বাংলাদেশের অর্থনৈতিক গতিশীলতার প্রধান চালিকাশক্তির একটি প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স, যার প্রায় সবটুকুই আসে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কর্মরত শ্রমিকদের কাছ থেকে। মহাগুরুত্বপূর্ণ এই শ্রমবাজারে নতুন নতুন নাম সংযোজন যেখানে অতি আবশ্যক, সেখানে কোনো দেশের বাজার হারানো নিঃসন্দেহে বড় রকমের দুঃসংবাদ। স্বভাবতই রোমানিয়ার শ্রমবাজার হাতছাড়ার খবর আমাদের সার্বিক অর্থনীতির জন্য কোনোভাবেই সুখকর নয়।
শনিবার দৈনিক কালবেলায় প্রকাশিত ‘খামখেয়ালিতে হাতছাড়া রোমানিয়ার শ্রমবাজার’ শীর্ষক প্রধান প্রতিবেদনে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুসারে, দেশের জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হঠকারী আচরণ, বিভিন্ন রিক্রুটিং এজেন্সির খামখেয়ালি এবং রোমানিয়া থেকে অবৈধ বাংলাদেশি শ্রমিকদের মধ্যেও পশ্চিম ইউরোপে পাড়ি জমানোর প্রবণতার কারণেই হাতছাড়া হচ্ছে দেশটির শ্রমবাজার। অথচ মাত্র সাড়ে তিন বছরে ৩৫ হাজারের বেশি শ্রমিক পাড়ি জমিয়েছিলেন পূর্ব ইউরোপের এই দেশটিতে। সম্প্রতি সহজে ভিসা প্রাপ্তি এবং কাজের সুযোগ থাকায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের পছন্দের গন্তব্য হয়ে উঠেছিল দেশটি। স্থাপিত হয় রোমানিয়ার অস্থায়ী ভিসা সেন্টারও। তবে কিছুদিনের মধ্যেই হোঁচট খায় সেই উদ্যোগ। বন্ধ হয়ে যায় ভিসা সেন্টার। সর্বশেষ গত ছয় মাসে বেশ কিছু শ্রমিক ভিসা পেলেও বিএমইটির কিছু কর্মকর্তার খামখেয়ালিপনার কারণে যথাসময়ে পাড়ি জমাতে পারছেন না তারা। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় আসে রোমানিয়ার ছয় সদস্যের প্রতিনিধিদল। তখন বলা হয়, দেশে অস্থায়ী ভিসা কনস্যুলেট অফিস স্থাপন করা হবে। প্রাথমিক অবস্থায় কাকরাইলের বিএমইটি কার্যালয়ের ৬ তলায় অস্থায়ী অফিস থেকে কর্মীদের সরাসরি সাক্ষাৎকার নেওয়া শুরু হয়। ৬ মাসে ১৫ হাজার কর্মীর নামে ভিসা দেওয়ার ঘোষণাও হয়। তবে কিছু দিন যেতে না যেতেই সেই অফিস গুটিয়ে দিল্লির রোমানিয়ান অফিসে ফিরে যান কর্মকর্তারা। অভিযোগ ওঠে, বিএমইটির কয়েকজন কর্মকর্তা এবং দুটি রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক অনৈতিক সুবিধা চান। এরপর পেরিয়ে গেছে বছরেরও বেশি সময়। বিএমইটি কিংবা প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে সেই বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। শ্রমিক রপ্তানির এমন সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার পরও দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো রকমের ব্যবস্থা না নেওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক। গত কয়েক মাসে ছয় শতাধিক শ্রমিককে রোমানিয়া থেকে ভিসা দেওয়া হয়। তাদের মধ্য থেকে সেখানে যেতে পারছেন অল্প কয়েকজন। বাকিরা বিএমইটির নানা শর্তের বেড়াজালে আটকে আছেন। যদিও একই প্রক্রিয়ায় ভারত এবং নেপালের শ্রমিকরা ইতোমধ্যে পাড়ি জমিয়েছেন দেশটিতে। বিএমইটি কেন এসব শ্রমিককে দেশটিতে যেতে সহযোগিতা না করে নানা শর্তের বেড়াজালে আবদ্ধ করছে বা এক অর্থে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে, এটা একটি প্রশ্ন?
আমরা মনে করি, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন কারণে ক্ষয়িষ্ণু বাংলাদেশের বিদেশি শ্রমবাজার। হাতেগোনা কয়েকটি দেশের মধ্যে সীমিত হয়ে পড়েছে এটি। গত পাঁচ বছরে বিদেশে পাঠানো মোট কর্মীর ৯৭ শতাংশই গেছেন মাত্র ১০টি দেশে। দেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে শ্রমবাজারের প্রসারই যেখানে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পাওয়ার কথা এবং সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ক তৎপরতারও দেখা যায় হরহামেশা, সেখানে এই উল্টো চিত্র; অর্থাৎ হাতেরটাই হাতছাড়া! তাহলে শ্রমবাজার তৈরিতে নানা উদ্যোগ ও তৎপরতার যেসব কথা শোনা যায়, তা কি শুধু মুখের বুলিমাত্র! তা না হলে এমন চিত্র কেন? আমাদের প্রত্যাশা, নতুন শ্রমবাজার তৈরিতে সরকার ও সংশ্লিষ্টরা তৎপর হবেন। পাশাপাশি রোমানিয়ার শ্রমবাজার হাতছাড়া হওয়ার পেছনে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে—এটাই আমাদের প্রত্যাশা।