সামনের নির্বাচনে পর্যবেক্ষক না পাঠানোর বার্তা দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন-ইইউ। তবে অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনকে উৎসাহিত করবে। এ মর্মে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে তাদের প্রতিনিধিদলের প্রধান বুধবার চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে বলা হয়েছে, গত জুলাইয়ে ঢাকা সফর করে যাওয়া ইইউর প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলের সুপারিশের ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কারণ বা অজুহাতে বলা হয়েছে, ২০২৩-২৪ সালের জন্য ইইউর বাজেট স্বল্পতার কথা। এও বলা হয়েছে, নির্বাচনের সময় প্রয়োজনীয় শর্তগুলো পূরণ করা হবে কি না, তা এ মুহূর্তে যথেষ্ট স্পষ্ট নয়। আবার এমন সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও ইইউ এ নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সঙ্গে থাকার ব্যাপারে অন্যান্য বিকল্প খতিয়ে দেখছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের সম্ভাব্যতাও বিবেচনায় রাখছে ইইউ সদস্য দেশগুলো। কী দাঁড়াল অর্থটা?
শুধু দেশি নয়, বিদেশিরাও যে যা পারছেন করছেন, বলছেন। যুক্তরাষ্ট্র হাল ছাড়ছে না একটুও। তাদের প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল ঢাকা আসবে ৮ অক্টোবর। দলটিতে থাকবেন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট-এনডিআইয়ের তিনজন ও ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট-আইআরআইর দুই-তিনজন নির্বাচন বিশেষজ্ঞ। ১২ অক্টোবর পর্যন্ত তারা বাংলাদেশে অবস্থান করবেন। ওই সময়ে নির্বাচন কমিশনসহ বিভিন্ন মহলের সঙ্গে তাদের বৈঠক করার কথা রয়েছে। এ প্রতিনিধিদলের প্রতিবেদনের ওপর আগামী নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্র পর্যবেক্ষক পাঠাবে কি না, তা অনেকটাই নির্ভর করছে। গত নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্র চাইলেও সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন জটিলতায় তারা পর্যবেক্ষক পাঠাতে পারেনি। এবার তারা লেগেছে কাঁঠালের আঠার মতো। মাঝেমধ্যেই মার্কিন হেভিওয়েটরা ছুটে আসছেন। তাদের স্টেট ডিপার্টমেন্টের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ থাকছেই। দেশটির ঢাকার রাষ্ট্রদূত পিটার হাস পরিশ্রান্ত বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে। বাংলাদেশের পজিশন-অপজিশনও ছুটছে মার্কিনিদের নেক-নজরের মোহে। পিটার হাস জানান, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন চায়, হস্তক্ষেপ নয়। সেইসঙ্গে যোগ করেন, নির্বাচন যেন অবাধ ও সুষ্ঠু হয় সে বিষয়ে গুরুত্ব দেবে যুক্তরাষ্ট্র। তার কথাও পরিষ্কার। সুষ্ঠু নির্বাচনের ‘আকাঙ্ক্ষা, হস্তক্ষেপ আর গুরুত্ব দেওয়া’—এগুলোর অর্থ প্রায় অভিন্ন বা কাছাকাছি। বায়ান্ন-তেপ্পান্ন বা লাউ-কদু তফাতের মতো।
এ তফাত যেন কেউ করতে পারেন, তাই যুক্তরাষ্ট্রের পদস্থরা ইদানীং বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের পর সঙ্গে সঙ্গে টুইট করেন, নইলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেন। দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের আন্ডার সেক্রেটারি আজরা জেয়া (যিনি কিছুদিন আগে ঢাকা সফর করে গেছেন) বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে কথা বলার পর পরই টুইট করেন। এতে বলা হয়, ‘সাইড লাইনে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে কথোপকথন হয়েছে।’ এসবের অর্থ পরিষ্কার। বাংলাদেশ ও বাংলাদেশিদের তারা ভালোমতো চিনেছেন। পেয়েও বসেছেন। এর জবাবে, ‘আমাদের নির্বাচন আমরা যেমন ইচ্ছে করব। বিদেশিদের কথাই খাই না পরি’—এমন একটা ভাব আছে। এমন ভাবের সঙ্গে ভঙ্গি করতে গিয়ে বাধছে গোলমালটা। তাদের কাছে গিয়েই আবার ধরনা দেওয়া, নিরপেক্ষ-সুষ্ঠু নির্বাচনের ওয়াদার ভঙ্গি করা। দেশে দেশে হালে কমবেশি এ কাণ্ডই চলছে। সফর, দাওয়াত, চুক্তি, সমঝোতা, স্মারক, পাশে থাকার আশ্বাস, ফটোসেশন, কোলাকুলি-গলাগলির এক জেয়াফত-মেজবানি। রুদ্ধদ্বার বৈঠক, খোলামেলা আলাপ ধরনের কূটনৈতিক শব্দের ব্যাপক ব্যবহার। আর ফাঁকতালে যে যাকে পারছে শিকার করছে, আদায় করছে, নিজ দেশের কমদামি মালামাল কেনাচ্ছে বেশি দামে। আবার বিগড়েও যাচ্ছে। উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের রাশিয়া সফরের পরপরই মস্কো সফরে গেলেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। চীন যুক্তরাষ্ট্রকে জাতীয় নিরাপত্তার নামে তাইওয়ানকে প্রযুক্তি এবং বাণিজ্যের কথা বলে অস্ত্র দেওয়ার অভিযোগ করছে; অন্যদিকে ওয়াশিংটন তাইওয়ান এবং প্রশান্ত মহাসাগরে চীনের সামরিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে বেইজিংকে সতর্ক করেছে। এতদসত্ত্বেও মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান এ সপ্তাহান্তে মাল্টায় চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইয়ের সঙ্গে ‘খোলামেলা’ আলোচনা করেছেন। কারণ বিশ্বের দুটি বৃহত্তম অর্থনীতি প্রশান্ত মহাসাগরের বাণিজ্য ও সামরিকীকরণ নিয়ে সমস্যাযুক্ত সম্পর্ককে শান্তিপূর্ণ করতে চায়। গোলমাল ভরা এ বিশ্বরাজনীতি-কূটনীতির বাঁকে যোগ হয়েছে কানাডার নাগরিকদের জন্য ভারতের ভিসা স্থগিত করার ঘোষণা। ভারত সরকারের গুপ্তচররা এক কানাডীয় নাগরিককে হত্যার ঘটনায় জড়িত অভিযোগ নিয়ে উসকে ওঠে ঘটনা। নিহত ওই শিখ ব্যক্তি ঘোষিত সন্ত্রাসী ছিলেন বলে ভারত জানিয়েছে। এ গুরুতর অভিযোগ উত্থাপনের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাজ্য আর অস্ট্রেলিয়া জানিয়েছে, তারা কানাডার নাগরিকের হত্যা তদন্তের দিকে নজর রাখছে। বিশ্ব কূটনীতির ফাঁকের এ বাঁকেই উতরে গেছে শ্রীলঙ্কা। মাত্র কদিন আগে ধসে পড়া শ্রীলঙ্কা তো ম্যাজিকে বদলে গেছেই। বাংলাদেশের ২০০ মিলিয়ন থেকে ৫০ মিলিয়ন ডলার দেনা শোধ করে দিয়েছে। বাদবাকিটা আস্তে আস্তে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা জানিয়েছে। আমাদের টাকাটা বোধহয় জলেই গেল ভাবার কোনো বাস্তবতা নেই। কোনো ঝাড়ফুঁক বা ওলি-আউলিয়ার দোয়া বা আলাদিনের চেরাগের ছোঁয়া নয়, খাদের কিনার থেকে যথাসময়ের যথাকাজ তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর পথ দেখিয়েছে। অন্ধকার আফ্রিকা বদলাচ্ছে প্রতিনিয়ত। অথচ ওখানে এখনো খাদক-মাদক-সিন্ডিকেট কম নয়। পাশ্চাত্য নতজানুসমৃদ্ধ আফ্রিকাকে দরিদ্র করেছে তা দেশগুলোর নাগরিকদের বোধোদয়ে আসা হঠাৎ শুরু হয়নি। সময় লেগেছে। বাংলাদেশ ঋণী হয়েছে বরাবরই। কিন্তু কখনো খেলাপি হয়নি। এটি সক্ষমতার ব্যাপার। পরিশোধের সক্ষমতা থাকাতেই বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা ঋণ দিচ্ছে। দাতা সংস্থাগুলোর শক্ত মনিটর থাকলে দুর্নীতির লাগামে টান পড়তে বাধ্য, তা উপলব্ধির সুফল পাচ্ছে উগান্ডা-রুয়ান্ডা-ইথিওপিয়ার মতো নিন্দার তালিকাভুক্ত দেশগুলো। পরিবারতন্ত্র, দলকানা রাজনীতি, রাজনৈতিক ডামাডোল-অস্থিরতা ওইসব দেশেও ছিল, আছে। লুট-চুরির অর্থ বিদেশে পাচারের কায়কারবারও আছে। তাহলে আমরা পারব না কেন? সবার কথা না টেনে অন্তত শ্রীলঙ্কার কথা বিবেচনায় নিলে কিছু বার্তা বা মন্ত্র এমনি এমনিই রপ্ত হয়ে যায়। প্রায় দেউলিয়া হওয়ার জেরে দেশটিতে ব্যাপক ও কদাকার রাজনৈতিক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। যার অনিবার্য পরিণতিতে শ্রীলঙ্কার সরকারকে পদত্যাগ করতে হয়, দেশ ছাড়তে হয় দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসেকে। তেমন কিছুর আশা বা দুরাশা দেখার অপেক্ষমাণ লোক বাংলাদেশেও ছিলেন। বাংলাদেশে সেরকম কিছু হয়নি। আবার শ্রীলঙ্কাও নেতিয়ে পড়া থেকে উতরে ওঠে কম সময়ের মধ্যে। কী ছিল ম্যাজিকটা? যার মধ্যে ভাবনা বা বিশ্লেষণের বিষয় আছে বাংলাদেশসহ আরও অনেকের জন্যই। বিশ্বরাজনীতির বর্তমান সন্ধিক্ষণে নিরপেক্ষ থাকার দিন শেষ। বাকিটা ভবিষ্যৎ বা পরবর্তী পরিস্থিতির অপেক্ষা। সেখানে বাংলাদেশ এখনো নো রিস্ক জোনে। বিশ্ববাস্তবতায় দুই নৌকায় পা রাখার কঠিন ঝুঁকির বিপরীতে বাংলাদেশ পা রাখছে প্রায় সব নৌকাতেই। মাঝেমধ্যে গোলমাল বাধলেও, টেনে আনতে ছিঁড়ে যাওয়ার অবস্থা হলেও ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্রকে আয়ত্তে রাখার চেষ্টায় এখন পর্যন্ত সফল বাংলাদেশ। ‘কারো সাথে শত্রুতা নয়, সবার সাথে বন্ধুত্ব’—পররাষ্ট্রনীতির এ সূত্রে বাংলাদেশ সবদিকেই থাকার চেষ্টা করছে। টানটান উত্তেজনা ও বিরোধের মধ্যেও দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের কাছে নিজ দেশের ভৌগোলিক গুরুত্ব পুঁজি করে এগোচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই দিনে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এবং যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিশেল জে সিসনের ঢাকা সফর কূটনীতিপাড়ায় চাঞ্চল্যকর ঘটনা। ভারতের সঙ্গে মিতালি তথা ঐতিহাসিক সম্পর্কের কথা সরকারের বলতে হয় না। তা মানুষের মুখে-মুখে। চলমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে তা নতুন করে আলোচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে উপনিবেশগুলো ভেঙে বেশ কটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। বিগত স্নায়ুযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পাকিস্তানসহ বহু দেশ ভেঙে নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এবারের স্নায়ুযুদ্ধের সময় দেশ ভাঙা-গড়ার খেলা শুরু হয়েছে ইউক্রেন দিয়ে আফ্রিকার কয়েকটি দেশে, মিয়ানমার এবং ভারতের উত্তর পূর্ব রাজ্যগুলোতে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন প্রকট হয়ে উঠছে। খালিস্তান আন্দোলনটি নতুন করে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। কানাডায় খালিস্তানি নেতা হরদীপ সিং নিজ্জার হত্যায় তা নতুন রূপ নিয়েছে। এসব ঘটনার মধ্যে বাংলাদেশ এখনো তুলনামূলক ভালো অবস্থানে রয়েছে। কিন্তু নির্বাচন সামনে রেখে বড় দুই দলের জনগণের বদলে অতিমাত্রায় বিদেশনির্ভরতা বাংলাদেশকে খাদে ফেলার শঙ্কা জাগাচ্ছে। এরই মধ্যে সেই খাদের কিনারে মহলবিশেষের মাথা ঢুকেও গেছে। নিজের মাথা দিতে গিয়ে তারা দেশকেও নিয়ে যাচ্ছেন বিশ্ব চাপের বাঁকে। ওই চাপের তাপ পড়ছে দেশের রাজনীতির শিরা-উপশিরায়। হাতে ধরে শিং মাছ ঘরে ঢোকানোর স্মার্ট(!) প্রতিযোগিতা দুদিকেই। বিএনপির ক্ষোভ-বিক্ষোভ সামনের দিনগুলোতেও শান্তিপূর্ণ থাকার নিশ্চয়তা নেই। সরকারের রাজনৈতিক দুর্গের অসহিষ্ণুতাও বাড়বাড়ন্ত। দেশকে আরেকটি বিতর্কিত নির্বাচনের দিকে নিয়ে যেতে সরকারের সামনে আইনি বা সাংবিধানিক কোনো বাধা নেই, যা নতুন এক রেইনবোতে আওয়ামী লীগ বিরোধীদের সহিংস করে তোলার শঙ্কা আছে। প্রথম স্নায়ুযুদ্ধের সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান এবং পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ১৯৬৯, ’৭১ ও ’৭৫ দেখেছিল। এবারের স্নায়ুযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে কী ঘটতে যাচ্ছে, তা উদ্বেগের সঙ্গে দেখার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
লেখক : ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
মন্তব্য করুন