ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম
প্রকাশ : ১১ নভেম্বর ২০২৩, ০২:৫৭ এএম
আপডেট : ১১ নভেম্বর ২০২৩, ০৮:৫৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

স্বাগতম! চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ

স্বাগতম! চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ

একটি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে একটি সমন্বিত যোগাযোগ বা যাতায়াত ব্যবস্থা। কিন্তু বাংলাদেশের সমন্বিত যাতায়াত ব্যবস্থা কোনোকালেই ছিল না। বাংলাদেশের অনেক জেলাই ছিল রেলপথের সুবিধাবিহীন। বিশেষ করে টাঙ্গাইল, পটুয়াখালী, বরিশাল, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, কক্সবাজার—এসব জেলায় রেলপথ ছিল না। পদ্মা এবং যমুনা নদীর কারণে দেশটির যাতায়াত ব্যবস্থাও ছিল বিভক্ত। এর ফলে দেশের দুই অংশে গড়ে ওঠে অসম আর্থ-সামাজিক অবস্থা। এখন দেশের সেই অবস্থা নেই। রেল যোগাযোগ এক নেটওয়ার্কের মধ্যে চলে এসেছে। এই অর্জন সম্ভব হয়েছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কারণে। প্রমত্ত পদ্মা নদীর ওপর দিয়ে ট্রেন ছুটল গত অক্টোবর মাসে। ১৯৯৮ সালে যমুনা নদীর ওপর দিয়েও তিনি রেলের ব্যবস্থা করেছিলেন। এভাবেই তার হাত ধরে যোগাযোগ ব্যবস্থায় পূর্ণতা পাচ্ছে গোটা দেশ। গণমানুষের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা এখন দৃশ্যমান!

দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের যেটুকু পথ বাকি ছিল, সেটুকুও আজ ১১ নভেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে বাংলাদেশের রেল যোগাযোগে। দোহাজারী-কক্সবাজার রেল সংযোগ প্রকল্প অর্থাৎ রেলগাড়িতে চড়ে সমুদ্র দেখতে যাওয়া, আজকে সেই স্বপ্ন পূরণের দিন। দোহাজারী থেকে অরণ্য ঘেরা নিসর্গপথে ছুটে চলবে ট্রেন। একপাশে সবুজে ঘেরা পাহাড়, সম্মুখ পানে সীমাহীন নীল সমুদ্রের হাতছানি। ঘন অরণ্যরাজির মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ। কখনো যাত্রীরা চেয়ে দেখবেন চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। বন্যহাতি চলাচলের পথ। ক্রান্তীয় মিশ্র-চিরহরিৎ বনের বনস্পতি শতবর্ষী গর্জন গাছ। এ ছাড়া শাল, সেগুন, আকাশমণি, বট, হারগোজা, চাঁপালিশ বৃক্ষরাজিও ডাকবে হাতছানি দিয়ে। এ যেন কবির কল্পনা নয়, এটা এখন বাস্তব! প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ করে দেখিয়েছেন ট্রেন কক্সবাজারেও যেতে পারে। ভবিষ্যতে এক সময় হয়তো গতির ঝড় তুলে রাজধানী ঢাকা থেকে কক্সবাজারের সমুদ্রের তীর ধরে ছুটে চলবে বুলেট ট্রেন। চট্টগ্রাম থেকে রেঙ্গুন রেলপথের পরিকল্পনা করেছিলেন ব্রিটিশরা। সময়টা ছিল উনিশ শতকের শেষ দশকে অর্থাৎ ১৮৯০ সালে। ব্রিটিশদের পরিকল্পনায় ছিল আসাম থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ করে সেটাকে বার্মা (মিয়ানমার) নিয়ে যাওয়া। এজন্য ১৮৯২ সালে গঠিত হয়েছিল আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে। চট্টগ্রামে এর প্রধান কার্যালয় স্থাপিত হয়। ১৮৯২-১৯৪২ সাল পর্যন্ত এর উদ্যোগে অনেক রেলপথ তৈরি হয়েছিল। ১৯১৭ থেকে ১৯১৯ সালে চট্টগ্রাম-দোহাজারী মিটারগেজ রেললাইন স্থাপন করা হয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ব্রিটিশরা কক্সবাজার থেকে রামু পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণে আর আগ্রহ দেখায়নি। ফলে ব্রিটিশদের এই প্রজেক্টটি পরিত্যক্ত হয়। এমনকি পাকিস্তানি শাসনামলেও এই রেলপথ সম্প্রসারণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। দোহাজারী থেকে রেলপথের সম্প্রসারণের এই সাহসিকতার কাজটি দেখান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৯৯২ সালে প্রথম তিনিই ব্রিটিশদের পরিত্যক্ত এই রেলপথ নির্মাণের উদ্যোগ নেন। এজন্য এসকাপ কমিশন অধিবেশনে ইউরো এশিয়া রেল নেটওয়ার্ক স্থাপনের উদ্যোগ গৃহীত হয়। কিন্তু পরবর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে সেই রেল নেটওয়ার্ক চালুর উদ্যোগ নেয়নি। ফলে দীর্ঘ বিরতি দিয়ে আবারও আওয়ামী লীগ সরকার ২০১০ সালে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমারের নিকটবর্তী ঘুমধুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেন। ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার পর্যন্ত মিটারগেজ রেলপথ নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এটি সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পের আওতাভুক্ত করে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে দ্রুতগতিতে কাজ চলতে থাকে। প্রধানমন্ত্রী গোটা দেশকে রেলওয়ে নেটওয়ার্কে নিয়ে আসার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন। ইতোমধ্যে জনগণ এর সুফল ভোগ করতে শুরু করেছে।

রেল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবা। দরিদ্র মানুষের সাশ্রয়ী মূল্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এর কোনো বিকল্প নেই। রাষ্ট্রের এই গুরুত্বপূর্ণ সেবা অতীতে মুখ থুবড়ে পড়েগিয়েছিল। বিগত সরকারের আমলে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে অনেক রেল কর্মচারীকে বিদায় করা হয়েছে। অনেক স্টেশন স্থবির হয়ে যায়। রেল এতটাই অবহেলিত হয়ে পড়ে যে, প্রচলিত মুখে শোনা যেত কয়টার ট্রেন কয়টায় যায়! এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য পৃথক রেলপথ বিভাগ এবং পৃথক রেলপথ মন্ত্রণালয় গঠন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি উপলদ্ধি করেন দেশের প্রত্যন্ত এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সাশ্রয়ী মূল্যে যোগাযোগ সুবিধা দেওয়া সম্ভব এবং সেটা রেলের মাধ্যমেই। এর ফলে তিনি বাংলাদেশের প্রতিটি জেলাকে রেল নেটওয়ার্কের অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা শুরু করেন। ১৯৯৬ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় এসে তিনি ১৯৯৮ সালে চালু হওয়া বঙ্গবন্ধু যমুনা বহুমুখী সেতুর ওপর রেলওয়ে নেটওয়ার্ক সংযুক্ত করে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে রাজশাহী, রংপুর ও খুলনা বিভাগের যোগাযোগ স্থাপন করেন। বাংলাদেশ রেলওয়ের উন্নয়নে ষষ্ঠ-পঞ্চবার্ষিক (২০১১-২০১৫) পরিকল্পনায় ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ১২১০.৪২ কিলোমিটার নতুন রেলপথ নির্মাণ, ৫০৬.২০ কিলোমিটার রেলপথ ডাবল লাইনে উন্নীতকরণ এবং ১৫৩৫.৭৩ কিলোমিটার রেলপথ সংস্কার ও পুনর্বাসন। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ রেলওয়ের সিগন্যালিং ও ইন্টারলকিং ব্যবস্থা আধুনিকীকরণ করা হয়েছে। ২০০৯ সালের শুরু থেকে আন্তঃনগর ও মেইল ট্রেনসহ সর্বমোট ৯২টি নতুন ট্রেন বিভিন্ন রুটে চালু করা হয়েছে এবং ২৪টি ট্রেনের সার্ভিস বর্ধিত করা হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের সহায়তায় ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃক ‘মাস্টার প্ল্যান’ প্রণয়ন করা হয়েছে। ২০ বছর মেয়াদি মাস্টার প্ল্যানে ৪টি পর্যায়ে বাস্তবায়নের জন্য ২৩৫টি প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিরা, পরাজিত দেশটির কূটকৌশলের নায়করা ও তাদের এজেন্টরা অকৃত্রিম সংকট আর অপচেষ্টা করেও বাঙালিদের দমাতে পারেনি। এইতো বেশিদিন আগের কথা নয়। পদ্মা সেতু নির্মাণকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাংক কী তামাশাই না করল আমাদের সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাই বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। আত্মপ্রত্যয়ী জাতির নেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংকের কাছে নতি স্বীকার করেননি। তার স্বপ্নের প্রচেষ্টার ফল পদ্মা সেতু এখন সচল। গত ২৫ জুন পদ্মা সেতু চালুর এক বছর পূর্তি হয়েছে। এই এক বছরে সেতু দিয়ে চলাচল করেছে প্রায় ৫৬ লাখের বেশি যানবাহন এবং সরকার টোল আদায় করেছে প্রায় ৭৯৫ কোটি টাকা। (সূত্র: প্রথম আলো, ২৫ জুন ২০২৩) এই সময়ে আরও একটি বড় অর্জন পরমাণু যুগে বাংলাদেশের প্রবেশ। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলেই উদ্বোধন হয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। আমরা প্রবেশ করলাম বিশ্ব পরমাণু ক্লাবে।

বাংলাদেশ রেলপথের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে। যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশে রেলপথ সচল হয়েছিল। অনেক ব্রিজ (ভৈরব সেতু, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ) পুনর্নির্মিত হয়েছিল। কিন্তু আশির দশকে রেলপথ পিছিয়ে পড়ে। সেই ঝিম ধরা রেলপথ এখন আগের চেয়ে বেশি সচল। প্রতিটি জেলায় রেল সংযোগ। এগুলো সম্ভব হচ্ছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অক্লান্ত প্রচেষ্টায়। বিগত কয়েক বছর ধরে তিনি এই সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। দেশি-বিদেশি অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এখন দৃশ্যমান। এসব উন্নয়ন কর্মসূচির অনেকই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজস্ব সৃজনশীল চিন্তাশীলতা থেকে উৎসারিত। কক্সবাজারকে রেলওয়ে ম্যাপে অন্তর্ভুক্তির চেষ্টা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সেই সদিচ্ছারই ফসল। জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে সমগ্র বাংলাদেশের।

লেখক: অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

গাজীপুরে প্যারোলে মুক্তি পেয়ে মায়ের জানাজায় যুবলীগ নেতা

একযোগে ৬০ যুদ্ধবিমান দিয়ে ইরানে রাতভর হামলা

গোসল না করেও আদায় হবে জুমার নামাজ? হাসিদ কী বলে

৫ কোটি টাকার সড়ক সমুদ্রে

হোয়াইট হাউস কর্মকর্তাকে ‘সাপ’ বললেন ইলন মাস্ক

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন / মিয়ানমারের ওপর কূটনৈতিক চাপ জোরদার করতে হবে: তারেক রহমান

ফ্রি-কিকে গোল, ক্লাব বিশ্বকাপে মেসির নতুন রেকর্ড

মাইক্রোসফট অফিসের কাছে বড় বিস্ফোরণ

রাজশাহীতে চুরি-ছিনতাই-ডাকাতি আতঙ্ক

ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলে বড় বিস্ফোরণ

১০

মিরাজকে দ্বিতীয় টেস্টে পাচ্ছে বাংলাদেশ

১১

৮ ছানাসহ মা পাতি সরালি ফিরেছে আপন ঠিকানায়

১২

সন্ধ্যার মধ্যে যেসব জেলায় হতে পারে ঝড়

১৩

ক্লাব বিশ্বকাপে বড় অঘটন, পিএসজিকে হারিয়ে দিল ব্রাজিলের ক্লাব

১৪

দাঁত ভালো রাখতে একটি টুথব্রাশ কতদিন ব্যবহার করা উচিত?

১৫

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত : গত ২৪ ঘণ্টায় যা যা ঘটল

১৬

পিরোজপুরে ব্রিজ ভেঙে খালে কয়লাবোঝাই ট্রাক, যান চলাচল বন্ধ

১৭

ট্রাম্পের সঙ্গে পাকিস্তানের বৈঠক কী বার্তা দিচ্ছে

১৮

ইসরায়েলি হামলা বন্ধ হলেও ভয়াবহ বিপদে পড়তে পারেন খামেনি

১৯

জেনেভা বৈঠকে অংশ নিচ্ছেন কারা, উদ্দেশ্য কী

২০
X