দুনিয়ায় কিছু কিছু জায়গা থাকে, যা মানচিত্রে ছোট, কিন্তু বিশ্বরাজনীতির ছায়াপথে বিশাল। সাম্প্রতিক সংঘাতে ইরান সেদিন ইসরায়েলের ছোট্ট একটি শহরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করে। নাম নেস জিওনা। যুক্তরাষ্ট্রের ইরানে হামলার কারণে বিষয়টি মিডিয়ায় ব্যাপক আকারে আসেনি। খবর কেবল-ইসরাইলের ‘একটি বৈজ্ঞানিক ভবন’ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
অথচ ল্যাবরেটরিটি ইসরায়েলের দম্ভের অন্যতম প্রতীক। দেশটি সৃষ্টির পর থেকে কোটি কোটি ডলার ইনভেস্ট করেছে এই ল্যাবরেটরিকে কেন্দ্র করে।
নেস জিওনার এই ল্যাবরেটরি স্বাভাবিক কোনো গবেষণাকেন্দ্র নয়, এটি একটি গোপন ল্যাব। যার নাম Israel Institute for Biological Research (IIBR)। বাইরে থেকে ইসরায়েলি নাগরিকদের কাছেও ভবনটি ছিল নিঃশব্দ, নিস্তরঙ্গ, আর ভিতরে? সেখানে বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে ভাইরাস দিয়ে যুদ্ধের ছক আঁকার প্রস্তুতি।
১৯৫২ সাল। দখলদার ইসরায়েল রাষ্ট্রটি মাত্র হাঁটতে শিখেছে। ভবিষ্যৎ পৃথিবী নিয়ন্ত্রণের অভিপ্রায়ে ঠিক তখনই গোপন সামরিক ইউনিট HEMED BEIT-এর ছায়া থেকে জন্ম নেয় এই প্রতিষ্ঠান- একটি জৈবিক নিরাপত্তা ঘাঁটি।
উদ্দেশ্য ছিল একটাই- ইসরায়েলকে এমন এক সুরক্ষা বলয় দেওয়া, যা শত্রুর চোখ এড়িয়ে তাদের শ্বাসরোধ করে দিতে পারে। Anthrax, Botulinum toxin, Ricin, VX nerve gas- এসব প্রাণঘাতী উপাদান নিয়ে গবেষণার অভিযোগ বহুবার উঠেছে। যদিও ইসরায়েল কখনো স্বীকার বা অস্বীকার করেনি। তবে ১৯৯২ সালের সেই El Al বিমানের রহস্যজনক ‘DMMP রাসায়নিক’ বহনের ঘটনা ব্যাপক প্রশ্নের মুখে পড়ে IIBR-এর গবেষণা। তবে বৈশ্বিক মিত্রদের কারণে সেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা একসময় থেমে যায়। বটুলিনাম টক্সিনসহ বিভিন্ন বিষয়ে ট্রায়ালের সংবাদও প্রকাশিত হয়েছিল গণমাধ্যমে। তবে এই প্রতিষ্ঠানটির বিষয়ে ইসরায়েলি সরকার এবং শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ব্যতীত বাকিরা তেমন কিছু জানেন না। বৈশ্বিক মিডিয়া কিংবা স্টেকদের এই গবেষণা কেন্দ্র সম্পর্কে তেমন কিছু জানতে দেওয়া হয় না।
গবেষণা কেন্দ্রটিতে প্রায় চারশ কর্মী কাজ করে, যাদের মধ্যে অর্ধেক PhD-ধারী বিজ্ঞানী এবং বাকিরা প্রযুক্তিবিদ। ১৯৯০-এর দশকে Scud missile strikes-এর হুমকির পর থেকে ইসরায়েলি সরকার গবেষণাকেন্দ্রটি আরও সুরক্ষাবলয়ে নিয়ে আসে। এর পিছনে ব্যয় করেন বিপুল পরিমাণ অর্থ। সামরিক গবেষণায় প্রায় অর্ধেকেরও বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয় এই প্রতিষ্ঠানকে।
এখানে তৈরি হয়েছে পোলিও ভ্যাকসিন, বিস্ফোরক শনাক্তকরণ কিট, এমনকি Sjögren’s সিনড্রোমের ওষুধও। করোনা মহামারির সময় তারা এক ধাক্কায় সামনে চলে আসে-“BriLife” নামের নিজস্ব ভ্যাকসিন উদ্ভাবন করে। তারা আবিষ্কার করে মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি, যা ভাইরাসকে ল্যাবেই আটকে ফেলে।
কিন্তু এই গবেষণাগার ছিল ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় গোপন অস্ত্রভাণ্ডার। যে যুদ্ধ এখনো শুরু হয়নি, সেই আগামীর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল তারা- জৈব অস্ত্র, রাসায়নিক প্রতিরক্ষা, টার্গেটেড ভাইরাল স্ট্রাইক- সবকিছুই ছিল ভবিষ্যতের যুদ্ধের নীলনকশায়।
আর সেই স্থাপনাতেই সম্প্রতি আঘাত হেনেছে ইরানের একটি মিসাইল। বহু বছরের গোপন গবেষণা, কোটি কোটি ডলারের অবকাঠামো, আর শত শত বৈজ্ঞানিকের ক্লান্তিহীন পরিশ্রম- এক নিমিষে ধ্বংস হয়ে গেছে। এটা ছিল শুধু একটি ভবনের পতন নয়; এটা ইসরায়েলের এক অদৃশ্য সুরক্ষা বলয়ের ধ্বংস।
তথ্যসূত্র : এপি
মন্তব্য করুন