মো. সাখাওয়াত হোসেন
প্রকাশ : ২১ মার্চ ২০২৪, ০৩:৩২ এএম
আপডেট : ২১ মার্চ ২০২৪, ০৮:৩৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

অগ্নিদুর্ঘটনা কেন কমছে না

অগ্নিদুর্ঘটনা কেন কমছে না

২০০৯ সালে বসুন্ধরা সিটির আগুনে মারা যান সাতজন। একই জায়গায় ২০১৬ সালে পুনরায় অগ্নিকাণ্ড ঘটে। ২০১০ সালের ৩ জুন রাজধানীর পুরান ঢাকার নিমতলীতে রাসায়নিক দাহ্য পদার্থের গুদামে বিস্ফোরণের ঘটনায় নারী এবং শিশুসহ নিহত হয় ১২৪ জন। আহত হয় অর্ধশতাধিক। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল অসংখ্য এবং অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিল আগুনের ভয়াবহতায়। পরবর্তীকালে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ২০১৯ সালে কেমিক্যাল গোডাউনের আগুনে দগ্ধ হয়ে নিহত হয় ৭১ জন। ২০১২ সালে রাজধানীর উপকণ্ঠ সাভারে তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ডে নিহত হয় ১০১ শ্রমিক।

২০১৭ ও ’১৯ সালে ডিএনসিসি মার্কেটে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ রাজধানীর বনানীর এফ আর টাওয়ারের আগুনে ভবন থেকে লাফিয়ে ২৬ জনের মৃত্যু হয়। আহত হয় ৭০ জনের মতো। রাজধানীর মগবাজারে ২০২১ সালের ৭ জুন অগ্নিকাণ্ডে ১২ জনের মৃত্যু হয়। রাজধানীর সায়েন্সল্যাবে শিরীন ম্যানশনে বিস্ফোরণের পর আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যায় ৬ জন। রাজধানীর সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে নিহত হয় ২৬ জন।

ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০২২ সালে সারা দেশে ১১৯টি বস্তিতে আগুনের ঘটনা ঘটে। এতে নিহত হয় ৬ জন। ২০২১ সালে ১৯৯টি বস্তিতে আগুনের ঘটনা ঘটে। এতে নিহত হয় দুজন। ২০২০ সালে ১০৯টি বস্তিতে আগুনের ঘটনায় নিহত হয় ১২ জন। ২০১৯ সালে ১৭৪টি বস্তিতে আগুনের ঘটনা ঘটে, এর মধ্যে ঢাকাতেই ৩১টি। বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যুর সংখ্যা তুলনামূলক কম হলেও তাদের থাকার কাঁচা-পাকা ঘরগুলো নিমিষেই আগুনে ভস্মীভূত হয়। শুধু প্রাণ নিয়েই বের হতে পারে তারা, তাদের বসতবাড়ির সবই পুড়ে কয়লা হয়ে যায়। অর্থাৎ একেবারে পথে বসে যেতে হয় বস্তিবাসীদের এবং পুনরায় স্বাভাবিক জীবন শুরু করতে প্রচুর কাঠখড় পোহাতে হয় তাদের।

চট্টগ্রামে শিল্পপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কারখানা, পরিত্যক্ত ট্রেনের বগি, বাসাবাড়ি এবং পরিত্যক্ত ময়লার স্তূপে আগুন লাগার ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। গ্যাস লাইনের লিকেজ থেকে আগুন বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে এবং এতে হতাহত হয় অসংখ্য মানুষ। অনেকে দগ্ধ হয় এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানও আগুনে ভস্মীভূত হয়। ঘটনাগুলো একটার পর অন্যটা দৈবক্রমে ঘটে যায়। আগুন লাগার প্রকৃত কারণ উদঘাটন না করেই ঘটনা নিষ্পত্তিতে চলে যায়। উল্লেখ করার মতো বিষয় হচ্ছে; ঘটনাগুলো কিছুদিন আলোচনার মধ্যে থাকে এবং একটি নির্দিষ্ট সময় পর আলোচনাও স্তিমিত হয়ে পড়ে। এ ব্যাপারটির কারণে বাংলাদেশে অগ্নিদুর্ঘটনার ঘটনা কমছেই না। কেননা বিচারের শাস্তি না হলে পরবর্তী সময়ে অনেকেই অনিয়মে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।

উপরোক্ত পরিসংখান এবং সংখ্যাগত বিশ্লেষণে এটাই প্রতীয়মান হয়, অগ্নিদুর্ঘটনার ঘটনাগুলো বাংলাদেশের জন্য একটি সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এবং সমস্যার কারণে মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং রাষ্ট্রও অর্থনৈতিক ও কাঠামোগতভাবে ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। যেহেতু অগ্নিকাণ্ডকে আমরা সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছি এবং এর ফলে ক্ষতিগ্রস্তের বৈচিত্র্যতাও পর্যবেক্ষণ করেছি, তথাপি আমরা কেন ক্ষতিপূরণ প্রত্যাহারে সজাগ হচ্ছি না? এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে। অগ্নিদুর্ঘটনার মাত্রা ও ব্যাপকতা কিন্তু দিনের পর দিন বেড়েই যাচ্ছে। সাধারণত অগ্নিদুর্ঘটনা কমার ক্ষেত্রে প্রতিকার ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার মানে হচ্ছে বিল্ডিং কিংবা অন্যান্য ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এমনভাবে সুরক্ষিত করার ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে স্বাভাবিকভাবে আগুন লাগার সব ধরনের সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব হয়। বিশেষ করে বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ করতে হবে। রাজউক কিংবা সিটি করপোরেশন থেকে অনুমোদনকৃত তথা স্থপতির নকশার বাইরে কোনোভাবে ভবন নির্মাণ করা যাবে না। এ বিষয়গুলো অনুধাবন ও অনুসরণ করে স্থাপনা নির্মাণ করা উচিত।

বিশ্লেষক এবং গবেষকদের মতামতের ভিত্তিতে কোনো ভবনে আগুন দুর্ঘটনা প্রতিহতে নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর প্রতি নজর প্রদান করা উচিত। যেমন—আধুনিক বহুতল ভবনগুলোতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, হিটিং, বিদ্যুৎ এবং গ্যাস সংযোগের জন্য যে পাইপগুলো টানা হয়, সেগুলো যায় ডাক্ট লাইন এবং কেবল হোলের ভেতর দিয়ে। এই ডাক্ট লাইন ও গর্ত দিয়ে ধোঁয়া এবং আগুন খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। সেজন্য ডাক্ট লাইন ও কেবল হোলগুলো আগুন প্রতিরোধক উপাদান দিয়ে ভালো করে বন্ধ করে দিতে হবে। ভূমিকম্প এবং আগুন লাগার মতো দুর্ঘটনা ঠেকাতে দরজা ও দেয়াল আগুন প্রতিরোধী হলে ভালো হয়। এ ছাড়া ঘরের সিলিং, রান্নাঘরের আসবাবপত্র আগুন প্রতিরোধী পদার্থে নির্মাণ এবং আগুন প্রতিরোধী তার ব্যবহার করলে আগুন লাগলেও সেটি ছড়িয়ে পড়ার ভয় থাকে না।

প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেওয়ার পরও যদি কোনো ভবনে আগুন লাগে তাহলে সে ক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতিকে কমিয়ে আনার একটা উপায় হচ্ছে ফায়ার এবং স্মোক অ্যালার্ম সিস্টেম বসানো। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অ্যালার্ম সিস্টেম কাজ করলে কোনো এক জায়গায় আগুন লাগলে পুরো ভবনের বাসিন্দারাই আগুন সম্পর্কে জানতে পারে এবং দ্রুত তারা ভবন খালি করে নিচে নেমে আসতে পারে। ফলে প্রাণহানি ব্যাপকভাবে কমানো সম্ভব। যে কোনো ভবনেই আগুন লাগলে সেটি থেকে বের হয়ে আসার জন্য বাইরে একটা জরুরি বহির্গমন পথ থাকতে হবে।

প্রতিটি ভবনেই অগ্নিনির্বাপণ সিলিন্ডার বা ফায়ার এক্সটিংগুইশার থাকাটা নিশ্চিত করতে হবে। সেইসঙ্গে এগুলো ব্যবহার করতে জানতে হবে ভবনের বাসিন্দাদের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো একটি ভবনে আগুন লাগার পর সেটি ছড়িয়ে পড়তে কিছুটা হলেও সময় লাগে। এ সময়ের মধ্যে যদি অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা দিয়ে সেটি নিভিয়ে ফেলা যায় তাহলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। আগুন লাগার পর প্রথম দুই মিনিটকে বলা হয় প্লাটিনাম আওয়ার বা সবচেয়ে মূল্যবান সময়। এ সময়ে ঘাবড়ে না গিয়ে ঠান্ডা মাথায় ব্যবস্থা নিয়ে ক্ষয়ক্ষতি অনেক কমানো যায়। আগুন নেভানোর জন্য একটা প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা হচ্ছে স্প্রিঙ্কলার সিস্টেম। এটি কোনো একটি ভবনের পানি সরবরাহ ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত থাকে। এ ব্যবস্থায় কোনো একটি স্থানে তাপমাত্রা ৫৭ ডিগ্রির বেশি হলে এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিস্ফোরিত হয়ে পানি ছিটিয়ে পড়তে থাকে। ফলে আগুন নিভে যায়।

ফায়ার এক্সটিংগুইশার কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, কীভাবে ফায়ার সার্ভিসকে ডাকতে হবে; ভবনে আগুন লাগলে সেখান থেকে কীভাবে বের হয়ে আসতে হবে তার জন্য নিয়মিত মহড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আগুন থেকে উৎপন্ন ধোঁয়া যাতে কেউ নিঃশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ না করে, ভবন থেকে নামতে যাতে সিঁড়ি ব্যবহার করে, ভেজা তোয়ালে দিয়ে মুখ ঢেকে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে হবে—এ বিষয়গুলো অবশ্যই জানতে হবে। এ ছাড়া কোনো অবস্থাতেই উদ্বিগ্ন না হওয়া বা ঘাবড়ে গিয়ে ভবন থেকে লাফিয়ে পড়া থেকে বিরত থাকতে হবে। এ ছাড়া বহুতল ভবনগুলোতে অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম এমন দক্ষ জনবল নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।

অগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিকারে তাৎক্ষণিক ভিত্তিতে তদন্ত করে প্রকৃত দোষীদের খুঁজে বের করতে হবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। এমনও দেখা যায়, অগ্নিদুর্ঘটনার পর একটি হুলুস্থুল কাণ্ড বেধে যায় কিন্তু প্রকৃত ঘটনা উদঘাটনের ক্ষেত্রে গাফিলতি থেকেই যায়। বিল্ডিং কোড না মেনে যারা ভবন নির্মাণ করে অসংখ্য মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় আইনে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যে কোনো একটি ঘটনার সঠিক তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত দোষীদের শাস্তি প্রদান করে নজির সৃষ্টি করা যায় তাহলে দেখা যাবে, যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতির বাইরে কেউই ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নির্মাণে সাহস করবে না। তা ছাড়া অফিস-আদালতে কিংবা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে গ্যাসের বোতল, কেমিক্যাল, রেস্টুরেন্ট পরিচালনায় নিয়মের অনুসরণের পাশাপাশি ভাড়াটিয়াদের প্রতি মালিকের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতের মাধ্যমে অগ্নিদুর্ঘটনা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। সবিশেষ বলা যায়, রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অগ্নিদুর্ঘটনা ও তৎপরবর্তী ক্ষয়ক্ষতি থেকে সহজেই মুক্তি মিলছে না আমাদের। তবে সচেতনতা ও নিয়ম অনুসরণের কোনো বিকল্প নেই।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

নরসিংদী জেলা সাংবাদিক সমিতি, ঢাকা’র নতুন কমিটিকে সংবর্ধনা

কেইনের হ্যাটট্রিকে লেইপজিগকে উড়িয়ে দিল বায়ার্ন

নিখোঁজের একদিন পর যুবকের মরদেহ মিলল পুকুরে

বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের ড্রয়ের তারিখ ঘোষণা করলেন ট্রাম্প

এশিয়া কাপ দলে জায়গা পেয়ে সোহানের কৃতজ্ঞতার বার্তা

ঘুষ কেলেঙ্কারিতে পুলিশ কর্মকর্তা প্রত্যাহার

প্রবীণদের বিশেষ যত্ন নিয়ে বার্ধক্যের প্রস্তুতি নিন: স্বাস্থ্য সচিব

বিভুরঞ্জন সরকারের মৃত্যু অনাকাঙ্ক্ষিত: রাষ্ট্রদূত আনসারী

লা লিগার কাছে যে অনুরোধ করতে চায় বার্সা

‘নির্বাচনে আমলাদেরকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে’

১০

সাবেক এডিসি শচীন মৌলিক কারাগারে

১১

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা আসছেন শনিবার, যেসব বিষয়ে আলোচনা

১২

সিদ্ধিরগঞ্জে হেফাজতে ইসলামের শানে রিসালাত সম্মেলন

১৩

শেষ দিনেও ‘জুলাই সনদ’ নিয়ে মতামত দেয়নি ৭ রাজনৈতিক দল

১৪

ইউরোপের লিগগুলোতে দল কমানোর প্রস্তাব ব্রাজিল কোচ আনচেলত্তির

১৫

নেপালে মার্কিন কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠকের প্রচার, তাসনিম জারার ব্যাখ্যা

১৬

মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে মৃত্যুর মিছিল, তিন বছরে প্রাণ হারান ১৮৩ জন

১৭

স্বর্ণ ব্যবসায়ীর বাড়িতে দুর্ধর্ষ ডাকাতি 

১৮

সুদ দিতে না পারায় বসতঘরে তালা, বারান্দায় রিকশাচালকের পরিবার

১৯

দেশ বাঁচাতে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দিতে হবে : চরমোনাই পীর

২০
X