রবিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৫, ২৭ আশ্বিন ১৪৩২
কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১১ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১১ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:০৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

রাজনৈতিকভাবে যা চেয়েছিলাম আমরা সেখানে পৌঁছাতে পারিনি

আহমদ রফিক
রাজনৈতিকভাবে যা চেয়েছিলাম আমরা সেখানে পৌঁছাতে পারিনি

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সংগ্রামী দিন পেরিয়ে একটা সুদীর্ঘ নিভৃত সাহিত্যিক জীবন অতিবাহিত করে গত ২ অক্টোবর চিরবিদায় নিলেন আহমদ রফিক। একজন মুক্তমনা সংস্কৃতি-ব্যক্তিত্ব ছিলেন ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক। ছিলেন কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক। ছাত্রজীবন শেষে প্রতিবাদী এ মানুষটি প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। সমাজ প্রগতির সংগ্রামে যেমন, তেমনি সাহিত্যচর্চায় থেমে থাকেননি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। গভীর অভিনিবেশে দীর্ঘ রবীন্দ্রচর্চার জন্য পেয়েছেন ‘রবীন্দ্রচার্য’ উপাধি। গত বছর ডিসেম্বরে তার সঙ্গে আলাপ হয় কবি, সাহিত্য সম্পাদক এহসান হায়দার-এর সঙ্গে। সেই একান্ত আলাপচারিতার নির্বাচিত অংশ এখানে পত্রস্থ হলো।

শুরুতেই আপনার লেখকজীবন সম্পর্কে জানতে চাই।

আহমদ রফিক: আমার লেখকজীবনে আনন্দের, এখন আমার আনন্দময় জগৎ এটাই। আমি এটা উপভোগ করি, এর মধ্যে শান্তি ও স্বস্তির দিকটাই সবচেয়ে বেশি আমার। আমি একটা কথা বলি এ বিষয়ে, আমার যদি এই লেখকজীবন যদি না থাকত, কিংবা আমি যদি এ জীবনটা বেছে না নিতাম, তবে নিশ্চিতই রাজনীতিতে থেকে যেতাম, সেটা ভুল করতাম।

এ দেশের সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রকে আপনি কীভাবে দেখেন?

আহমদ রফিক: আমি চিকিৎসা পেশায় যুক্ত হইনি, রাজনীতি প্রিয় ছিল, রাজনীতিতে পুরোদস্তুর ডুবে ছিলাম। যে কারণে আমার এমন মেরিটোরিয়াস ক্যারিয়ার নষ্ট হলো। তারপর একসময় চিন্তা করলাম, রাজনীতি করব নাকি সাহিত্য করব? দ্বিতীয়টা বেছে নিলাম। আমি আজও মনে করি, আমার সিদ্ধান্ত ছিল সঠিক। এ দেশের সাহিত্যভুবন আমাকে অনেক দিয়েছে, আমি তৃপ্ত।

ভাষা আন্দোলনে কীভাবে যুক্ত হলেন? সেই দিনগুলোর কথা কিছু বলুন।

আহমদ রফিক: আমি ছেলেবেলা থেকেই রাজনীতি-সচেতন ছিলাম, যখন স্কুলে পড়ি তখন থেকে প্রগতিশীল ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম। তখনকার দিনে যারা ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকতেন তারা ছিলেন আদর্শিক, নিজের স্বার্থে তাদের রাজনীতি ছিল না। তখনকার মানুষের মাঝে দেশপ্রেম ছিল, সততা ছিল, অনুকরণীয় ছাত্ররাজনীতি মানেই আদর্শের জায়গা। স্কুল ও কলেজ জীবনে প্রগতিশীল ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে আমি মেডিকেল কলেজে এসেও একইভাবে ছাত্রদের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পেরেছিলাম।

ফলে যখন ভাষার প্রশ্ন তৈরি হলো, তখন নিজে মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের সংগঠিত করেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ছাত্ররাজনীতির আড্ডা ছিল—তাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল, সেসব আড্ডাতেও আমি যুক্ত ছিলাম। মেডিকেল কলেজের হলে পোস্টার ও লিফলেট দিয়ে ছাত্র জনমত তৈরির কাজে প্রতিনিয়ত ব্যস্ত ছিলাম। ওই সময়ে প্রতিটি মিছিল, সভা-সমাবেশে অংশ নিয়েছি। আমি ৩১ জানুয়ারি মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সভাতেও উপস্থিত ছিলাম। আমি বলব, সর্বোপরি ভাষা আন্দোলনের সময় আমি মেডিকেল কলেজে একজন সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছিলাম।

ভাষা আন্দোলনের তাত্ত্বিক পর্যায় সম্পর্কে আপনার মতামত জানতে চাই।

আহমদ রফিক: ১৯৪৭ সালের জুন-জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেছিলেন—ভারত চিন্তা করছে হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য, সে হিসেবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত উর্দু। তখন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সাহেব, এ বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে প্রবন্ধ লিখলেন। এই সময়কে অনেকে ভাষা আন্দোলন বলেন, আমি বলি না। আমি বলি, এটা ভাষা আন্দোলনের তাত্ত্বিক পর্যায়। আমি ভাষা আন্দোলনের তাত্ত্বিক পর্যায় বলছি কারণ, শুরুতে বাঙালিরা মৌখিকভাবে প্রতিবাদ করেছেন, লিখে প্রতিবাদ করেছেন; কিন্তু আন্দোলন করেননি, রাজপথে নামেননি, স্লোগান দেননি। এর ফলে পাকিস্তান সৃষ্টির পরেই সেপ্টেম্বর মাসে তমদ্দুন মজলিস গঠিত হয়। তমদ্দুন মজলিস একটা পুস্তিকা প্রকাশ করে—‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু না বাংলা’। সেখানে ড. কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমেদ, ড. আবুল কাশেম প্রবন্ধ লিখেছিলেন। নারায়ণগঞ্জ থেকে ‘কৃষ্টি’ নামে আরও একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়, অধ্যাপক ড. এনামুল হক ওই পত্রিকায় বাংলা ভাষার পক্ষে প্রবন্ধ লিখেছিলেন। এ ব্যাপারগুলোও আমার কাছে ওই তাত্ত্বিক পর্যায়েরই অংশ।

ভাষা আন্দোলনের যে চেতনা ছিল, সেটির রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি কী ছিল আপনার মতে?

আহমদ রফিক: রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অর্থ শুধু বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা নয়। বাঙালি জনগোষ্ঠীর সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার, সেই অধিকার আদায়ের চিন্তাগুলো এর সঙ্গে জড়িত ছিল। সামগ্রিকভাবে এ তাত্ত্বিক কথার বিচার করলে দেখা যাবে, যেহেতু রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার মধ্য দিয়ে বাঙালি জনগোষ্ঠীর আর্থসামজিক স্বার্থরক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, সেহেতু শুধু বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনে সীমাবদ্ধ ছিল না বায়ান্নর আন্দোলন।

১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে একটি সভা হয়েছিল, সেটি সম্পর্কে বিস্তারিত বলবেন?

আহমদ রফিক: ৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি বার লাইব্রেরিতে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে সুষ্ঠুভাবে আন্দোলন পরিচালনার জন্য কর্মিসভার আহ্বান করা হয়েছিল। সেখানে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। আহ্বায়ক হলেন ছাত্রলীগের নেতা কাজী গোলাম মাহবুব। এই কমিটিতে সব দল এবং হলগুলো থেকে ছাত্র প্রতিনিধি, যুব প্রতিনিধি ও রাজনীতিক প্রতিনিধি নিয়ে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়েছিল। ফেব্রুয়ারি শুরু হয়ে গেল, ৪ ফেব্রুয়ারির গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি আর্টস বিল্ডিং প্রাঙ্গণে, এখন যেটা ঢাকা মেডিকেলের ইমার্জেন্সি কমপ্লেক্স, ওখানে বেলতলায় মিটিং হলো। ছাত্রদের এ মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, আন্দোলনকে সক্রিয় এবং বেগবান করতে ২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হবে সভা-সমাবেশ, মিছিল, স্লোগান ইত্যাদির মাধ্যমে। এটা সংগ্রাম কমিটিও সমর্থন করল। মওলানা ভাসানী আলাদাভাবে বিবৃতি দিয়েও এর সমর্থন করলেন।

যখন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তখন যে স্বপ্ন দেখতেন—তার সঙ্গে কেমন মিল পান আজকের স্বাধীন বাংলাদেশে?

আহমদ রফিক: আমাদের সময়ে রাজনৈতিকভাবে যা চেয়েছিলাম, আমরা সেখানে পৌঁছাতে পারিনি। সাধারণ মানুষের আশা-স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা কোনোটিরই পূর্ণতা দিতে পারিনি আমরা। আজও সেগুলোর পরিবর্তন হয়নি। একটা শ্রেণির মানুষ এখানে সমৃদ্ধ হয়েছে। সাধারণ মানুষ এখানে অবহেলিত। স্বাধীন বাংলাদেশে এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। এখন আশার জায়গাগুলো আর নেই, হতাশায় নিমজ্জিত মানুষ। স্বপ্ন দেখতে ভুলে গেছে হয়তো—এমন মনে হয়।

আপনারা ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখটি কেন প্রতিবাদের জন্য বেছে নিয়েছিলেন?

আহমদ রফিক: ২১ ফেব্রুয়ারি এ প্রতিবাদের সিদ্ধান্তের কারণ হলো, ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গ আইন সভার প্রথম বাজেট অধিবেশনের দিন। উদ্দেশ্য ছিল বাজেট অধিবেশন ঘেরাও করা। এখন যেটা জগন্নাথ হল, সেটা ছিল পরিষদ ভবন। এখানে পরিষদ সদস্যদের ঘেরাও করে ওই প্রস্তাব যেন তারা নেন এবং গণপরিষদে পাস করে এ দায়িত্বটুকু তারা পালন করেন—এ বিষয়ে তাদের দিয়ে মুচলেকা নেওয়া। [একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, তখনো পূর্ব বাংলার নাম ‘পূর্ববঙ্গ’, কারণ পাকিস্তান নামটি এসেছে এটা অনেকে বলেন] ভুল করে, পূর্ব পাকিস্তান নামটি এসেছে ৫৬ সালের গণপরিষদের অধিবেশনে। যখন প্রথম সংবিধানে অধিবেশন তৈরি হলো। ওই সংবিধানেই বলা হলো—পূর্ব পাকিস্তান, পশ্চিম পাকিস্তান। এর আগে নাম ছিল, ‘পূর্ববঙ্গ’, আইন সভার নাম ছিল, ‘পূর্ববঙ্গ পরিষদ’ বা ‘ইস্ট পাকিস্তান অ্যাসেমব্লি’।

যখন ভাষা আন্দোলন মূল রূপে সঞ্চারিত হয়েছিল, তখন আন্দোলনের ঢেউ দেশের জেলা শহর থেকে গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। সেই সময়ের কথা কিছু বলুন।

আহমদ রফিক: ভাষা আন্দোলন, একুশের ভাষা আন্দোলনে এতটা গতি সঞ্চারিত হওয়া এবং প্রদেশব্যাপী ব্যাপকভাবে জেলা শহর, থানা শহর থেকে গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত প্রসারিত হওয়ার কারণ হলো ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণ। ২০১৯ সালে আমার লেখা একটা বই প্রকাশ করেছে ‘প্রথমা প্রকাশন’; নাম ‘ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া’। এটা মূলত গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলন কীভাবে বিস্তৃতি লাভ করেছে, কোথায় কোথায় গেছে, সেটার সংক্ষিপ্ত বিবরণ।

প্রতিটি জায়গায় আমি দেখেছি, পুলিশের গুলিবর্ষণে ঢাকায় ছাত্রদের মৃত্যুর খবরই আন্দোলন শুরু করার একটা প্রেরণা, যা স্কুল পর্যন্ত বিস্তৃত। সে কারণে শিক্ষায়তনিক আন্দোলন গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছেছিল।

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একাত্তর সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। এর পেছনেও ভাষা আন্দোলন ছিল প্রধান প্রেরণা। সেই প্রেক্ষাপট কীভাবে দেখেন?

আহমদ রফিক: জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ, রাজনৈতিক প্রগতিশীল চেতনার বিকাশ, ষাটের দশকে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন, যুক্তফ্রন্টের বিজয়, মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে মন্ত্রিসভা গঠন—এসবই এ আন্দোলনের মাধ্যমে এসেছে। আবার আন্দোলন এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে শেষ পর্যন্ত ৭১ সালের যুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়। তা যদি হয় দলমত নির্বিশেষে, আমি খালেদা জিয়ার বক্তৃতা শুনেছি, শেখ সাহেবের বক্তৃতাও শুনেছি এবং শেখ হাসিনার বক্তৃতাও শুনেছি, তারা সবাই এই একই কথাগুলো বলেছেন। তাহলে এই ভাষা আন্দোলনের যে ইতিহাস, সেটা সরকারের সংরক্ষণ করা উচিত ছিল না? মুক্তিযুদ্ধের ১৬ খণ্ডের ইতিহাস তৈরি হয়েছে।

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সংরক্ষণ-রচনার বিষয়ে আরও কিছু বলুন।

আহমদ রফিক: ভাষা আন্দোলনের সূচনালগ্নের সে ইতিহাস যে সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গ্রামের স্কুলগুলো পর্যন্ত সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল, বিস্তৃতি লাভ করেছিল—সেই ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস গড়া বা দলিলপত্র সংগ্রহ কিংবা লিপিবদ্ধ করার দায়িত্বটা কোনো সরকার নেয়নি কেন? একই সঙ্গে আরেকটি প্রতীক শহীদ মিনার। আমাদের এই শহীদ মিনার তো ২৬ তারিখে ভেঙে ফেলল, তার পরিপ্রেক্ষিতেই পরে ৫৫ সাল থেকে শুরু করে ৫৬ সালে এসে আমাদের সর্বদলীয় সংগঠনের একটি অংশ হক সাহেবের কেএসপি, কৃষক-শ্রমিক পার্টির আবুল হোসেন সাহেব এসে ভিত্তিপ্রস্তর করেন। আমাদের এ জায়গাটুকু, আমাদের হোস্টেলের অংশবিশেষ এবং ফুলার রোডের অংশবিশেষ নিয়ে। সেই শহীদ মিনারের ইতিহাসটা রচনা করা উচিত ছিল না? যা এখনো আমাদের প্রেরণা জোগাচ্ছে, রাজনীতিকভাবে, সাহিত্য-সংস্কৃতিতে সবকিছুতে কাজের প্রেরণা জোগাচ্ছে—জাতি, জাতীয়তা, প্রগতিশীলতা সবখানে। অথচ এ সামান্য দায়িত্ব কেউ পালন করেনি। তাদের মূল লক্ষ্য ক্ষমতায় যাওয়া।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আপনার প্রিয়, তার সৃষ্টিশীলতার বিস্তৃতি সবখানে। আপনার দৃষ্টিতে রবিসৃষ্টি সম্পর্কে বলবেন?

আহমদ রফিক: আমি যখন রাজনীতি থেকে সরে এসেছিলাম লেখার জন্য, তখন আমি সাংস্কৃতিক দায়িত্ব অনুভব করেছিলাম। এ দায়িত্ব থেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পাঠ করেছিলাম। তারপর রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি ঘিরে আমার ভালোলাগা। রবীন্দ্রনাথ শুধু কবি নন, বরং আধুনিক বাঙালির মুক্তি-চিন্তা, মানবতাবাদ ও সমাজভাবনার অন্যতম নির্মাতা। তার সৃষ্টি নত করে দেয়, সুন্দরের বোধ তৈরি করে।

আপনি ছোট কাগজ করতেন?

আহমদ রফিক: হ্যাঁ, নাম ‘নাগরিক’; ওটা একটি সাহিত্য পত্রিকা। পত্রিকার প্রধান ব্যক্তি ছিলাম, সম্পাদক হিসেবে অবশ্য অন্য একজনের নাম থাকত। তখনকার গুরুত্বপূর্ণ লেখকরাই লিখতেন।

সর্বস্তরে বাংলা চালু করো—এ স্লোগানটি আপনাদের আন্দোলনের সময়ের; কিন্তু এখনো এটা বাস্তাবায়িত হয়নি—দেশের প্রতিটি স্তরে কি বাংলা ব্যবহার করা খুব কঠিন কাজ?

আহমদ রফিক: ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশ হয়ে মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়েছে; কিন্তু আমাদের শেষ স্লোগানটি—সর্বস্তরে বাংলা চালু করো, একুশের বদৌলতে স্বাধীন বাংলাদেশে তো সেটা চালু করা সম্ভব ছিল। উচ্চশিক্ষায়, বিজ্ঞান শিক্ষায়, উচ্চ আদালতে সর্বত্র বাংলা ভাষা চালু হওয়া উচিত ছিল। তার বদলে আমরা কী দেখছি—৯০ বছর যে বিদেশি শাসন এ দেশকে চালিয়েছে, তাদের রাজভাষা ইংরেজি এবং আদালত পর্যন্ত, উচ্চ আদালত, হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট—এখানে রাজভাষার প্রচলন রয়েছে একইভাবে, যেভাবে ওরা চালাত ঠিক সেভাবে সে নিয়মেই চলছে। স্বাধীন বাংলাদেশে আদালতের নিয়ম, বিধিবিধান কিছুই বদলায়নি। স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রভাষা উচ্চ আদালতে ব্যবহৃত হয়নি, অথচ রাষ্ট্রভাষা বাংলা। স্বভাবতই আদালতে বাংলা ভাষার সর্বপ্রকার ব্যবহার উচিত বলে আমি মনে করি।

ভাষা আন্দোলনের চেতনার কথা শুনি। ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর পেরিয়েছে। এ চেতনা কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

আহমদ রফিক: যখন আমি বলি রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, তখন কিন্তু সমগ্র জাতির সামগ্রিক অধিকারের বিষয়টি সামনে আসে। যখন বলি সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করো তখন কিন্তু আরও বড় করে সাধারণ মানুষের স্বার্থের বিষয়টি সামনে চলে আসে।

প্রতি বছর শহীদ দিবস পালনের মধ্য দিয়ে যে গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশ হয়েছে, তার পথ ধরে শেষ পর্যন্ত ৬৯-এর গণআন্দোলন ও ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। স্বাধীনতার পর আমাদের প্রত্যাশা ছিল, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে; কিন্তু তা হয়েছে আংশিক। উচ্চশিক্ষা, বিজ্ঞান শিক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সর্বজনীন একুশের চেতনা বাস্তবায়ন হয়নি। এখনো তা বাস্তবায়নের অপেক্ষায়। এই চেতনা বাস্তবায়ন—এতে শুধু সরকারের দিক থেকে নয়, আমাদের শিক্ষিত শ্রেণির দিক থেকেও সদিচ্ছার অভাব আছে। ইংরেজি নিয়ে আমাদের মোহ আছে, এই মোহ থেকে বেরিয়ে এসে মাতৃভাষায় শিক্ষা-সংস্কৃতি চর্চায় মন দিতে হবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আফগানদের কাছে নাস্তানাবুদ হয়ে বাংলাদেশের সিরিজ হার

যুক্তরাষ্ট্রে ফুটবল ম্যাচ শেষে এলোপাতাড়ি গুলি, নিহত ৪

চট্টগ্রামে কনসার্টে গোলাগুলি, গুলিবিদ্ধ ১

চিহ্নিত ব্যক্তির দায় প্রতিষ্ঠানের ওপর দেওয়া উচিত নয় : বিএনপি

জবি তরুণ কলাম লেখক ফোরামের নেতৃত্বে ইমন-সোহান

এনসিপির ‘পলিসি ও রিসার্চ উইং’ গঠন, দায়িত্ব পেলেন যারা

নড়াইলে সাংবাদিকদের মিলনমেলা

‘তিন মাসের মধ্যে ৬ লেনের কাজ দৃশ্যমান হবে’

শাবিপ্রবির ২৫ শিক্ষার্থীর বহিষ্কারাদেশ বাতিলের সিদ্ধান্ত

ওমরজাইয়ের বোলিং তোপে বিপদে বাংলাদেশ

১০

প্রবীণদের পাশে আমাদের দাঁড়াতে হবে : টুকু

১১

শুধু বক্তব্যে নয়, বাস্তব কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে বিএনপি মানুষের পাশে রয়েছে : আনোয়ারুজ্জামান

১২

গুম-খুনে জড়িতদের সঙ্গে আপস নেই : আখতার হোসেন

১৩

বিএনপির নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান দুলুর

১৪

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে কাজ চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার

১৫

গুম-দুর্নীতি বন্ধে ধানের শীষে ভোট দিন : আশিক

১৬

গ্যাস লাইনে বিস্ফোরণ, ভাইয়ের পর চলে গেল বোনও

১৭

ইতিহাস গড়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারাল নামিবিয়া

১৮

জিয়া পরিবারের ত্যাগ দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য : কফিল উদ্দিন

১৯

বিএনপিকে ঘায়েল করতে চতুর্দিক থেকে ষড়যন্ত্র হচ্ছে : মির্জা ফখরুল

২০
X