জাকির হোসেন
প্রকাশ : ১৭ মার্চ ২০২৪, ০১:৪৭ এএম
আপডেট : ১৭ মার্চ ২০২৪, ০৯:১৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধুর প্রথম জন্মদিনে এসেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী

স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধুর প্রথম জন্মদিনে এসেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী

স্বাধীন দেশে ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ ছিল বঙ্গবন্ধুর ৫৩তম জন্মদিন। স্বাধীন বাংলাদেশে তার প্রথম জন্মদিন। এদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে বাংলাদেশ সফরে আসেন।

ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন আমাদের উষ্ণ হৃদয় বন্ধু, আমাদের স্বজন, আমাদের কাছের মানুষ। যেমন ভৌগোলিক দিক থেকে তেমনি আত্মিক দিক থেকেও। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি ক্ষমতাসীন ছিলেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর এ দেশের প্রথম রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে এসেছিলেন ঢাকায়। বক্তব্য রেখেছিলেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, যেখানে আত্মসমর্পণ করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। সে সময় অনেকেই তাকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন, সামনাসামনি। সে এক দুর্লভ ঘটনা। অনেকেই এ ঘটনার সাক্ষী হয়েছেন।

১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ সকাল সাড়ে ১০টায় ইন্দিরা গান্ধীকে বহনকারী ভারতীয় বিমানবাহিনীর উড়োজাহাজ ‘রাজহংস’ ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করে। বিমানটির গায়ে ভারতের তেরঙ্গার পাশে ছিল বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা।

বিমানটির অবতরণ উপলক্ষে বাংলাদেশের একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটিতে দুপুর পর্যন্ত সব ধরনের বিমান ওঠানামা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ওই বিমানটিতে ছিলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বেগম মুজিব। ইন্দিরা গান্ধী তার প্রথম বাংলাদেশ সফরের জন্য দারুণ একটি দিন বেছে নিয়েছিলেন। সেদিন শ্রীমতী গান্ধী ৫৫ কোটি ভারতবাসীর পক্ষ থেকে ফলমূল ও মিষ্টান্ন উপহার দিয়ে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের আয়োজনকে দিয়েছিলেন ভিন্নমাত্রা। বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫৩তম জন্মদিন উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বঙ্গবন্ধুর ৫৩তম জন্মদিন উদযাপন উপলক্ষে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক, অর্থমন্ত্রী এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রদত্ত এক বিবৃতিতে লেখেন, ‘আজ ১৭ই মার্চ। মহান বাঙালি জাতির পিতা শেখ মুজিবের জন্মদিন। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের কণ্ঠে আজ একটি মাত্র স্লোগান—জয়তু মুজিব! আর এই স্লোগানের মুহুর্মুহু ধ্বনির প্রতিধ্বনি মহান নেতার জন্মতিথিতে তাহাকে জানাইতেছে স্বাধীন দেশের প্রতিটি নাগরিকের হৃদয় উজাড় করা শ্রদ্ধার্ঘ্য, প্রীতি, শুভেচ্ছা, আশিস, আর ভালোবাসা। কামনা তাহাদের একটিই—মুজিব, তুমি দীর্ঘজীবী হও!’

দিনটিতে বাংলাদেশে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল এবং বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট করে জানিয়েছিলেন, এ ছুটি ইন্দিরা গান্ধীর বাংলাদেশ আগমন উপলক্ষে। বঙ্গবন্ধুর একটি বক্তব্যের বরাত দিয়ে ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ‘ভবিষ্যতে তাহার জন্মদিন আর সরকারি ছুটির দিন হিসেবে উদযাপিত হইবে না। এই দিনটি কঠোর শ্রম ও বৃহত্তর কল্যাণে আত্মনিয়োগের দিন হিসেবে পালিত হইবে।’ তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে নবগঠিত বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে ইন্দিরা গান্ধী সরাসরি যান বঙ্গভবনে। তখন বঙ্গভবন রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সরকারি বাসভবন। সফরের পরবর্তী তিন দিন ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গভবনেই ছিলেন।

ইন্দিরা গান্ধীর সফর উপলক্ষে বঙ্গভবনকে নতুন রূপে সাজানো হয়েছিল। অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জার জন্য কলকাতা থেকে স্বনামধন্য ইন্টেরিয়র ডিজাইনার আলোকা চৌধুরীকে আনা হয়েছিল। আলোকা চৌধুরী ছিলেন জনপ্রিয় চিত্রনায়ক বসন্ত চৌধুরীর স্ত্রী। দিন-রাত পরিশ্রম করে তিনি বঙ্গভবন সাজিয়ে ছিলেন।

১৭ মার্চ দুপুর ৩টায় ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটি জনসভায় যোগ দেন ইন্দিরা গান্ধী। জনসভা উপলক্ষে উদ্যানের এক পাশে নৌকার আকারে বিশাল মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল। আর এ মঞ্চের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ইন্দিরা মঞ্চ’। জনসভায় ইন্দিরা গান্ধী প্রথম দুই মিনিট বাংলাতেই ভাষণ দেন। এরপর বাংলায় দীর্ঘ বক্তৃতাদানে অক্ষমতার জন্য ক্ষমা চেয়ে হিন্দিতে বলতে শুরু করেন। তবে একপর্যায়ে রবীন্দ্রনাথের একটি বাংলা গান থেকে একটি লাইন তিনি উদ্ধৃত করেন ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’। সেদিনের সেই জনসভায় উপস্থিত মানুষের মধ্যে শুধু নারীদের সংখ্যাই ছিল অর্ধলক্ষাধিক। ইন্দিরা গান্ধীর ওই সফরেই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি ২৫ বছরমেয়াদি দীর্ঘ ‘মৈত্রী ও সহযোগিতা’ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৮ মার্চ হয়েছিল শীতলক্ষ্যায় নৌবিহার। ৩০ মিনিটের সেই নৌবিহারে দুই শীর্ষ নেতার বৈঠক হয়েছিল। এর আগে ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে বঙ্গবন্ধু দুদিনের সফরে কলকাতা গিয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রনেতা হিসেবে এটা ছিল তার প্রথম সরকারি সফর। ওই সময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে দিল্লি থেকে কলকাতা উড়ে এসেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। কলকাতার রাজ ভবনে দুজনের যে সাক্ষাৎ হয়েছিল, সেখানেই ইন্দিরা গান্ধীকে ফিরতি সফরের দাওয়াত দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এ সফরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্যদের প্রত্যাহারের ব্যাপারে বিশেষভাবে জোর দিয়েছিলেন।

দৈনিক ইত্তেফাকে ১৯৭২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত খবর কলকাতার রাজ ভবনে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর বৈঠক। এটা ছিল সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ মুজিবের প্রথম বিদেশ সফর।

সফরের দ্বিতীয় দিনে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনার পর যুক্ত ইশতেহারে সরকারি ঘোষণা করা হয়, ‘২৫শে মার্চ ১৯৭২ সালের মধ্যে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার সমাপ্ত করা হবে।’ কিন্তু বাস্তবে এই সৈন্য প্রত্যাহার শেষ হয় তারও দুই সপ্তাহ আগে, ইন্দিরা গান্ধীর প্রথম বাংলাদেশ সফরে আসার পাঁচ দিন আগেই।

১৯৭৫ সালের ১৭ মার্চ ছিল বঙ্গবন্ধুর ৫৫তম জন্মবার্ষিকী। সেটিই তার জীবদ্দশায় শেষ জন্মদিন। এই দিন সম্পর্কে ১৮ মার্চ তারিখে ইত্তেফাকে প্রকাশিত খবর ছিল এরকম—“জন্মদিনে নেতাকে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য তাহার বাসভবন অভিমুখে ছিল জনতার স্রোত। বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে কমপক্ষে ৫০ হাজার লোকের সমাগম হয়। নেতা ও জনতার সম্মিলনে কোনো বাধা ছিল না। ভোর সাড়ে ৬টা হইতে ৩২নং রোডের বাসভবনে নেতার সাক্ষাৎপ্রার্থীর ভিড় শুরু হয়। কেহ ফুলের মালা, পুষ্পস্তবক, কেহবা জন্মদিনের কেক, মিষ্টিসহ বিভিন্ন উপহার সামগ্রী লইয়া জাতির জনকের বাসভবনে উপস্থিত হন, শুভেচ্ছা জানান, মঙ্গল কামনা করেন। বঙ্গবন্ধু প্রফুল্লচিত্তে আগতদের সবাইকেই সাক্ষাৎদান করেন ও শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। সকাল ৭টা হইতে সোয়া ১১টা পর্যন্ত ৪ ঘণ্টাধিককাল ধরিয়া তিনি শুভার্থীদের সাক্ষাৎদান করেন। বাকশাল, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নসহ বিভিন্ন সংস্থা আসিয়াছিল মিছিলসহকারে, দলবদ্ধভাবে।... বঙ্গবন্ধু পুষ্পমাল্যগুলি পাঠাইয়া দেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা, মরহুম তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক ও ভাষা আন্দোলনের শহীদদের মাজারে, শহীদ মিনারে এবং সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে। বঙ্গবন্ধু আগত সকলকেই দেশ গঠনে কঠোর পরিশ্রম করার উপদেশ দেন। সকাল ১১টার দিকে বঙ্গবন্ধু সমবেত সকলের উদ্দেশে বলেন, ‘আমার জন্মদিনে আমি ছুটি ঘোষণা করি নাই। তাই আজ আমি অফিসে যাইব, অল্পক্ষণের জন্য হইলেও অফিসের কাজ করিব।’ উপস্থিত সকলকে তিনি নিজ নিজ অফিসে যাওয়ার নির্দেশ দেন। সকাল প্রায় সোয়া ১১টার সময় বঙ্গবন্ধু গণভবনের উদ্দেশে বাসভবন ত্যাগ করেন।”

লেখক: সাংবাদিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

৫০ জনকে নিয়োগ দেবে মধুমতি ব্যাংক, থাকছে না বয়সসীমা

পদত্যাগ করতে পারেন ইসরায়েল সামরিক বাহিনীর প্রধান

কুমিল্লায় পানিতে ডুবে তিন দিনে ৮ শিশুর মৃত্যু

যানজটে স্কুটারে বসে অফিস করছেন নারী, ভিডিও ভাইরাল

মরুর বুকে উত্তাপ ছড়ালেন অধরা খান

তানিন সুবহার ‘রসের হাঁড়ি বাড়াবাড়ি’

শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারী নেবে কুয়েট, পদসংখ্যা ৬৪

চবি শিক্ষক সমিতির নির্বাচন সোমবার, ১১ পদে ২২ প্রার্থী

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিতে যাদের দেখছেন যুবরাজ

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ নিয়ে নতুন তথ্য দিলেন শিক্ষামন্ত্রী

১০

আমার এ নিয়ে কোনো আপত্তি নেই : পিয়া

১১

হিটস্ট্রোকে মাদ্রাসাশিক্ষকের মৃত্যু

১২

কুমিল্লায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘পানি ঘণ্টা’ চালুর নির্দেশ

১৩

তীব্র তাপপ্রবাহে ক্লাস চলেছে চুয়াডাঙ্গার স্কুল-কলেজে

১৪

উচ্চ মাধ্যমিক পাসে বিক্রয় ডটকমে চাকরির সুযোগ

১৫

লুটপাট লুকাতে বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের নিষেধাজ্ঞা : রিজভী

১৬

উত্তরা ইউনিভার্সিটিতে বিএনডিপি ডিবেটার হান্ট ও নবীন বিতর্ক প্রতিযোগিতা -২০২৪

১৭

খোয়াই নদীতে ডুবে ২ ভাইয়ের মৃত্যু

১৮

পথচারীদের বিনামূল্যে রুহ্ আফজা দিচ্ছে হামদর্দ

১৯

তওবার পর যেভাবে বৃষ্টি ঝরেছিল হজরত মুসা (আ.) এর যুগে

২০
*/ ?>
X