সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
প্রকাশ : ২১ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৩:৫৬ এএম
আপডেট : ২১ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৯:৪৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

এই রাজনীতি ধ্বংস হোক

এই রাজনীতি ধ্বংস হোক

রাজধানীর তেজগাঁও স্টেশনে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে আগুন দিয়ে শিশুসহ চারজনকে যারা পুড়িয়ে মেরেছে তারা সেই গোষ্ঠী—যারা এরকম করে পথেঘাটে মানুষকে পুড়িয়েছিল ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত। এরা আবার সেই আগুন সন্ত্রাসের দিন ফিরিয়ে এনেছে। তথাকথিত হরতাল আর অবরোধ কর্মসূচি সফল করার নামে মানুষ পোড়ানো, সম্পদ পোড়ানোর ভয়ংকর রাজনীতি আবার ফিরে এসেছে। বলতে গেলে আবার নতুন করে উল্লাস করছে এই রাজনীতির কারিগর আর কুশীলবরা।

কী নিষ্ঠুর সেই দৃশ্য! কিন্তু অবাক করার ব্যাপার এই যে, মানুষের এই অঙ্গার হয়ে যাওয়ায় ওরা বিচলিত হয় না, ওরা তর্ক করে, যেমন করে তারা গ্রেনেড হামলার দায়ও চাপিয়েছিল ভিকটিমদের ওপরই। সবাই বলছে ঘটনা ভয়াবহ। কিন্তু ভয়াবহ ঘটনা কি অপ্রত্যাশিত ছিল? আকস্মিক? না তা নয়। কোথাও না কোথাও তো ঘটতই। এই পরিকল্পিত দুর্বৃত্তায়ন ঘটানো হয়েছে দেশবিরোধী আর মানুষবিরোধী রাজনীতিকদের নির্দেশে, যারা নক্ষত্র সমান দূরে থেকে সমাজবিরোধী ও দুষ্কৃতকারীদের এরকম পারদর্শিতা দেখে উল্লাস করছেন।

গত ২৮ অক্টোবরের পর থেকেই শুরু হয়েছে এই আগুন উল্লাস। শত শত বাস, ট্রাক, হাঁস-মুরগির ভ্যান, নছিমন, করিমন পুড়ে গেছে, আহত ও নিহত হিসাব ছাড়া। বহু মানুষ আজ এই রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার। এমন মৃত্যুর শেষ কোথায়, কেউ জানে না। এরকম উন্মত্ত সহিংসতায় কী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত—সেটাও অজানা।

ক্ষমতার প্রসাদ পেতে মানুষকে কয়লা বানানোর এই রাজনীতি যারা করছে তারা কিন্তু মুখে আবার গণতন্ত্র, মানবাধিকারের কথাগুলো জোরেশোরেই বলে। হরতাল সফল করতে আগুন সন্ত্রাস বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন সংযোজন এবং একটি ভয়ানক সংযোজন, যেখান থেকে বের হয়ে আসা সহজ নয়। যে ছেলেটি নিজের প্রাণ বিপন্ন করে সামান্য টাকার বিনিময়ে পেট্রোল বোমা মারতে যাচ্ছে, বা যে ছেলেটি হিংস্রভাবে অন্যের প্রাণ কাড়তে ব্যস্ত—তারা কী অভাবের তাড়নায় এটি করছে সামান্য কিছু অর্থের বিনিময়ে? নাকি তাদের মনোজগতকেই বদলে ফেলা হয়েছে এই নিষ্ঠুরতার দর্শনে?

তারা ভোট বর্জন করছে, সেই অধিকার তাদের আছে। কিন্তু মানুষের তো চলবার অধিকার আছে, কাজে যাওয়ার অধিকার আছে এবং তারা এসব রাজনীতির বাইরের মানুষ। ক্ষমতা কেন্দ্রের কাউকে কিছু করতে না পেরে এই সাধারণ নাগরিককে পুড়িয়ে মারার নাম যদি হয় রাজনীতি, তাহলে এই রাজনীতি ধ্বংস হোক।

শাসক দল হিসেবে যেভাবে আওয়ামী লীগ নির্বাচন করছে তার সমালোচনা আছে, নানা বিরোধিতাও করা যায়। বিএনপি ছাড়া একটি নির্বাচন গণতন্ত্রের বিকাশের স্বার্থে প্রত্যাশিতও নয়। কিন্তু নির্বাচন প্রতিহতের নামে এই হত্যাযজ্ঞ কেন? এখানে মানুষের দায়টা কোথায়?

রাজনীতি আমাদের সুস্থ সমাজ গঠনের স্তম্ভ। তাকে ঘিরে গড়ে ওঠে পরিবার। রাজনীতিকরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হলেও নিজেদের মধ্যে সৌজন্যতা রক্ষা করে চলেন। সেটা আমরা নাগরিক পরিসরে দেখি। তারা একে অন্যের সঙ্গে ছেলেমেয়ের বিয়েও দেন। যোগাযোগ রাখেন। সময়ে-অসময়ে পাশে দাঁড়ান শারীরিকভাবে বা সামাজিক মাধ্যমে। তারাই কি না রাজনীতির বিরোধিতার নামে সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে এভাবে বদলে যান? এভাবে হত্যায় উন্মত্ত হন?

মানুষ মারা যাচ্ছে, ভয়ংকর হিংসাত্মকভাবে মানুষ মারা হচ্ছে। কিন্তু যে দিকটি আরও ভয়ংকর—তা হলো এই প্রবণতার ফলে খানিকটা হলেও রাজনীতির পরিসরে অসুস্থ রাজনীতি সহজ হয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক রণনীতির বদলে খুনখারাবিই রাজনীতি হয়ে উঠছে। উঠে আসছে উন্মাদনা।

মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে শুধু আগুন নয়, কয়েকদিন আগে আমরা দেখেছি গাজীপুরে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে দুর্বৃত্তরা। গত ১৩ ডিসেম্বর ভোর সাড়ে ৪টার দিকে ভাওয়াল, গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর রেলস্টেশন থেকে কিছুটা দূরে ছিলাই বিল এলাকায় রেললাইনের ২০ ফুট কেটে রাখা হয়। এতে দুর্ঘটনায় পড়ে ঢাকাগামী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস। ট্রেনের সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে ইঞ্জিনসহ চারটি বগি ধানক্ষেতে দুমড়ে-মুচড়ে পড়ে গেলে একজন মারা যায়।

রেললাইন কেটে ফেলা, বাসে ও অন্যান্য ছোটবড় পরিবহনে আগুন দেওয়া সবই হচ্ছে সরকারবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। তাই এই দায় হরতাল ও অবরোধ আহ্বানকারীদের। পুলিশ বলছে, গাজীপুরে রেললাইন কাটার পরিকল্পনা হয় সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর বিএনপি নেতা হাসান আজমল ভুঁইয়া নেতৃত্বে। জয়দেবপুরে নিজের বাসায় দলটির জেলা ও মহানগরের কয়েকজন নেতাকর্মী নিয়ে এই পরিকল্পনা করেন তিনি। পুলিশ এ ব্যাপারে সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে।

রাজনৈতিক সহিংসতা বাঙালির মজ্জায়। বাংলাদেশে জাতিগত সহিংসতা হয় না। কিন্তু ইতিহাস বলে রাজনৈতিক হিংসা ঠিকই হয়। তবে এভাবে মানুষ পুড়িয়ে মারা শুরু হয়েছে ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রতিবাদ থেকেই এবং সেই সহিংসতায় জামায়াতের সঙ্গে যুগপৎভাবে ছিল বিএনপি। মাঝে সাময়িক বিচ্ছেদের পর নির্বাচন বিরোধিতাকে কেন্দ্র করে তারা আবার সমান্তরাল আন্দোলন করছে।

রাজনীতি অনেক আগেই রসাতলে গিয়েছে। এখন দেশটাকে নিচ্ছে তারা। নির্বাচন বিরোধিতা রাজনৈতিকভাবে একটি দল করতেই পারে, কিন্তু বিরোধিতার নামে মানুষ হত্যা, পুড়িয়ে মারা কি কোনো রাজনীতি?

আমরা যতটুকু ভাবছি, সমস্যাটা তার চেয়েও গভীরে। এরকম চলতে থাকলে বলতেই হবে যে, আমরা আইএস বা তালেবান নামক বর্বরদেরও পেছনে ফেলে দিচ্ছি। এইতো কিছুদিন আগে, শ্রীলঙ্কায় জনবিদ্রোহ হয়েছে, রাজাপাকসে সরকারের পতন ঘটেছে। কিন্তু কোথাও সম্পদের ক্ষতি হয়নি, কোনো মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয়নি। তাই প্রশ্ন জাগে, আমরা তাহলে সভ্য হব কবে?

তবে কী এমন এক রাজনীতি চালু করতে যাচ্ছে এরা—যেন মানুষ নিয়মিত রাজনৈতিক হিংসা দেখবে! খুন দেখবে! মারধর দেখবে! রক্তপাত দেখবে? এতদিন এরা বলেছে ভোট হতে দেবে না। এখন যখন দেখছে ভোট হয়েই যাচ্ছে, তখন বলছে মানুষ যেন ভোট দিতে না যায়। কিন্তু তাতেও যখন ফল দিচ্ছে না, তখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাহলে মানুষকেই পুড়িয়ে মারার। তারা হয়তো ভাবছে, ভোট হয়ে যাচ্ছে আর দু-চারটে বোমা পড়বে না? অস্ত্রের ব্যবহার হবে না? গোটা দশেক লাশ পড়বে না? তা হলে আর ভোটবিরোধী আন্দোলন কীসের?

সহিংসতা-নাশকতা কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। জীবন ও সম্পদ নাশের যে ভয়াবহতা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে, তা কোনোভাবেই অধিকার আদায়ের কিংবা গণতান্ত্রিক আন্দোলন হিসেবে স্বীকৃত হতে পারে না। বিএনপি অস্বীকার করছে, কিন্তু ধারাবাহিক নাশকতার দায় আন্দোলনকারী রাজনৈতিক দলগুলো কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।

নির্বাচন রাজনৈতিক ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এই নির্বাচন নিয়ে যে প্রশ্ন করতেই পারে। বিরোধিতা করতে পারে। বর্জন করতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন করার নামে সহিংস রাজনৈতিক পথ অবলম্বন কোনোভাবেই সুস্থ রাজনৈতিক চর্চার পরিচয় বহন করে না। নির্বাচন, আন্দোলন এবং একে কেন্দ্র করে সহিংসতা জনজীবনে যে আতঙ্কের ছায়া দীর্ঘায়িত করছে, এর দায় রাজনীতিকদেরই।

রাজনৈতিক সংকটের সমাধান রাজনৈতিকভাবেই করা দরকার, কোনোভাবেই সেটা যেন জনজীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলে না দেয় বা জনগণকে জিম্মি না করে। বিএনপিসহ তার মিত্রদের বুঝতে হবে, গত ২৮ অক্টোবরের পর থেকে হরতাল-অবরোধে হতাহতের যেসব মর্মস্পর্শী ঘটনা ঘটছে, এ ধরনের নিষ্ঠুরতা রাজনৈতিক আন্দোলনের কৌশল বা উপাদান হতে পারে না। এতে করে মানুষ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার চাইতে আরও দূরে সরে যাচ্ছে, সতর্ক অবস্থানে থাকছে।

এটি রাজনীতি নয়। রাজনীতির নামে অপরাজনীতি। আন্দোলনের নামে মানুষবিরোধী ঘৃণ্য পথ। নাশকতা-নৃশংসতা কোনো রাজনৈতিক কৌশল হতে পারে না। বরং এরকম পন্থা রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের প্রমাণ। গাজীপুরে রেললাইন কাটা, তেজগাঁওয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারা কোনো ছোটখাটো অপরাধ নয়, একেবারে ফৌজদারি অপরাধ। এসব ঘটনার যথাযথ তদন্তক্রমে দ্রুত নাশকতাকারীদের শনাক্ত করে দৃষ্টান্তযোগ্য বিচারের আওতায় আনার বিকল্প নেই। কোনোভাবেই তাদের ছাড় নয়। এমন ব্যবস্থা নিতে হবে যে, ওদের হৃদয়ে কম্পন ধরে যায়।

মানুষকেও রুখে দাঁড়াতে হবে। যতখানি নিরীহ রক্ত ঝরে, তার প্রতিশোধ নিতে হবে মানুষকেই। একটা অন্যায় দিনের পর দিন হবে, অথচ প্রতিকার হবে না, তা যেন না হয়। হিংসা-প্রতিহিংসাকে জাগ্রত করে সেটাই ভয়ংকর সত্য। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা যেন সেটা মনে রাখেন।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও পদ্মার চরে জমজমাট ইলিশের বাজার

রাজশাহী ও বগুড়ায় বাংলাদেশ-আফগানিস্তান ওয়ানডে সিরিজ

যেসব সাধারণ কারণে পুরুষদের পেলভিক ব্যথা হয়

হাসিনাকে ফেরাতে রেড নোটিশ জারির পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে : দুদক চেয়ারম্যান

জামায়াত কর্মী মহিবুর হত্যা মামলায় ১৫ জনের যাবজ্জীবন

অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের সেনা আইনে বিচার দাবি

চুরির অভিযোগে আটকদের আনতে গিয়ে পুলিশের গাড়ির চাবি চুরি

১৮ অক্টোবরের মধ্যে এনসিপি প্রতীক বাছাই না করলে সিদ্ধান্ত নেবে ইসি

আইনের বেড়াজাল পেরিয়ে কারাগারে বিয়ে

স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়ার সময় দুর্বৃত্তের হামলা, যুবদল নেতা নিহত

১০

মোবাইলে ব্রাজিল-জাপান ম্যাচ দেখবেন যেভাবে

১১

চাকসুর ভোট গণনা হবে যেভাবে

১২

সড়কে বেপরোয়া অটোরিকশা, অসহায় প্রশাসন

১৩

পুলিশের ধাওয়ায় নদীতে ঝাঁপ, ৩ দিন পর লাশ উদ্ধার

১৪

আগামী নির্বাচনে দুর্নীতিবাজদের মনোনয়ন না দেওয়ার অনুরোধ দুদক চেয়ারম্যানের

১৫

মিরপুরে গার্মেন্টস-কেমিক্যাল গোডাউনে আগুন, নিয়ন্ত্রণে ৭ ইউনিট

১৬

টিভিতে দেখাবে না বাংলাদেশ-হংকং চায়না ম্যাচ, মোবাইলে দেখবেন যেভাবে

১৭

১৭ অক্টোবর থেকে দেশের ২৯ জেলায় বৃষ্টির পূর্বাভাস 

১৮

পাসওয়ার্ড মনে রাখতে পারছেন না? সহজ সমাধান এনেছে গুগল

১৯

জামায়াত আমিরের সঙ্গে ডেনিশ রাষ্ট্রদূতের সৌজন্য সাক্ষাৎ

২০
X