নিজের পরাজয় নিজে নিশ্চিত করে বা হেরে গিয়ে ভোটের নিরপেক্ষতা প্রমাণের অবস্থা সরকারের নেই। দেশেও নেই। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মালদ্বীপ নয়। আফ্রিকার গৃহযুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ লাইবেরিয়াও নয়। দেশ দুটির সাম্প্রতিক নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলকে পরাজিত করে জিতেছে বিরোধীরা। হার মেনে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মালদ্বীপিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টি-এমডিপি নেতা ইব্রাহিম মোহামেদ সলিহ বলেছেন, অপূর্ব গণতান্ত্রিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা সফল হয়েছে। লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট জর্জ উইয়া ফল প্রকাশের পর বলেছেন, ‘আমি হেরেছি, জিতেছে লাইবেরিয়া।’
খবর হিসেবে চমকিত হওয়ার মতো। কিন্তু মালদ্বীপ বা লাইবেরিয়া কোনোটাই গণতন্ত্রের মডেল নয়। বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনা হওয়ার মতোও নয়। সেই সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা বাংলাদেশে নেই। তবে কিছুটা মিল যে নেই তাও নয়। দুর্নীতি, প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা, ক্ষমতার অপব্যবহার, জঙ্গিবাদের উত্থান ইত্যাদি ক্ষেত্রে মালদ্বীপের সঙ্গে আমাদের কিছু মিল রয়েছে। গোষ্ঠী-শ্রেণিতে বিভক্ত দরিদ্র দেশ লাইবেরিয়ায় ২০-২৫ বছর গৃহযুদ্ধ হয়েছে। তাদের মতো গৃহযুদ্ধ না হলেও এখানকার রাজনীতিতে কিছু ঘরকাইজ্জা ২০-২৫ বছরের চেয়েও বেশি। গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রশ্নে তারা আমাদের টেক্কা দিয়েছে। এসব টেক্কার জবাব দিতে চাইলেও বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং প্রধানমন্ত্রী কি এখন নিজে নিজেকে হারিয়ে দেবেন? চাইলেও পারবেন? প্রথমত শক্তিশালী প্রতিপক্ষ নেই। দ্বিতীয়ত আমাদের দেশে দলীয় সরকারের অধীনে ক্ষমতাসীন দলের হারার কোনো ব্যবস্থা নেই। দৃষ্টান্তও নেই। তবে হাল অবস্থায় শুধু অংশগ্রহণমূলক ও সব মহলে গ্রহণযোগ্য ছাড়া সুষ্ঠু, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, শান্তিপূর্ণ, সহিংসতাপূর্ণ, রাতে নয় দিনে ভোট করাসহ অন্যান্য শর্ত পূরণ করা সম্ভব।
বিনা ভোটের চৌদ্দ নয়, অথবা রাতের ভোটের আঠারোও নয়। চব্বিশে নতুন মডেলের নির্বাচনের কিছু কথা এরই মধ্যে বেশ চাউর, যা বিএনপি বা কিছু দল নির্বাচনে না এলেও হতে পারে। এবার রাতে নয়, দিনে ভোটের ওয়াদা দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ‘অস্ত্রে নয়, রাতের অন্ধকারে নয়, ভোটেই সরকার গঠন হবে’ মন্তব্য। এটিও শুধু মন্তব্য নয়, ওয়াদাও। এ ছাড়া বাংলাদেশের নির্বাচন স্থানিক হলেও আন্তর্জাতিক বিষয়আসয় যোগ হয়ে গেছে। এ নির্বাচনের পার্ট হয়ে গেছে প্রতিবেশী ভারত, নিকটবর্তী চীন, সুদূরের যুক্তরাষ্ট্রসহ নানা দেশ। তাই এ নির্বাচনে কোন দল বা জোট কী চায়—এর চেয়ে কোন দেশ কী চায়, সেই কাঙালপনা ওপেন সিক্রেট হয়ে গেছে। কোনো রাখঢাক নেই। কোন দেশ কোনদিকে তা দলে দলে বেলাজের মতো আলোচিত। পথে-ঘাটে-মাঠেও উচ্চারিত।
নির্বাচনের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে সাত-আটটি মানদণ্ড বেশ আলোচিত। দেশভেদে তা আপেক্ষিক। তবে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার কিছু কমন আন্তর্জাতিক মানদণ্ড রয়েছে। বিভিন্ন প্রটোকল, ঘোষণা, চুক্তি এবং নানা ধরনের আন্তর্জাতিক নিয়মনীতির আলোকে নির্বাচনের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নির্ধারণ হয়। জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় বলা হয়েছে, নির্ধারিত সময় পরপর এবং প্রকৃত নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ হবে। ১৯৯৬ সালের ১২ জুলাই জাতিসংঘের কমিটি মানবাধিকার, ভোটাধিকার ও নির্বাচনসংক্রান্ত একটি ঘোষণা গ্রহণ করেছে। নির্বাচনের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নির্ধারণের ক্ষেত্রে সেখানে ২৫টি বিষয় গ্রহণ করা হয়েছে।
‘দ্য রাইট টু পার্টিসিপেট ইন পাবলিক অ্যাফেয়ার্স, ভোটিং রাইটস অ্যান্ড দ্য রাইট টু ইকুয়াল একসেস টু পাবলিক সার্ভিস’—শিরোনামের ঘোষণায় নির্বাচন ও ভোটাধিকারসংক্রান্ত নানা বিষয় উল্লেখ করা আছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের প্রতিষ্ঠিত ‘দ্য কার্টার সেন্টার’ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সুসংহত করায় ভূমিকা রাখে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট-এনডিআইয়ের রিপোর্টে বলছে—এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন দেশের সরকার যৌথভাবে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও নির্বাচনসংক্রান্ত নানা ঘোষণায় স্বাক্ষর করেছে। সেখানে বলা আছে, ইনক্লুসিভ বা অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের কথা। এনডিআই ভোটার ও প্রার্থীদের অধিকার সুরক্ষাকে গুরুত্ব দেয়। প্রার্থীদের জড়ো হওয়া কিংবা শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকারও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হয় আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে। যুক্তরাষ্ট্রের কার্টার সেন্টার বলছে, প্রার্থী ও রাজনৈতিক দল হচ্ছে নির্বাচন প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এখানে বলা হয়েছে, প্রার্থী ও রাজনৈতিক দল ভোটারদের মতামতের প্রতিনিধিত্ব করে।
১৯৯৪ সালের ২৬ মার্চ প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইন্টার-পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের সর্বসম্মত ঘোষণায় বলা হয়েছে, প্রচারণার জন্য দেশজুড়ে প্রার্থীরা যাতে নির্বিঘ্নে যেতে পারে সেটি নিশ্চিত করা জরুরি। এর পর রয়েছে স্বাধীন পর্যবেক্ষণের কথা। নির্বাচনের প্রতিটি দিক পর্যবেক্ষণের জন্য নাগরিক সংগঠনগুলো যাতে অংশ নিতে পারে, সেজন্য অবশ্যই তাদের সুযোগ দিতে হবে। এটি এক অর্থে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের বিষয়। ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস প্রিন্সিপাল অনুযায়ী, রাষ্ট্রের সুশাসন এবং জনগণের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলোতে অংশ নেওয়া নাগরিকদের অধিকার রয়েছে। হিউম্যান রাইটস প্রিন্সিপালের ২০ নম্বর অনুচ্ছেদে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় পর্যবেক্ষকদের গুরুত্বের বিষয়টি উল্লেখ করা আছে। নির্দলীয় পর্যবেক্ষকদের বিষয় উল্লেখ আছে আরও কয়েকটি আন্তর্জাতিক সনদে। গণমাধ্যমে সমান সুযোগ এবং স্বাধীন সংস্থার আছে জাতিসংঘ কমিটির ঘোষণায়। সেখানে কোনো ধরনের ভয়ভীতি, অর্থের প্রলোভন কিংবা কোনো অযাচিত প্রভাবমুক্তির কথা আছে। ভোটের পূর্বাপরে ভোটারদের প্রতিহিংসার শিকার না হওয়া, প্রার্থীদের পূর্ণাঙ্গ তথ্য ভোটারদের কাছে থাকা, ব্যালট বাক্সের নিরাপত্তা, প্রার্থীদের এজেন্টের সামনে ভোট গণনাসহ সম্পূরক আরও কয়েকটি বিষয়ও রয়েছে মানদণ্ডের মধ্যে। এগুলোর রকমফেরও আছে। এখন পর্যন্ত সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া বাদবাকি সূচকগুলো এ নির্বাচনেও বিদ্যমান।
বাংলাদেশের বাস্তবতা হচ্ছে, সংখ্যায় দুটি অর্থাৎ আওয়ামী লীগ বা বিএনপি ছাড়া হলে সেই নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হয় না। আর দুটির একটিও না থাকলে সেটি নির্বাচনের মধ্যেই পড়ে না, যা হয়েছে জেনারেল এরশাদ জমানায় ১৯৮৮ সালে। বাংলাদেশে আগের কোনো মডেলের সঙ্গে সামনের মডেল সম্পর্কে ধারণা পাওয়া কঠিন। গত অর্ধশত বছরে ভোটের বহু মডেল প্রদর্শন হয়েছে বাংলাদেশে। এখানে গণতন্ত্রের বহু মারপ্যাঁচ। একদলীয়, দ্বিদলীয়, কয়েকদলীয়, বহুদলীয় ইত্যাদি। ভোট আর নির্বাচনেরও এন্তার বারোয়ারি কাণ্ড। নামও অনেক। সুষ্ঠু নির্বাচন, নিরপেক্ষ নির্বাচন, অবাধ নির্বাচন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। ভোটেরও নানা নাম-চিহ্ন। ভোট ক্যু, মিডিয়া ক্যু, বাক্স লুটের ভোট, হ্যাঁ-না ভোট। সূক্ষ্ম কারচুপি, স্থূল কারচুপিরও নানান কলসাইন। মাগুরা, মীরপুর, ১৫ ফেব্রুয়ারি, বিনা ভোট, রাতের ভোট ইত্যাদি। সালশা নির্বাচন নামও আছে। সামনে অপেক্ষা করছে কোনটি?
এ নিয়ে প্রশ্ন ও দাবদাহ পজিশন-অপজিশন দুদিকেই। সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ-অবাধ-গ্রহণযোগ্য-আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ইত্যাদি বিশেষণযুক্ত নির্বাচনের কড়া তাগিদ যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক বিশ্বের। কিন্তু সেই ভোটের ধরন সম্পর্কে ধারণা এখন পর্যন্ত একেবারেই অন্ধকারে। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন দেশের প্রথম নির্বাচনে একটি মডেল দেখেছে মানুষ। ব্যালট বাক্স লুট থেকে শুরু করে দলের প্রায় সব প্রার্থীকে জয়ী ঘোষণার নির্বাচনের ওই মডেল ভোটের জন্য আজীবন সংগ্রামী বঙ্গবন্ধুর ইমেজে চরম আঘাত হানে। খাসপছন্দের খন্দকার মোশতাককে (পরবর্তী নাম খুনি মোশতাক) জয়ী দেখাতে ব্যালট বাক্স কুমিল্লা থেকে ঢাকা এনে অধিকতর সঠিক ফলাফল দেওয়ার ঘটনা ব্যাপক আলোচিত-সমালোচিত। এরপর রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে হ্যাঁ-না ভোট, আওয়ামী লীগকে নৌকা-মই ইত্যাদি চার ভাগে সিট বণ্টনসহ নানা মডেল শো। এ শোতে আরও নতুনত্ব আসে জেনারেল এরশাদ জমানায়।
নির্বাচনের এ সিরিজ মডেল শোতে প্রথম ব্যতিক্রম আসে এরশাদ পতনের পর ’৯১-তে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে। স্বাধীন দেশে প্রথম স্বাধীন নির্বাচনের স্বাদ পায় মানুষ। তবে ওই নির্বাচনে হেরে যাওয়া আজকের ক্ষমতাসীনদের কাছে সেটি ছিল সূক্ষ্ম কারচুপির মডেল। এর মধ্যেই গণ্ডগোল পাকে তখনকার বিএনপি সরকারের মাগুরা ও মীরপুর উপনির্বাচনী মডেলে। এরপর ১৫ ফেব্রুয়ারি মডেল। তারপর বিচারপতি হাবিবুর রহমান, লতিফুর রহমান, ফখরুদ্দীনদের তত্ত্বাবধায়ক জমানায় নির্বাচনের মোটামুটি একটি মডেল চলতে থাকে। এরপর শুরু হয় বাংলাদেশে নির্বাচনী নাশকতা। হতে হতে ২০১৮ সালে এসে দিনের ভোট রাতে সেরে ফেলার নতুন মডেল গড়ার অভিযোগ।
এর আগে, ২০১৪ সালে বিনা ভোটেই ১৫৪ জনকে জয়ী ঘোষণার রেকর্ড। এ অবস্থায় এবার ২৪ মডেল সমাগত। প্রধান নির্বাচন কমিশনার গ্যারান্টি দিয়ে বলেছেন, এবার আর দিনের ভোট রাতে হতে দেওয়া হবে না। তার আগের জনের অঙ্গীকার ছিল ’১৮ সালে ’১৪ সালের মতো বিনা ভোটে ১৫৪ জনকে পাস করতে দেবেন না তিনি। কথা রেখেছেন তিনি। বিনা ভোটে এমপি হওয়া কমিয়েছেন। কিন্তু ভোট রাতে এগিয়ে এনেছেন। ২০১৪-১৮ সালের মতো ভোটকাণ্ড এবার সম্ভব হবে না বলে ধারণা অনেকের। ধারণাটা অনেকের কাছে বিশ্বাসের পর্যায়ে। মালদ্বীপ-লাইবেরিয়া না হোক, সরকার চাইলে অন্তত মন্দের ভালো নজির তৈরি করতে পারে। সেই সক্ষমতা ও রসদ সরকারের আছে। বাকিটা লেজিটিমেসি আনার বোধ ও সদিচ্ছার বিষয়।
লেখক : ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন