আমি তালা বলছি। দেশ-বিদেশে গত ৫৪ দিনে তলে তলে অনেক কিছু হয়ে গেছে। বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলা কিসিঞ্জারও এরই মধ্যে ইতিহাসের পাতায় তলিয়ে গেছেন। ভারি বৃষ্টিতে চেন্নাই বিমানবন্দরের রানওয়ে তলিয়ে যাওয়ায় তলপেটে ব্যথা নিয়ে কাতরাচ্ছে শত শত রোগী। ২০০৬ সালের সর্বোচ্চ রেকর্ড অতিক্রম করে জার্মানিসহ ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে হাঁটু ছেড়ে প্রায় কোমর ছুঁইছুঁই বরফে তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাটে জমা বরফ। সে বরফ একদিন নিশ্চয়ই গলবে। কিন্তু আমি বেটা তালা সেই কবে থেকে পল্টনের এক দালানের কলাপসিবল গেটে ঝুলে আছি; আমার কী হবে?
এ দেশের অনেক উন্নতি হয়েছে। বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনে এ দেশের অবস্থান তাক লাগানোর মতো। তবে তালা উৎপাদনে এখনো তলানিতে এ দেশ। তাই চীন থেকে আমাকে আসতে হয়েছে। কেউ আমাদের তারিফ করে না। তলে তলে বলে ‘মেইড ইন চায়না, ভরসা করা যায় না’। অথচ এ দেশের কতিপয় ফকিন্নি নেতাদেরও যে ভরসা করা যায় না, এ নিয়ে আমি কি কিছু বলি? মনে রেখো, আমি তালা সবসময়ই ভরসার নাম। সময়মতো তালা মারা মানে জানমাল নিরাপদ, রাজনীতি নিরাপদ, ভোট নিরাপদ এবং ক্ষমতা নিরাপদ। মুখে তালা মারলে শত্রু হয় না। যে দেশের মানুষ তালা বানায় না, সে দেশের মানুষ বেশি কথা বলে, এক লাইন বেশি বুঝে এবং আখেরে ‘কট বিহাইন্ড’ হয়। অথচ তালা মারলেই যত লাভ। অনেক পর্যটন কেন্দ্রে দেখো না যুগলরা কেমন তালা (লাভ লক) মেরে চাবি পানিতে ফেললে কাঁঠালের আঠার মতো জমে যায় প্রেম-পিরিতি!
তবে প্রেমে অভিমান থাকে জানা থাকলেও আমার মতো তালাকে নিয়ে এত মান-অভিমান, তর্ক-বিতর্ক কেন রে ভাই? পল্টনে দিনের পর দিন আমাকে এভাবে কলাপসিবল গেটে ঝুলিয়ে রাখার কী মানে? আমি তো তালা। আমার মুখেও রওশন এরশাদের মতো তালা। আমি কেন, আমার অন্য কোনো জাতভাই মানে, কোনো প্রকার তালাই কাউকে কখনো ‘শালা’ বলে গাল দেয়নি। তারপরও আমাকে এভাবে ঝুলিয়ে রাখার দায়িত্ব কেউ নিচ্ছ না কেন? আমি কি দাগি আসামি যে আমাকে এভাবে পুলিশের প্রহরায় থাকতে হবে। ভাগ্যিস আমার বাথরুম পায় না, তাহলে কী করতে তোমরা? শোনো, বেশি বাড়াবাড়ি করলে আমি কিন্তু সব বলে দেব। এক বাথরুমে কমোডের ছবি দিয়ে লেখা ছিল ‘কিপ মি. ক্লিন, আদারওয়াইজ আই শেল টেল হোয়াট আই হ্যাভ সিন’ অর্থাৎ একটি কমোড বলছে—‘আমাকে পরিষ্কার রাখো, নইলে আমি কী দেখেছি তা কিন্তু বলে দেব।’ কমোড ভাইয়ের মতো আমিও বলি, আমাকে নিয়ে রাজনীতি ছাড়ো, নইলে আমি কী দেখেছি সব বলে দেব।
২ নভেম্বর ২০২৩ ছিল আমার জীবনের স্মরণীয় দিন। নির্বাচন কমিশনের কতিপয় অর্বাচীন ওইদিন দালানের লোকজনকে না পেয়ে খামোখা আমার সামনে রাখা প্লাস্টিকে চেয়ারে একটি চিঠি রেখে যায়। ব্যস, আমাকে আর পায় কে! আমার ছবি তুলতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে ফটোসাংবাদিকরা। আমি তালা হয়ে গেলাম ‘টক অব দ্য টাউন’। তবে কোনো কোনো পত্রিকা আমার চেয়ে নির্বাচন কমিশনের খাম রাখা চেয়ারকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। তাতে অবশ্য আমি হিংসা করি না। কারণ আমি জানি, চেয়ার চেয়ারই। সারা জীবন মানুষের নিতম্বের নিচেই থাকবে। কিন্তু আমার কদর কমবে না কোনো দিন।
অবশ্য তালার কদর কমবে না, এমন কথা বলার যুগও বোধহয় বেশি দিন স্থায়ী হবে না। দেখো না তালার জায়গায় তালা ঝুলে থাকে কিন্তু ব্যাংকের টাকা, বিমানবন্দরের শুল্ক গুদামের সোনা, সরকারি তথ্যভান্ডারের ডাটা সবই হাওয়া-খাওয়া হয়ে যায়। হাওয়াকে আটকানোর সাধ্য তো আর তালার নেই—তাই না। তাই বলে এভাবে আমাকে দিনের পর দিন ঝুলিয়ে রাখা কি ঠিক? কেউ যদি আমাকে নিয়ে রঙ্গব্যঙ্গ করে বা রূপক অর্থ করে, তখন কী হবে বলো তো? তাই বলি সময় থাকতে আমাকে খোলো। ভেবো না যে আমি বলি না বলে কেউ বুঝে না আমার চাবি কার কাছে আছে?
আর ভালো লাগছে না। চলো রবীন্দ্রসংগীত শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যাই। ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে, ও বন্ধু আমার! না পেয়ে তোমার দেখা, একা একা দিন যে আমার কাটে না রে।’ ধুর ছাই! সাতসকালে নজরুলের কবিতা ধরল কে আবার—‘আশিটা বছর কেটে গেল, আমি ডাকিনি তোমায় কভু, আমার ক্ষুধার অন্ন তা’বলে বন্ধ করনি প্রভু! তব মসজিদ-মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবি, মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি! কোথায় চেঙ্গিস, গজনি-মামুদ, কোথায় কালাপাহাড়? ভেঙে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা-দেওয়া-দ্বার! খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা? সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়ি-শাবল চালা! হায় রে ভজনালয়, তোমার মিনারে চড়িয়া ভন্ড গাহে স্বার্থের জয়!’
লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
ইমেইল : [email protected]