ইসলামে সন্তান জন্ম হলে পশু জবাইয়ের বিধান রয়েছে। ছেলে সন্তান হলে দুটি ছোট পশু ও মেয়ে সন্তান হলে একটি ছোট পশু জবাই করতে হয়। বড় পশু হলে তাতে ছেলের জন্য দুই ভাগ ও মেয়ের জন্য এক ভাগ যোগ করাও জায়েজ রয়েছে। কোরবানিও যেহেতু পশু জবাইয়ের আমল, তাই কোরবানির দিনক্ষণ ঘনিয়ে এলে আকিকা সম্পর্কেও সাধারণ মানুষের মধ্যে অনেক জিজ্ঞাসা তৈরি হয়। আসলে কোরবানির সঙ্গে আকিকার কোনো সম্পর্ক নেই। কোরবানির সম্পর্ক জিলহজ মাসের ১০ তারিখের সঙ্গে আর আকিকার সম্পর্ক সন্তান জন্মের সপ্তম দিনের সঙ্গে। কোরবানি ও আকিকা সম্পূর্ণ আলাদা দুটো আমল। প্রত্যেক ইবাদতের যথাযথ নিয়ম, সময় এবং স্থান রয়েছে। সে হিসেবে আকিকারও নির্দিষ্ট সময়, নিয়ম, পদ্ধতি রয়েছে। কিন্তু অনেকেই আকিকার সময়কে কোরবানির সময়ের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। সম্ভবত অজ্ঞতার কারণে অনেক মানুষ কোরবানি ও আকিকা দুটো কাজ একসঙ্গে করতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
জিলহজ মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখ পর্যন্ত এ তিন দিন কোরবানির সময়। এর আগে বা পরে করলে কোরবানি হবে না। নবজাতক সন্তানের সপ্তম দিবস যদি এ তিন দিনের কোনো এক দিন মিলে যায়, তাহলে কোরবানির সঙ্গে আকিকাও করা যাবে। ইসলামে এ বিষয়ে সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এমনকি একটি গরু বা উটে যেহেতু সাতটি অংশ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে, তাই একটি পশুতে কোরবানি ও আকিকা দিয়ে সাত অংশ পূর্ণ করারও অবকাশ রয়েছে। আকিকা সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নবজাতক প্রত্যেক সন্তান তার আকিকার বিনিময়ে বন্ধক হিসেবে রক্ষিত। তাই সপ্তম দিন তার পক্ষ থেকে আকিকা করো, নাম রাখো ও চুল কর্তন করো।’ (তিরমিজি)
রাসুল (সা.) তার প্রিয় দুই দৌহিত্র হাসান-হোসাইন (রা.)-এর জন্মের সপ্তম দিনে আকিকা করেছেন। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আকিকা সপ্তম দিনে হওয়া উচিত। তা সম্ভব না হলে চৌদ্দতম দিনে। তাও সম্ভব না হলে একুশতম দিনে।’ (মুসতাদরাকে হাকিম, হাদিস : ৭৬৬৯)। এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয়—আকিকা করা এবং সপ্তম দিনে করা। সপ্তম দিনে না করলে একটি আমল ছুটে যাবে। কিন্তু মূল আমল আকিকা তাতে রহিত হয় না।
কোনো কোনো ইবাদত বিলম্বে বা অন্য সময়ে আদায় করা জায়েজ আছে বলে বিলম্ব করতে হবে এমন কথা নেই। কোরবানি কেন্দ্র করে আকিকার সময় পেছানো অনুচিত কাজ। কোরবানি ছাড়া সাধারণ সময়ে আকিকা হলে মুসলিম সমাজে এর যথেষ্ট প্রভাব পড়বে। বিধর্মীরাও জানতে পারবে যে, সন্তান জন্মের আনন্দটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং কতটা সৌন্দর্যমণ্ডিত। অথচ অসংখ্য পরিবারে দেখা যায় শিশু জন্মের সপ্তম দিনে বিশাল আয়োজনে অনুষ্ঠান করা হয়, যা আকিকার খরচের চেয়েও অনেক বেশি হয়ে যায়; তবু তারা আকিকা করে না। তা ছাড়া আকিকা আলাদা সময়ে হলে আকিকার গোশত বছরের অন্য সময়ে খাওয়ার একটা সুন্দর সুযোগ সৃষ্টি হয়। কোরবানির সময়ে তো গোশতের অভাব থাকে না। কমবেশি সবাই খেতে পারে।
কিছু মানুষ ছাগল দিয়ে আকিকা করতে চান না। তারা কোরবানির গরুতে আকিকার নাম বসিয়ে দেন। বরং ছাগল দিয়ে আকিকা করার কথা বহু হাদিস রয়েছে। অন্য পশুর কথা কোনো হাদিসে উল্লেখ নেই। হজরত আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর (রা.)-এর বংশের এক মহিলা মানত করল যে, আবদুর রহমানের স্ত্রীর কোনো সন্তান হলে আমরা একটি উট জবাই করব। হজরত আয়েশা (রা.) শুনে বললেন, তা হতে পারে না। বরং সুন্নত হলো ছেলে সন্তানের জন্ম হলে দুটি কম বয়স্ক ছাগল আর মেয়ে সন্তানের জন্য একটি ছাগল আকিকা করবে। তবে এ আকিকা জন্মের সপ্তম দিন হলে উত্তম। (মুস্তাদরাকে হাকেম)। এ ব্যাপারে রাসুল (সা.)-এর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি সন্তানের আকিকা করার ইচ্ছা করে, সে যেন তা পালন করে। এ ক্ষেত্রে ছেলের জন্য সমমানের দুটি ছাগল। আর মেয়ের জন্য একটি।’ (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক : ৭৯৬১)
সমাজে এখনো অনেক মানুষ আকিকার সংখ্যা নিয়ে ভুলের মধ্যে রয়েছে। তারা মনে করে ছেলের জন্য একটি মেয়ের জন্যও একটি। কিছু অঞ্চলে বছরের পর বছর ধরে এভাবেই চলে আসছে। পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে ছেলের জন্য বাকি একটি আদায় করছে। আবার অনেকের এ ভুল ধারণাও রয়েছে যে, ছাগল আকিকা দিলে ছেলেদের জন্য দুটি, মেয়েদের জন্য একটি। আর যদি গরুতে অংশ নেয় তবে ছেলেমেয়ের জন্য একটি অংশ। তাদের যুক্তি, গরু ছাগলের চেয়ে বড়। এটা তাদের অনেক বড় ভুল। গরুতে হলেও ছেলের জন্য দুটি অংশ ও মেয়ের জন্য একটি রাখতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয়, আকিকার জন্য আলাদা ছাগল ক্রয় করা এবং আকিকা ছাগল দিয়েই আদায় করা। এতে হাদিসে বর্ণিত হুবহু প্রাণীর অনুসরণ হয়, কোরবানির জন্যও আটকে থাকতে হয় না, মানুষের মধ্যেও ভুল ধারণার সুযোগ থাকে না। এতে হাদিসে বর্ণিত অংশও ঠিক থাকবে আর হাদিসও যথাযথ মানা হবে।
লেখক: ইমাম ও খতিব