিন ১১০-১২০ টাকা ছিল।
এদিকে ভোজ্যতেলের মূল্যবৃদ্ধি ও একই প্রেক্ষাপট পুনরাবৃত্তি করে। গেল বছরেও হঠাৎ করে তেলের দাম বেড়েছিল। কথিত আছে, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে। পরে দেখা গেল, দাম কমার পরও দেশীয় বাজারে সেই প্রভাবের দেখা নেই। এ বছর আবার সেই পুরোনো গল্প। কোনো ধরনের ঘোষণা ছাড়াই নীরবে ভোক্তা পর্যায়ে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সয়াবিন তেলের দাম। এক লাফে লিটারে বৃদ্ধি পেয়েছে ৯ টাকার মতো। নতুন করে বাজারে আসা ৫ লিটারের বোতল এখন বিক্রি হচ্ছে ৯৬৫ টাকায়। বোতলজাত প্রতি লিটারের দাম ১৯৮, যা এতদিন ছিল ১৮৯ টাকা। এ ছাড়া ভরা মৌসুমেও ঊর্ধ্বমুখী সবজির বাজারে স্বস্তি ফেরেনি। বেশিরভাগ সবজির দামই শীত মৌসুমের বাজারের সঙ্গে মানানসই নয়।
সামনেই রমজান মাস। প্রতি বছর এ মাসেই বাজারে অস্থিরতার এক নিঃশব্দ উৎসব ও বছরের পর বছর একই দৃশ্য আমরা দেখছি। রমজান এলেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে, যেন মাসটি আসার আগমনী বার্তা শোনামাত্র কিছু শক্তিশালী মহল দাম বাড়ানোর বোতাম টিপে দেয়। এ বছরও এর ব্যতিক্রম হয়নি। বাজার আবারও স্বল্পআয়ের মানুষের দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠছে।
দাম বাড়ার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। তবে কোনোটাই এমন নয়, যা অভাবনীয়। পেঁয়াজের ক্ষেত্রে নতুন মৌসুমি উৎপাদন বাজারে আসতে বিলম্ব হয়েছে। পুরোনো মজুত কমে এসেছে। কিন্তু এ ঘাটতি কখনোই এত বিশাল নয় যে, দাম হঠাৎ দ্বিগুণ হয়ে যাবে। বরং বাজারে সেই ঘাটতিকে বাড়িয়ে তুলে একটি কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়। উৎপাদক ও পাইকারি পর্যায়ে মজুতদাররা অপেক্ষা করে থাকে দাম বাড়ার জন্য। তারপর বাজারে পণ্য নিয়ন্ত্রণ করে। বিশ্ববাজারে সামান্য ওঠানামাকে অজুহাত করে দাম বাড়ানো হয় অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও তার প্রতিফলন দেশে তেমন দেখা যায় না। তার ওপর আমদানির প্রক্রিয়ায় বিলম্ব, কাস্টমস জটিলতা, ডলার-বাজারের চাপ—এসবও ব্যবসায়ীদের হাতে দাম বাড়ানোর সুযোগ তৈরি করে দেয়। সব মিলিয়ে সরবরাহ ব্যবস্থার অস্বচ্ছতা এবং সিন্ডিকেটের শক্তি দামের ওঠানামা প্রায় সম্পূর্ণ নির্ধারণ করে ফেলে।
এ অবস্থায় সরকারের ভূমিকা সবসময় প্রশ্নের মুখে পড়ে। বাজার মনিটরিং নামেই হয়, কিন্তু বাস্তবে প্রভাব দেখা যায় না। মোবাইল কোর্ট, অভিযান, জরিমানা—এসব সাময়িক। অভিযান শেষ হলেই দাম আবার আগের জায়গায় ফিরে যায়। সরকারের সবচেয়ে জরুরি করণীয় হলো, নিয়মিত ও কঠোর তদারকি নিশ্চিত করা, আমদানি অনুমোদন সময়মতো দেওয়া, শুল্ক ও কাস্টমস প্রক্রিয়া দ্রুত করা, বাজারে মজুতদারির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া এবং প্রয়োজনের সরকারি পর্যায়ে ন্যায্যমূল্যের বিক্রয় কার্যক্রম চালু রাখা। এসব ব্যবস্থা বাস্তব নিয়ন্ত্রণ আনতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, ভোক্তারা যেন কেন দামে পরিবর্তন আসছে তার স্বচ্ছ ব্যাখ্যা পান, সেই তথ্য প্রবাহকে নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব।
তাহলে কি এ মূল্যবৃদ্ধির অশুভ চক্র থামানো সম্ভব? অবশ্যই সম্ভব। যদি সরকার, ব্যবসায়ী ও ভোক্তা—তিন পক্ষই স্বচ্ছ বাজার ব্যবস্থায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়, সিন্ডিকেট ভাঙা, রিয়েল টাইম বাজার পর্যবেক্ষণ, ডিজিটাল মনিটরিং, বাজারের সব স্তরে মূল্যতালিকার বাধ্যতামূলক প্রদর্শন, মজুতদারির অপরাধে কঠোর শাস্তি—এসব পদক্ষেপ কার্যকর হলে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা কঠিন হয়ে পড়বে। পাশাপাশি স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধি ও কৃষকদের উৎসাহ দেওয়া দীর্ঘমেয়াদে পণ্য নির্ভরতা কমাবে এবং সরবরাহ স্থিতিশীল রাখবে।
কারণ স্পষ্ট না থাকলেও যখন নিত্যপণ্যের দাম হঠাৎ বেড়ে যায়, তখন ক্রেতাদের মনে অস্থিরতার এক ধোঁয়াশা তৈরি হয়। বিশেষ করে যারা দৈনিক আয়ের ওপর নির্ভর করে জীবন চালায়, অর্থাৎ, দিন আনে দিন খায়—তাদের জন্য দামবৃদ্ধি যেন নতুন এক আতঙ্ক। হিসাব মেলাতে না পেরে তারা থমকে দাঁড়ায়—কোথায় কমাবে, কীভাবে চলবে? মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের অবস্থাও আলাদা নয়; বাড়তি ব্যয়ের চাপে তাদের সংসারের ভারসাম্য প্রতিদিনই টলে যায়। তবু আশাই ভরসা যে, একদিন সাধারণ মানুষ আবারও নিশ্চিন্ত হয়ে বাজারে যাবে আর ন্যায্য দামে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনে ফিরতে পারবে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে। এটাই আমাদের প্রত্যাশা; এটাই সময়ের দাবি।
সুমাইয়া সিরাজ সিমি, শিক্ষার্থী
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন