মুফতি আরিফ খান সাদ
প্রকাশ : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৩:৩৩ এএম
আপডেট : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৭:৫৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

কোরআনের প্রথম বাণী ‘পাঠ করো’

কোরআনের প্রথম বাণী ‘পাঠ করো’

পৃথিবীতে সৃষ্টিকুলের শ্রেষ্ঠ হিসেবে মানুষের মর্যাদা। এমনকি নিষ্পাপ ফেরেশতাদের ওপরও মানুষকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন মহান আল্লাহ। আর এর নিদর্শন হিসেবে ফেরেশতাদের নির্দেশ দিয়েছেন যেন আদমকে সেজদা করে তারা। মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের অন্যতম কারণ, তাদের জ্ঞান। কারণ, ফেরেশতারা যা জানতেন না, মানুষ তা জানে। তাই জ্ঞানী মানুষের মর্যাদা তৈরি হয় সর্বত্র। রাসুল (সা.)-এর প্রতি যখন কোরআন অবতীর্ণ হয়, প্রথম আয়াতের প্রথম শব্দেই আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন— ‘ইকরা’, অর্থাৎ, ‘পড়ো’, ‘পাঠ করো’। মহান প্রতিপালক রবের নামে পড়ার তাগিদ দেওয়ার মাধ্যমে মহাগ্রন্থ কোরআন নাজিলের সূচনা। পড়ার মাধ্যমে মানুষ জ্ঞানার্জন করে। এমনকি ইসলাম জানার জন্যও জ্ঞানার্জনের বিকল্প নেই। উল্লেখ্য, পবিত্র মক্কা নগরী তখন ছিল শিরকের অন্ধকারে নিমজ্জিত, মানুষ আল্লাহকে ভুলে মূর্তির পূজা করত; স্বাভাবিকভাবেই মনে হতে পারে, শিরকের অন্ধকার দূর করতে প্রথম নির্দেশ হবে কালেমার, কিংবা মূর্তি পূজা বর্জন করে নামাজের। কিন্তু আল্লাহ পাঠ গ্রহণের নির্দেশ প্রথমে দিয়ে এটাই বুঝিয়েছেন, জ্ঞানের আলো জ্বললে অন্ধকার এমনিতেই দূরীভূত হবে। মানুষ যত জানবে, তত সৃষ্টিকর্তাকে চিনতে পারবে। সৃষ্টিকর্তার কালেমায় সাক্ষ্য দেবে এবং তার কুদরতি কদমের সামনেই সেজদাবনত হবে।

মহান আল্লাহ এ মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা ও প্রতিপালক। মহাবিশ্ব জুড়ে আল্লাহর অসংখ্য নির্দেশনাবলি রয়েছে। যেগুলো দেখে সাধারণ চোখে অনেক কিছুই আমাদের বোঝা সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন জ্ঞান ও গভীর চিন্তার। অনেক দৃষ্টান্তও আল্লাহ দিয়েছেন। সেগুলো বোঝার জন্য যে জ্ঞান দরকার তা কোরআন বলছে, ‘আর এসব দৃষ্টান্ত আমি মানুষের জন্য পেশ করি আর জ্ঞানী লোকেরা ছাড়া কেউ তা বুঝে না।’ (সুরা আনকাবুত : ৪৩)। আর এজন্যই তো জ্ঞানী ও মূর্খের মধ্যে পার্থক্য। দুনিয়ার জীবনেও দেখা যায়, যারা নিজেদের জ্ঞানের পথে নিয়োজিত করেছে, পড়েছে, বুঝেছে, বাস্তব জীবনেও তারা ভালো করছে। আর যারা তাতে বেশি গুরুত্ব দেয়নি তাদের জীবনও তেমনি। জানার প্রতি কোরআনের তাগিদও তাই—‘বলুন, যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান হতে পারে?’ (সুরা জুমার : ৯)। যে ব্যক্তি মহান আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে গবেষণা করে জ্ঞানী হয়, তার দ্বারাই আল্লাহ অজস্র নেয়ামত অনুধাবন সম্ভব। এর মাধ্যমে আপনিতেই তার মাথা নুইয়ে আসে। আল্লাহকে সে বেশি ভালোবাসতে শেখে। সে কথাই কোরআন বলছে, ‘আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে জ্ঞানীরাই আল্লাহকে বেশি ভয় করে।’ (সুরা ফাতির : ২৮)।

কোরআনের শব্দ ‘অহি’ থেকে বাংলা ‘বই’ শব্দের উদ্ভব। বাংলা ভাষায় জ্ঞানচর্চা ব্যাপক ও সার্বজনীন করেছে মুসলমানরা। ইসলাম আগমনের আগে জ্ঞানচর্চার অধিকার শুধু ব্রাহ্মণদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। শূদ্র বা নিম্নজাতের মানুষের অধিকার ছিল না জ্ঞানের আসরে বসার। এ দেশে মুসলমানদের সঙ্গে আগমন করেছে জ্ঞানচর্চার ঐশী আলো। আমির থেকে অধম, ধনী থেকে গরিব, সাদা থেকে কালো সবাই স্নাত হয়েছে জ্ঞানের আলোয়। বাংলায় প্রবেশ করেছে অসংখ্য কোরআনের শব্দ। সুখের বিষয়—বাংলার দুই বর্ণের ‘বই’ শব্দটিও এসেছে আরবি ‘অহি’ শব্দ থেকে। আরবি ‘ওয়াও’ হরফের বাংলা উচ্চারণ হয় ‘ব’। ‘অহি’র বাংলা উচ্চারণ হয় ‘বহি’। ধীরে ধীরে ভাষার পরিবর্তনে ‘বহি’টি ‘বই’ রূপ ধারণ করেছে। মানে অহি থেকে বহি; বহি থেকে বই। সাধু বাংলায় বহি, চলিত বাংলায় বই। এভাবে বইয়ের সঙ্গে অহির জ্ঞানের একটা সম্পর্ক রয়েছে। আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে প্রেরিত ‘অহি’ পবিত্র কোরআনের প্রথম পাঁচ আয়াতই হচ্ছে পাঠ করা কিংবা জ্ঞানার্জন সম্পর্কে। আল্লাহ বলেন, ‘পড়ুন আপনার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন...’ (সুরা আলাক)। এর মধ্যে প্রথম বাণীটিই হলো ‘ইকরা-পড়ো’। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনের অন্তত ৯২ জায়গায় জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার প্রসঙ্গ এনেছেন। ‘কোরআন’ শব্দটির একটি অর্থও ‘অধ্যয়ন’।

জ্ঞান মর্যাদার বাহন। যে যত জ্ঞান অর্জন করবে, মানব সমাজে সে তত মর্যাদাবান হবে। আল্লাহ জ্ঞানের সঙ্গে মানুষের মর্যাদা সম্পর্কিত করেছেন সৃষ্টির শুরুতেই। যারা জ্ঞান অর্জন করে আল্লাহ তাদের মর্যাদা সমুন্নত করে দেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা ইমান এনেছে এবং যাদের জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদের মর্যাদা সমুন্নত করবেন। আর তোমরা যা করো আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্যক অবহিত।’ (সুরা মুজাদালাহ : ১১)। জ্ঞান অন্বেষণ করা এতই মর্যাদাপূর্ণ যে, ইসলামী জ্ঞান অন্বেষণকারীর জন্য আকাশ ও জমিনের সবকিছুই ক্ষমা প্রার্থনা করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘দ্বীনি জ্ঞান অন্বেষণকারীর জন্য জগতের সবকিছুই (আল্লাহতায়ালার দরবারে) ক্ষমা প্রার্থনা করে। এমনকি পানির মাছও। (আবু দাউদ, তিরমিজি)। ইমাম বুখারি (রহ.) বলেন, কোনো বিষয়ে কিছু বলা এবং আমল করার আগে সে বিষয়ে জ্ঞানার্জন করা প্রয়োজন। কেননা আল্লাহতায়ালা সুরা মুহাম্মদের ১৯ নম্বর আয়াতে বলেন, ‘আর জেনে নাও, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই।’ এখানে ‘জেনে নাও’ দ্বারা আল্লাহতায়ালা ‘জ্ঞানার্জন’ বুঝিয়েছেন। আর এ গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান অর্জিত হয় বই পাঠের মাধ্যমে।

পার্থিব জীবনযাত্রার প্রয়োজনীয় ও কল্যাণকর জ্ঞান অর্জনও ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে কাম্য। যেমন চিকিৎসা, গণিত, কৃষি, রাষ্ট্রনীতি, বিজ্ঞান, দর্শন ইত্যাদি। গোটা জনপদে যদি এ জ্ঞানের পারদর্শী কেউ না থাকে, তাহলে সবাই কষ্টে পতিত হবে। পক্ষান্তরে যে জ্ঞান মানুষকে অকল্যাণের দিকে নিয়ে যায়, তা চর্চা করা হারাম। যেমন ইসলামবিরোধী প্রাচীন ও আধুনিক দর্শন, কুফরি সাহিত্য ইত্যাদি। তদ্রূপ অকল্যাণকর ও অপ্রয়োজনীয় বিষয় চর্চা করাও নিষিদ্ধ। (ইহইয়াউ উলুমিদ্দীন: ১/২৯-৩০)। বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) জাগতিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না বটে, তবে জাগতিক শিক্ষাকে তিনি বাতিল করে দেননি। ইসলাম হলো সবচেয়ে আধুনিক ধর্ম। এ ধর্মে গোঁড়ামি, অজ্ঞতা, কুসংস্কারের কোনো স্থান নেই। ইমানকে মজবুত করতে যে চায়, সে যেন বই পড়ে। কারণ বই পড়লে চিন্তাশক্তি বাড়ে। আল্লাহর নেয়ামত নিয়ে সেই বেশি ভাবতে পারবে। সৃষ্টিকর্তার জন্য নতজানু হতে পারবে। কোরআনে আল্লাহ কী বলেছেন, হাদিসে রাসুল (সা.) কী বলেছেন, তা না জানার চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে? মাঝেমধ্যে পরিবার নিয়ে বইমেলা ও বইয়ের দোকানে যাওয়া যেতে পারে। কোরআন, হাদিস ও উপকারী জ্ঞানের বিপুল সমারোহে ঘুরে এলে জ্ঞানচর্চা ও বই পাঠের প্রতি আগ্রহ তৈরি হবে। মানুষ যা দেখে, তার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়। ছেলেমেয়েরা উপকারী বইয়ের সঙ্গে পরিচিত হবে। বোখারি, মুসলিম, সাহাবি-তাবেয়িদের জীবনী পড়বে। ভালো-মন্দের পার্থক্য বুঝতে পারবে। জীবন সাজানোর প্রেরণা পাবে।

জ্ঞান অর্জনের বিভিন্ন মাধ্যম আছে। সবচেয়ে সহজ মাধ্যম হলো বই পড়া। প্রশ্ন হলো, এই বইটা কীসের হবে। দুনিয়াবি না কোরআন-হাদিসবিষয়ক ইসলামী পুস্তক। দুনিয়ার যা কিছু ভালো, সে বিষয়ে জ্ঞান অর্জনে দোষ নেই। যেমন চিকিৎসাবিষয়ক বই পড়া; গল্প-উপন্যাসও যদি ভালো কাহিনি হয়, নৈতিক শিক্ষা থাকে, খারাপ দিকে উৎসাহিত না করে, তাহলে তা পড়তে অসুবিধা কোথায়? বই বলতে শুধু ইসলামী বই নয়। অন্য সব বই পড়া অন্যায় নয়। তবে সবকিছু হতে হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। লোকদেখানো উদ্দেশ্য হলে সব বরবাদ হবে। মানুষ বলবে—সে খুব জ্ঞানী, বাহবা দেবে, এমন উদ্দেশ্যে থাকলে তার পরিণতি জাহান্নাম। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি দুনিয়াবি স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে ইলম শিখল, যা শুধু আল্লাহর জন্যই শিখতে হয়, সে কেয়ামতের দিন জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না।’ (আবু দাউদ : ৩৬৬৪)। জ্ঞান অর্জন শুধু পুরুষ করবে, তাও নয়। নারী-পুরুষ সবাইকে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। ইসলামে এ ক্ষেত্রে কোনো ভেদাভেদ নেই।

এই মহাবিশ্ব ও পৃথিবীর ভৌগোলিক অবস্থান, ইতিহাস ও সভ্যতা, বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কার, জ্ঞানী ব্যক্তিদের চিন্তাধারা ও জীবন দর্শন ইত্যাদি আমরা বই পড়ার মাধ্যমেই জানতে পারি। ধর্ম, দর্শন, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, অর্থনীতি, রাজনীতি এমন যে কোনো বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে হলে নিয়মিত বই পড়তে হয়। বই পড়ার মাধ্যমে জ্ঞানের পরিধি বাড়ে। মস্তিষ্ককে সচল রাখা যায়। মানসিক উদ্দীপনা বাড়ে। মানসিক চাপ কমিয়ে প্রশান্তি ফিরিয়ে আনে। শব্দভান্ডার তৈরিতে সাহায্য করে। স্মৃতিকে শক্তিশালী ও উন্নত করে। পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা বাড়ে। কল্পনাশক্তি ও সৃজনশীলতা বাড়ে। নতুন বিষয় জানা ও আবিষ্কার করা যায়। উন্নত মানুষ গঠনে সহায়তা করে। বই তার পাঠককে পৃথিবীর সঙ্গে যুক্ত করে দেয়। ভবিষ্যতের উত্তম কর্ম নির্ণয় করা যায়। মনকে সুস্থ ও প্রফুল্ল রাখা যায়। ইতিহাস-পাঠ মানুষকে জ্ঞানী করে, কবিতা-পাঠ বুদ্ধিদীপ্ত করে, গণিতচর্চা যুক্তিবোধকে শানিত করে, প্রাকৃতিক দর্শন নৈতিকতার ভিত্তি সুদৃঢ় করে। মোটকথা জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। ভাষা ও বইয়ের মাসে এই হোক আমাদের প্রত্যয়—আমরা বই ভালোবাসব, বই কিনব, বই উপহার দেব এবং প্রত্যহ নিয়ম করে বই পাঠ করব।

লেখক: মুহাদ্দিস ও ইসলামী চিন্তাবিদ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের পর ভিডিও ধারণ, আটক ২

হত্যা মামলায় বৃদ্ধের যাবজ্জীবন

বগুড়ায় স্ত্রী হত্যায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি গাজীপুরে গ্রেপ্তার

মতলব উত্তরের যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক নোমান বহিষ্কার

গরম নিয়ে আবহাওয়া অফিসের নতুন বার্তা

সরকারি গাছ কেটে মামলা খেলেন বিএনপি নেতা!

নাটোরে শিক্ষার্থীকে অপহরণ করে ধর্ষণ, যুবকের যাবজ্জীবন

এসএসসিতে পাশের খবরেও কাঁদছেন মুরাদের বাবা-মা

বগুড়ায় রিটার্নিং কর্মকর্তার ওপরে চটলেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী সফিক

বিয়ের ৫ মাস পর দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে যুবক খুন

১০

চবিতে বহিরাগতদের মোটরসাইকেল প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা

১১

যৌতুক না পেয়ে স্ত্রীকে নির্যাতন, কারাগারে স্বামী

১২

আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে আ.লীগ নেতাকে জরিমানা

১৩

ফুফাতো ভাইয়ের ছুরিকাঘাতে মামাতো ভাই খুন

১৪

গভর্নরের সঙ্গে পিটার হাসের ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক 

১৫

হাসপাতালে লিফটে আটকে রোগী মৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত কমিটির কাজ শুরু

১৬

সর্বজনীন পেনশন স্কিম ‘প্রত্যয়’ বাতিলের দাবি

১৭

উন্নয়নের নামে নিধন হচ্ছে বনায়ন, কাটা পড়বে ১৫ হাজার গাছ

১৮

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মার্ট এনআইডির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ২৩ মে

১৯

বাগেরহাটে ছুরিকাঘাতে যুবক খুন

২০
X