প্রভাষ আমিন
প্রকাশ : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০২:৫৪ এএম
আপডেট : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৭:১৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ধর্মকে কঠিন করে তুলবেন না

ধর্মকে কঠিন করে তুলবেন না

মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুটি—ঈদুল ফিতর আর ঈদুল আজহা। এক মাসের সিয়াম সাধনা শেষে আসে ঈদুল ফিতর। আর ঈদুল আজহা আসে ত্যাগের মহিমা নিয়ে। ইসলামে তিনটি মহিমান্বিত রাত আছে—শবেবরাত, শবেকদর, শবেমেরাজ। আমরা ছেলেবেলায় এ তিনটি রাতকেও উৎসব বানিয়ে ফেলতাম। মায়ের কড়া শাসনের বেড়া ডিঙিয়ে এ তিনটি রাত আসত আমাদের জন্য স্বাধীনতার বারতা নিয়ে। রাতভর বাইরে থাকার স্বাধীনতাটাই আমাদের কাছে অনেক বড় পাওয়া ছিল। রাতভর মসজিদে ইবাদত তো আছেই, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা ছিল বাড়তি পাওনা। অস্বীকার করব না, এ স্বাধীনতার সুবাদে কারও গাছের ফল, কারও বাগানের ফুল চুরিটাও বাদ যেত না। তবে আমাদের ছেলেবেলাটা রঙিন করে রেখেছে শবেবরাত। মুসলমানদের বিশ্বাস, মহিমান্বিত এ রাতে আল্লাহ মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করেন। শবেবরাতকে সৌভাগ্যের রজনীও বলা হয়।

ধর্মে কী আছে, পুরোপুরি জানি না, তবে ছেলেবেলায় শবেবরাতকে আমরা পালন করতাম উৎসবমুখর পরিবেশে। এ অঞ্চলের মুসলমানরা শবেবরাতে বিশেষ খাবার রান্না করে। বিশেষ করে হালুয়া, চালের রুটি, মাংস ছিল শবেবরাতের বিশেষ খাবার। শুধু নিজের পরিবারের জন্য নয়, বিশেষ এ খাবার আত্মীয়স্বজন-প্রতিবেশীদের মধ্যে বিলি করা হতো। দিনভর রান্না হতো। সন্ধ্যার পর আমাদের দায়িত্ব ছিল প্লেটে করে খাবার নিয়ে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়া। আবার অন্য বাড়ির খাবারও আসত আমাদের বাড়িতে। কার হালুয়া বেশি স্বাদ, কার বাড়ির মাংস বেশি মজা; তা নিয়ে গোপন একটা প্রতিযোগিতাও চলত।

দিনভর মা-চাচিদের রান্নার প্রস্তুতির পাশাপাশি আমরাও তৈরি হতাম রাতভর আয়োজনের জন্য। শবেবরাতের মূল আয়োজন হতো সন্ধ্যার পর। প্রথমে আমরা দাদার কবর জিয়ারত করতে যেতাম। তারপর যেতাম পুকুরে গোসল করতে। বছরে একবারই রাতে গোসল করা হতো, সেটা বরাতের রাতে। তখনো শ্যাম্পু চেনা হয়নি আমাদের। তবে সাবান দিয়ে পরিষ্কার গোসল করে সম্ভব হলে নতুন, নইলে পরিষ্কার কাপড় পরে মসজিদে যেতাম। আলোকসজ্জা ছিল শবেবরাতের আরেকটি অবশ্য অনুষঙ্গ। আমরা কলাগাছের বাকল ছোট ছোট করে কেটে ভেলা বানিয়ে তাতে মোমবাতি জ্বালিয়ে পুকুরে ভাসিয়ে দিতাম। সবাই মিলে কয়েকশ মোমবাতি ভাসিয়ে দিলে পুরো পুকুর ঝলমল করে উঠত। কার মোমবাতি বেশিক্ষণ জ্বলত, সেটাও একটা প্রতিযোগিতা ছিল। কারও মোমবাতি কাত হয়ে পড়ে গেলে তার মন খারাপ হয়ে যেত। চট্টগ্রামের মুরাদপুরে কোয়ার্টারে থাকার সময় সিঁড়ির দুই পাশে মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখতাম। সীমিত সামর্থ্যের সেই আলোকসজ্জাই আমাদের ছেলেবেলাকে আলো ঝলমলে করে রেখেছে। তখন মোবাইল ছিল না, ক্যামেরা ছিল না। কিন্তু আমাদের স্মৃতিতে ধরা আছে, সেই আলোকোজ্জ্বল দিনগুলো। আমরা সারা বছর অপেক্ষা করতাম, কবে আসবে শবেবরাত। সত্যি বলতে, পেছনে ফিরে তাকালে মনে হয়, ঈদের চেয়েও বেশি আনন্দের স্মৃতি আমাদের শবেবরাতকে ঘিরে।

ঢাকায় আসার পর শবেবরাতের উৎসবে দেখলাম আতশবাজিও। তবে সরকারের নানা চেষ্টায় ঝুঁকিপূর্ণ আতশবাজি বন্ধ করা গেছে। তবে ইদানীং দেখছি শবেবরাতকেই বেদাত বলছেন ধর্মীয় পণ্ডিতদের কেউ কেউ। আতশবাজি তো হারিয়েছে অনেক আগেই। এখন দেখি শবেবরাতেরই হারিয়ে যাওয়ার দশা। এক হুজুর দেখলাম শবেবরাতে মসজিদে যাওয়ার চেয়ে বেশ্যাখানায় যাওয়াকে ভালো বলছেন। ধর্মের ব্যাখ্যাটা ভালো জানি না। কিন্তু শবেবরাতে তো কাউকে খারাপ কিছু করতে দেখিনি কখনো। ভালো রান্না করে সবাই মিলেমিশে খাওয়া, গোসল করা, আনন্দ করা, পূর্বসূরিদের কবর জিয়ারত করা, রাতভর নফল নামাজ পড়া—এর মধ্যে কোন অংশটা খারাপ বা বেদাত? ধরে নিলাম ইসলামে শবেবরাতের কথা নেই। শবেবরাত থাকুক না থাকুক; সবাইকে নিয়ে ভালো খাওয়া, কবর জিয়ারত করা, গোসল করা, নামাজ পড়লে সমস্যা কোথায়?

১৪০০ বছর আগে আরবে হজরত মোহাম্মদ (স.)-এর হাত ধরে ইসলাম আসে। আরব থেকে সেই ইসলামের আলো ছড়িয়েছে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তরে। ছড়িয়েছে, কারণ ইসলাম গেছে ভালোবাসার বাণী নিয়ে, শান্তির বারতা নিয়ে। পশ্চিমারা শান্তির ধর্ম ইসলামকে আজ সন্ত্রাস আর জঙ্গিবাদের সমার্থক বানিয়ে ফেলেছে। তবে এর দায় মুসলমানদের কাউকে কাউকে নিতেও হবে। ইসলামের নামে হত্যা, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ তো হয়েছে, হচ্ছে; এটা তো অস্বীকার করা যাবে না। এই বাংলাদেশেও সুন্নি ঘরানার সহজ-সাধারণ ইসলামকে আজ কঠিন করে ফেলছেন কেউ কেউ। ভালোবাসার বাণী নিয়ে যে ইসলামের বিকাশ, সেই ইসলামের নামে আজ ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে। অন্য ধর্মের কথা বাদ দিন। ইসলামের শত্রু তো মুসলমানরাই। সুন্নি-শিয়া-কাদিয়ানির মতো বড় বিভেদ তো আছেই; আছে ছোট ছোট নানা বিভেদও। কেউ শবেবরাত পালন করে, কেউ করে না। কেউ মাজারে যায়, কেউ যায় না। কেউ চাঁদ দেখে ঈদ পালন করেন, কেউ সৌদি আরবের সঙ্গে মিলিয়ে পালন করেন। কেউ মহররমে কারবালার ঘটনায় শোক করে, কেউ করে না। কেউ ঈদে মিলাদুন্নবী ঘটা করে পালন করে, কেউ করে না। কেউ হজরত মোহাম্মদ (স.)-কে মাটির তৈরি মানুষ মনে করে, কেউ মনে করে অতিমানব। কেউ মিলাদ পড়ে, কেউ পড়ে না। কেউ তাবলিগ জামাতে বিশ্বাস করে, কেউ করে না। আবার ইদানীং তাবলিগ জামাতেও নানা বিভেদ, যা সহিংসতা পর্যন্ত গড়ায়। এমনকি নামাজে দাঁড়ালে হাত নাভির ওপরে থাকবে না নিচে, নামাজ শেষে মোনাজাত হবে কি হবে না; বিরোধ আছে তা নিয়েও। যত বিরোধই থাকুক; আমরা যদি যার যার বিশ্বাসকে সম্মান করতাম; তাহলেও অসুবিধা ছিল না। কিন্তু নিজের বিশ্বাসের বাইরের মানুষকে আমরা বেদাত, নাস্তিক, মুরতাদ, অমুসলিম ঘোষণা করে দিই। ঘোষণাতেই থেমে থাকি না। সুযোগ পেলেই হামলা করি, কল্লা কেটে ফেলি। এত ঘৃণা-বিদ্বেষ অন্তরে নিয়ে আর যাই হোক, ভালো মুসলমান হওয়া যায় না।

ইসলাম শুধু নয়, পৃথিবীতে সব ধর্মই এসেছে মানুষের জীবনকে শৃঙ্খলায় আনতে, ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে। কিন্তু ধর্ম আমাদের জীবনে শৃঙ্খলা আনার বদলে আমাদের শৃঙ্খলিত করে ফেলছে। সারাক্ষণ এটা করা যাবে না, সেটা করা যাবে না—লম্বা তালিকা। সারাক্ষণ এই ‘না’-এর তালিকা মাথায় নিয়ে জীবনযাপন করা মুশকিল। ধর্মীয় আলেমদের প্রতি বিনীত অনুরোধ, আপনারা ধর্মকে কঠিন করে তুলবেন না, মানুষকে ভয় দেখাবেন না। ইসলাম ধর্মের যে সহজ, সাধারণ ছবি সেটাই যেন মানুষের মনে থাকে। ইসলামের নামে নারীদের আটকে রাখার চেষ্টা হয়। তাদের পড়ালেখা, পেশায় বাধা দেওয়া হয়। অথচ হজরত মোহাম্মদ (স.)-এর প্রথম স্ত্রী বিবি খাদিজা (আ.) একজন ব্যবসায়ী ছিলেন।

একজন সাধারণ নিষ্ঠাবান মুসলমান ইমান আনবে, নামাজ পড়বে, রোজা রাখবে, সামর্থ্য হলে হজ করবে, জাকাত দেবে। আর মিথ্যা কথা বলবে না, মানুষের ক্ষতি করবে না, মানুষকে ভালোবাসবে। সমস্যা হলো, ধর্মীয় আলেমরা ইসলাম ধর্মকে ভয়ংকর কঠিন ধর্ম হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করেন। কেউ ইসলাম নিয়ে কোনো কথা বললেই তারা তেড়ে আসেন। তারা চান ধর্মটা থাকবে তাদের নিয়ন্ত্রণে আর সাধারণ ধর্মভীরু মানুষকে তারা ভয় দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণ করবেন। যাতে তাদের ধর্ম ব্যবসাটা নির্বিঘ্নে চালাতে পারেন। এ ভয়টাই দূর করতে হবে। ধর্মের চর্চা করতে হবে প্রতিদিনের জীবনযাপনে। ভয় পেতে হবে আল্লাহকে, ধর্ম ব্যবসায়ীদের সৃষ্টি করা ভয়ের দুর্গ ভেঙে ফেলতে হবে।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

‘নারী মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গণ্য হবে’

৫৭ বছরে এসএসসি পাস, চিকিৎসক হতে চান পুলিশ সদস্য

আমেরিকার বুকে কাঁপুনি ধরানো ইরানের ৯ ক্ষেপণাস্ত্র

কাজে তারা জনবিদ্বেষী, হতে চান জনপ্রতিনিধি

জারি ছিল গ্রেপ্তারি পরোয়ানা / রাফসান দ্য ছোট ভাইয়ের মা-বাবার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ

তাপপ্রবাহ নিয়ে ফের দুঃসংবাদ

‘কেএনএফের কার্যক্রম যতদিন থাকবে, যৌথবাহিনীর অভিযান ততদিন চলবে’

ডাম্বুলার বিদেশি আইকন মোস্তাফিজ 

কুতুবদিয়ায় পৌঁছেছে এমভি আবদুল্লাহ

বাজেট নিয়ে সিপিবির আলোচনা ১৫ মে 

১০

শাহবাগ থানায় গাড়ির ডাম্পিংয়ে আগুন

১১

‘দক্ষ নারীকর্মীদের বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিতে কাজ করা হচ্ছে’ 

১২

এসিআইয়ে ম্যানেজার পদে চাকরি, আবেদনের বয়স ৩৪-৪২ বছর

১৩

‘তথ্যপ্রযুক্তিতে ফ্রান্সের সঙ্গে নতুন ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে’

১৪

এনএসআই পরিচয়ে ভুয়া নিয়োগ, হাতিয়ে নিয়েছে লাখ টাকা

১৫

যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়েছে তাসকিনের মেডিকেল রিপোর্ট

১৬

রাজধানীতে পুষ্টি ডেইরি ফার্ম বন্ধ ঘোষণা

১৭

আগ্নেয়গিরি থেকে হচ্ছে সোনার বৃষ্টি

১৮

অস্ত্র ও মাদকসহ যুবলীগ নেতা গ্রেপ্তার

১৯

বন্ধুকে সহযোগিতা করতে গিয়ে ফাঁসলেন আল্লু অর্জুন

২০
X