বিদ্যমান সংবিধানে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণার পাশাপাশি এ নির্বাচন হতেও না দেওয়ার হুঙ্কার দিচ্ছে বিএনপি। একে ‘নির্বাচনে বাধাদান’ হিসেবে মূল্যায়ন করতে চান অনেকে। এর বিপরীতে পুনর্গঠিত ও আলোচিত তৃণমূল বিএনপি নিচ্ছে নির্বাচনের প্রস্তুতি। সাবেক বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার গঠিত সাবেক আরও দুই বিএনপি নেতা শমসের মবিন চৌধুরী ও অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারের নেতৃত্বাধীন দলটি মাঠ গোছাচ্ছে। মূল বিএনপির মাঠপর্যায়ের অনেকে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন বলে দাবি তৃণমূল বিএনপির। তাদের হিসাব পরিষ্কার। এখন সংবিধান পরিবর্তনের সময় নেই, সুযোগও নেই। তবে জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরপেক্ষভাবে কাজ করবে, নির্বাচন কমিশনও সাহসী ভূমিকা রাখবে। নির্বাচনও সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক হবে। জনগণ একটি নতুনত্ব দেখতে চায় বলেও ধারণা তাদের। কাঙ্ক্ষিত সেই নতুনত্বের ফ্রন্ট লাইনে থাকার আয়োজন চলছে তৃণমূল বিএনপিতে। বাকিটা ভবিষ্যৎ।
শমসের মবিন চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেছেন, তৃণমূল বিএনপি ওয়ান ইলেভেন জমানায় পয়দা হওয়া ‘কিংস পার্টি’ নয়, জনগণের পার্টি। তিনি বিএনপির সহসভাপতি ছিলেন। ২০১৫ সালের ২৮ অক্টোবর বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেন। আর তৈমূর আলম খন্দকার ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা। ২০২২ সালের জানুয়ারি তাকে বহিষ্কার করে বিএনপি। কাঠখোট্টা বা সাফ কথায় অভ্যস্ত তৈমূর তৃণমূল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, নাজমুল হুদাই নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফর্মুলা দিয়েছিলেন। সেই অপরাধে বিএনপি তাকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিয়েছিল।
তৃণমূল বিএনপি নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন পায় গত ১৬ ফেব্রুয়ারি। এর তিন দিন পর ১৯ ফেব্রুয়ারি তার মৃত্যু হয়। আর শমসের মবিনের বিএনপিতে যাত্রা শুরু ২০০৮ সালে। পদত্যাগের পর তিনি যান সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্পধারায়। একপর্যায়ে সেখান থেকেও বেরিয়ে আসেন। বিকল্পধারা থেকে বেরিয়ে দীর্ঘদিন রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় থাকার পর এখন তৃণমূল বিএনপির প্রধান। মবিন-তৈমূরের তৃণমূলের সাফল্য পুরোটাই এখনো ভবিতব্য হলেও, মূল বিএনপির এখন এক চরম সন্ধিক্ষণ। মূলের অবস্থা নড়বড়ে। দলের এক নম্বরজন খালেদা জিয়া কারাভোগী। তার ওপর রোগে-শোকে পর্যুদস্ত। দ্বিতীয়জন দণ্ডিত এবং আইনের চোখে ফেরারি। গুলশান-লন্ডনে মূল রেখে পল্টনে তৃণদের দপ্তর চলে। তাদের প্রধান ব্যক্তি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত কিছুদিন ধরে ‘সরকারের পতন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র’ বলে ভরসা জোগান মাঠের নেতাকর্মীদের। কিন্তু কোন ভরসা বা সিগন্যালে এমন আশাজাগানিয়া বার্তা—তা কর্মীদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। দৃশ্যত এখন পর্যন্ত সরকারকে নাস্তানাবুদ করে ক্ষমতাচ্যুত করার মতো রাজপথের আন্দোলন বিএনপি জমাতে পারেনি। পেরেছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা কিছু দেশের নেকনজরে কামিয়াবি হতে। তা দিয়েই আওয়ামী লীগের মতো পোড় খাওয়া রাজনৈতিক দল তথা সরকারকে হটিয়ে দেওয়া সম্ভব? অন্ধকারের চোরাগলির কথা আলাদা। প্রকাশ্য রাজনীতির তাওয়া তাতানোর মতো শক্তি নেই বিএনপির। তারপরও অক্টোবরের একটা আওয়াজ আছে। মাসটিতে ঢাকায় থাকবে একটি হাই-প্রোফাইলের মার্কিন প্রতিনিধিদল। এ সময় বিএনপির আন্দোলনটি হবে ঢাকাকেন্দ্রিক। ঢাকা ঘিরে বিএনপির আন্দোলনের কিছু কৌশলের কথা বেশ চাউর হয়েছে। মার্কিন ভিসা নীতি তাদের পুলকে কিছুটা ঘি ঢেলেছে। আন্দোলনের এমন বাদল দিনে ওই ঘি বিএনপিকে কতটা তাতাবে, সামনের কয়েক দিনেই পরিষ্কার হবে।
আন্দোলন এবং নির্বাচন প্রশ্নে সময়ের চূড়ান্তে এসে বিএনপির ভেতরের আরও কিছু ঘটনা তাদের মিত্রদের কাছেও সমালোচিত। তার ওপর এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। বৈশ্বিক ও ভূরাজনীতিসহ নানা কারণে যুক্তরাষ্ট্র এবার বাংলাদেশ প্রশ্নে যে পর্যায়ে চলে এসেছে, সেখান থেকে তাদের ব্যাক করার অবস্থা নেই। মাঠের আন্দোলনে তালহারা বিএনপির জন্য এটাই মোটা দাগের আশা-ভরসা। সেই ভরসায় তারা ‘শিগগির’ সরকার পতনের আশা দেখে। ‘তাল’-এর মাঝে ‘লয়’ও খোঁজে। মূলে গলদের মাঝে তৃণেও হাত দেয়। ক্ষমতাসীনরা বিএনপির এ দশা টের পেয়ে নিয়মিত প্রশ্ন ছোড়ে, দলটির নেতা কে? নির্বাচনে জিতলে বিএনপি প্রধানমন্ত্রী বানাবে কাকে? বিএনপি এ প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে সাইড লাইনে অন্য কথায় চলে যায়। এ অবস্থার মধ্যে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আবারও অসুস্থ। কেবিন-সিসিইউ টানাটানি। বিএনপির প্রতি সরকারের বার্তাও বেশ কঠিন। বিএনপিকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, বেশি বাড়াবাড়ি করলে সরকারও কঠোর অবস্থানে যাবে। জামিন বাতিল করে খালেদা জিয়াকে আবার কারান্তরীণ করা হবে। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে খালেদা জিয়া একটি দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হয়ে কারান্তরীণ হন। এরপর বিএনপির পক্ষ থেকে তার মুক্তির জন্য আন্দোলনের চেষ্টা করা হলেও তা জমানো যায়নি। আইনগত প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়াকে মুক্তির চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। এরপর দীর্ঘ দুই বছরের বেশি সময় খালেদা জিয়া কখনো সাবেক কেন্দ্রীয় কারাগারে, কখনো বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ছিলেন। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা-বোন শেখ রেহানার সঙ্গে খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দার এবং বোন সেলিমার মধ্যস্থতায় খালেদা জিয়াকে অন্তত কারাগার থেকে ফিরোজায় রাখার ব্যবস্থা করা হয়। এর পুরোটাই হয়েছে সরকারের নির্বাহী ক্ষমতায় বা প্রধানমন্ত্রীর অনুকম্পায়।
বিএনপি মহাসচিব তার সাম্প্রতিক এক বক্তব্যে বলেই ফেলেছেন, এমন কঠিন সময় বিএনপি আর কখনো পার করেনি। আবার পরক্ষণেই বলেছেন, কষ্টের দিন শিগগিরই শেষ হবে নিশ্চিত তিনি। প্রশ্নটা সেখানেই। মূল আর তৃণের এ বেহাল দশার মধ্যে কোথা থেকে, কীভাবে এ নিশ্চয়তা পেলেন তিনি? সাদা চোখে কিছু দেখা যাচ্ছে না। কর্মীদের কাছে তার এ শুভবার্তা একটি ঘোরের মতো। তার ওপর দলের আংশিক নামে মাঠে নেমেছে সৎভাইয়ের মতো তৃণমূল বিএনপি। যার চারদিকে ঘুরঘুর করছেন বিএনপির কিছু নেতা। যারা গত ১৭ বছরে ক্ষমতাহীনতায় কাহিল। ১৭ বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতাহীন দলটির কোনো না কোনো পরিকল্পনা বা কৌশল অবশ্যই আছে। তাদের প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের পাল্টা কৌশল ও পরিকল্পনা স্পষ্ট-তেজি। ক্ষমতা ছাড়াও আওয়ামী লীগের অনেক সুবিধা আছে। তাদের নেতাকর্মী-সমর্থকদের বিশ্বাস, বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনা যে কোনো পরিস্থিতি উতরানোর ম্যাজিশিয়ান। বিএনপির ভেতরের সেই জায়গাটা অনেকাংশে ফাঁকা। নেতৃত্ব নিয়ে অনিশ্চয়তা ও সমন্বয়ের অভাব তো রয়েছেই। বিএনপির ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা শুরু হয় গত বছর অক্টোবর মাসে। বিভাগীয় শহরগুলোতে তারা ধারাবাহিকভাবে জনসভার আয়োজন করতে শুরু করে। ডিসেম্বরে ঢাকায় মহাসমাবেশের মধ্য দিয়ে তা একটি পরিণতি পাবে, তেমন আশা বিএনপির অনেক নেতাকর্মী ও সমর্থকের মধ্যে তৈরি হয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে দলটি তার শক্তি-সামর্থ্য ও জনসমর্থনের বিষয়টি প্রমাণ করেছিল ঠিকই, কিন্তু দৃশ্যমান কোনো ফল তারা পায়নি। বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে আশাবাদ ধরে রাখা কঠিনের চেয়েও কঠিন।
আজকের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে ছিল টানা ২১ বছর। সংখ্যা হিসাবে বিএনপির সেখানে যেতে বা ২১ বছর হতে আরও ৪ বছর বাকি। গত ১৭ বছর ধরে ক্ষমতাহীন দলটি পোহাচ্ছে নানা ঝক্কিঝামেলাও। এ কঠিনকে জয় করতে দলটির নজর বেশি বিদেশি কূটনীতিকদের দিকে। সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিতে ‘বিদেশি চাপকেই’ এই মুহূর্তে অধিকতর ভরসা মনে করছে বিএনপি। তবে প্রকাশ্যে বলতে হচ্ছে রাজপথের আন্দোলনের কথা। কিন্তু বারবার ঘোষণা দিয়ে সরকার হটানোর ‘চূড়ান্ত’ আন্দোলন নিয়ে এখনো কোনো স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। এ নিয়ে তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে ধোঁয়াশা-জিজ্ঞাসা দুটোই জোরদার। এর মধ্যেই কোনো না কোনো দেশের কূটনীতিকের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক-যত্নআত্তি করতে হয় বিএনপিকে। সেইসঙ্গে চিঠিপত্র চালাচালি। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক এখন বিএনপির রুটিন ওয়ার্কের মতো। এভাবে আর কত? পদযাত্রা, রোডমার্চ, মহাসমাবেশ, রাজধানীর প্রবেশমুখে অবস্থান ধরনের কর্মসূচিতে কাহিল কেন্দ্র এবং মফস্বল দুই পর্যায়ই।
এসব কর্মসূচি নিয়েও চলছে নানা নাটকীয়তা। কখনো কখনো মহাসচিবও জানেন না, কী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। বিশেষ নির্দেশনায় যে কোনো সময় কর্মসূচির ধরন, স্থান ও সময় পাল্টে যায়। কর্মসূচির এক ঘণ্টা আগেও খোদ বিএনপির নেতারাই অন্ধকারে থাকেন। এমনকি একটি কর্মসূচি চলাকালেও পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে কি না, কোথায় কবে হবে পরবর্তী কর্মসূচি—তাও অজানা থেকে যায়। যা দলে সন্দেহ বাড়িয়ে তুলছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে একটি মহল মূল্যায়ন রিপোর্টের নামে ত্যাগী নেতাকর্মীদের কোণঠাসা করার একটি অপচেষ্টার অভিযোগ আছে। একটি চক্র তাদের বলয়ের নেতাদের দলের বিভিন্ন পদে বসাতে এমনটি করছেন বলে কথা চালাচালি রয়েছে। বাইরে পুলিশের ধাওয়া আর দলে শাস্তির তাওয়া মিলিয়ে নতুন একটি আবহ চলছে বিএনপি, বিশেষ করে অঙ্গ-সহযোগী দলগুলোতে। নির্বাচন সামনে রেখে দলের তৃণমূল ঝালাই করতে গিয়েও দলটিতে গোলমাল বাধছে। সেখানেও নানা কোটারি। এতে মনঃক্ষুণ্ন ও বিরক্তদের কেউ কেউ সম্প্রতি ঘোরাঘুরি করছেন মবিন-তৈমূরদের তৃণমূল বিএনপির উঠানে বা আশপাশে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
মন্তব্য করুন