দ্রাবিড় সৈকত
প্রকাশ : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০২:৪২ এএম
আপডেট : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৯:১০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ভাষার প্রশ্নই জাতির প্রশ্ন

ভাষার প্রশ্নই জাতির প্রশ্ন

ভাষাবিষয়ক অজস্র আলোচনা-সমালোচনা হয়ছে, হচ্ছে এবং হতে থাকবে। হাজারো বিশেষজ্ঞ মতামত তথ্য-উপাত্তে পরিপূর্ণ আলোচনাগুলোর সামনে একটি প্রশ্ন রাখতে চাই—ভাষা বিষয়ে আলোচনার উদ্দেশ্য কী: আত্মপরিচয়? যোগাযোগ? রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজনীতি? না বিশেষ দিবসে, বিশেষ মাসে বিষয়ভিত্তিক প্রাসঙ্গিকতা আনয়ন?

অপেক্ষাকৃত কম জটিল উত্তরটি বোধহয় যোগাযোগ। পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্যই ভাষা অপরিহার্য। তবে ভাষা যেমন যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে তেমনি ভেঙেও দিতে পারে। তাই আমরা সেতুবন্ধের দিকে যাচ্ছি, না বিচ্ছিন্নতার দিকে অগ্রসর হচ্ছি, তার একটি হদিস নিতে ভাষা উৎপত্তির ইতিহাসে আমাদের আবার দৃষ্টি দেওয়া দরকার।পৃথিবীর প্রায় হাজার তিনেক প্রধান-অপ্রধান ভাষায় মানুষ তাদের মনোভাব প্রকাশ করছে। এর মধ্যে ২৫-২৬টি ভাষা পরিবারে পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ কথা বলে। ভৌগোলিক অবস্থানের ভিত্তিতে, স্থানিক পরিবেশের ভিন্নতায় ভাষার প্রকাশভঙ্গি সুর, স্বর ও আঙ্গিকে আলাদা হয়ে গেছে। এই আলাদা বৈশিষ্ট্যে বিদ্যমান থাকা বা স্বতন্ত্র অবস্থানে টিকে থাকাই তার আত্মপরিচিতির অংশ।

ভাষা সম্পর্কিত ইতিহাস এবং গবেষণা গ্রন্থগুলো আমাদের ভাষার গতিবিধি, বিবর্তন, বৈচিত্র্য ও বিবিধ কাঠামো সম্পর্কে ধারণা দেয়। এসব ইতিহাস এবং গবেষণা গ্রন্থগুলোর প্রামাণিকতা বলতে তাদের নানাবিধ তথ্যসূত্রের উল্লেখপঞ্জি, এর অধিকাংশই আবার পূর্ববর্তী কোনো তথ্যের অনুবর্তী। মূল কাঠামোই নির্মিত হচ্ছে অন্যের উল্লিখিত সূত্রের ওপর ভর করে, এদের প্রধান সীমাবদ্ধতা হলো পূর্বোক্ত উপাত্তের ওপর অতি নির্ভরতা। এ নির্ভরতাগুলো ঝুঁকিপূর্ণ কারণ এসব তাত্ত্বিক কাঠামো পূর্ব পরিকল্পিত প্রকল্পের অংশ, প্রকল্পগুলো প্রমাণিত সত্য হিসেবে প্রতীয়মান করার জন্য এর স্বপক্ষে যুক্তি সিঁড়ি ব্যবহার করে তাকে প্রতিষ্ঠা দেওয়া হচ্ছে। তথ্যপঞ্জির ওপর মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরতা আমাদের বাস্তবতা থেকে ক্রমাগত দূরে সরিয়ে নিচ্ছে; প্রকৃতি ও পরিবেশ লব্ধ জ্ঞানের ভূমিকা গৌন থেকে গৌনতর হচ্ছে। আরেকটি লক্ষণীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বাংলা অঞ্চলে ভৌগোলিক কারণেই হোক অথবা মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতার কারণেই হোক, এখানে ডকুমেন্টেশনের কোনো প্রাচীন ধারা চলমান নেই, সুতরাং তথ্য আমাদের এমন উৎস থেকে জোগাড় করতে হয় যারা মোটেই আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী নয় বরং স্বেচ্ছাচারী দাম্ভিক শাসক শোষক তাত্ত্বিকদের থেকে আমরা যেসব প্রমাণ হাজির করি তার অধিকাংশই আত্মঘাতী। তাদের তথ্য সারণি বিন্যস্ত করে আমরা প্রমাণ করতে ব্যস্ত হই বাংলা ভাষার উৎপত্তির ইতিবৃত্ত। আর যেহেতু পুথিগত বিদ্যায় আমাদের ভরসা আছে সেহেতু বিনা প্রশ্নে আমরা সেসব সারণি থেকে পুনঃপুনঃ উদ্ধৃত করতেই থাকি। আদি পাপের মতোই জেনেছি আমরা বাঙালি এবং আমাদের উচ্চারিত বাংলা ভাষা মূলত পাপী, তাদের সঠিক পিতৃপরিচয় নেই, (সুপ্রাচীন কাল থেকেই প্রমাণপত্র জোগাড় করার দায় আমাদের ছিল না, ব্যক্তিকেন্দ্রিক আত্মম্ভরিতা বাংলায় ছিল না, পেটেন্ট-কপিরাইট-সার্টিফিকেটসর্বস্ব বিদ্যার ধারণা আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, আমাদের সুপ্রাচীন সর্বজনবিদিত মসলিনকেও জিআই প্রত্যয়নপত্র নিতে হয়, ইলিশেরও জিআই পাওয়া হয়ে গেছে, এমনি করে বাংলার পুকুর-নদী-জলবায়ু-ভাষা প্রত্যায়িত সনদ ছাড়া আমাদের নয়। বিজ্ঞানী জগদীশ বসু রেডিও আবিষ্কারের স্বত্ব নিজের নামে লিখিয়ে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন, মার্কনি ঠিকই নিজের নাম আবিষ্কর্তার স্থানে বসিয়েছেন; এখানেই জীবনদর্শনের পার্থক্য; এই পার্থক্যটুকু না বুঝলে ভাষার ইতিহাস বোঝা যাবে না)। সঠিক ঠিকুজি নির্ণয়ের জন্য যত প্রমাণপত্র জোগাড় করতে হয় তার কিছুই আমরা রাখিনি, রাখার প্রয়োজন বোধ করিনি কিন্তু এখন বড় দায়ে পড়ে যাওয়া অবস্থায় আমরা হন্যে হয়ে পরিচিতি খুঁজে আধাখ্যাঁচরা একটা কিছু দাঁড় করিয়ে ইজ্জত রক্ষার তাগিদে পেরেশান হয়ে আছি। সুতরাং তথ্যপঞ্জি সংগ্রহ করো এবং প্রমাণ করো বাংলা কোন ভাষা থেকে এসেছে (তাকে কারও না কারও উদর থেকে বের হতেই হবে)। পুথিগত বিদ্যার এই হলো পরিণাম। বাংলার ভৌগোলিক বিন্যাস কখনো আমাদের চোখে পড়ে না, এখানে একটি স্বয়ম্ভু ভাষা থাকতে পারে, এই ভূগোল একটি ভাষার জন্মভূমি হতে পারে এমন ধারণার সম্ভাবনাও আমরা স্বীকার করতে প্রস্তুত নই। পুথি আমাদের কেন্দ্র চিনিয়েছে, প্রান্ত সম্পর্কে ধারণা দিয়েছে। প্রান্তে কিছুই তৈরি হয় না, এটিও শিখিয়েছে। আমরা একটি অতি সাধারণ প্রশ্ন করতে চাই—বাংলা কি এই অঞ্চলে কোনো স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে জন্ম নিতে পারে? যার কিছু অংশকে আমরা মাঝেমধ্যে দেশি ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করি?

আমাদের নমস্য বিদ্বান ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ লিখেছেন—‘নৃতত্ত্ববিদদের কথা মানিতে গেলে আমাদিগকে বলিতে হইবে যে জাতিগত পার্থক্য সত্ত্বেও এক মূলভাষা বহু যুগের বহু স্থানের বহু লোকের মুখে মুখে ধারাবাহিক পরিবর্তনের ফলে আমাদের বর্তমান বাঙ্গালায় আসিয়াছে।’ তাহলে এই বাংলা ভাষা এখানে আসিয়াছে; কেন? এই ভাষা আসার আগে এই অঞ্চলের মানুষ কি নির্বাক ছিল? তিনি বলেছেন ‘নৃতত্ত্ববিদদের কথা মানিতে গেলে’, নৃতত্ত্ববিদ কারা? এর উৎপত্তি এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমাদের কি কিছুই জানা নেই? কোন কোন জাতিকে নৃতত্ত্ববিদগণ শ্রেষ্ঠ এবং কোন কোন জাতিকে নিকৃষ্ট বর্বর হিসেবে চিহ্নিত করেন? কেন করেন? সবই নির্দোষ গবেষণা? রিজলি, রমাপ্রসাদ চন্দ, বিরজা শংকর গুহসহ অনেকেই বাঙালিকে বিচার করেছেন—মাথা, কপাল, নাক, ঠোঁট কিংবা চোখ, চুল, চামড়া পরীক্ষার মাধ্যমে; একটু গভীর দৃষ্টি দিলেই বোঝা যাবে এ পরীক্ষাগুলো বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির নামে কতটা হাস্যকরভাবে শিশুসুলভ। বাংলার আরেকজন নমস্য পণ্ডিত ড. আহমদ শরীফ বাঙালির রক্তধারায় মিশ্রণ সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন—‘শতকরা ষাট ভাগ অস্ট্রেলীয়, বিশ ভাগ মঙ্গোলীয়, পনের ভাগ নেগ্রিটো এবং পাঁচ ভাগ অন্য নানা নরগোষ্ঠীর রক্ত মিশেছে বলে অনুমান করা অসংগত নয়।’ এভাবে শতভাগ দূষিত রক্তের সংকর জাতির ভাষাও সংকর এবং বিদেশাগত হবে এই চিন্তাই তো স্বাভাবিক। পুথিগত বিদ্যা এবং তার ওপর অতি নির্ভরতার ফল হলো এই যে, আমাদের সর্বজন শ্রদ্ধেয় পণ্ডিত ব্যক্তিরাও স্বাধীনভাবে ভাবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। মনের অজান্তেই জাতির ওপর, ভাষার ওপর চাপিয়ে দেন অমোচনীয় কালির ঘোর অন্ধকার। যদি আমরা ভাবতে পারতাম বাঙালি জাতির উৎপত্তি এই বাংলা ভূগোলেই, তাহলে সহজেই ভাবা যেত তাদের একটি ভাষা ছিল যার বর্তমান নাম বাংলা ভাষা। যখন আমরা পুথিপত্রের ভাষ্যের সঙ্গে মিলিয়ে নিজেদের বহিরাগত হিসেবে প্রমাণ করছি তখন ভাষার বহিরাগত হওয়া ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা থাকে না; কাজেই ভাষার প্রশ্ন প্রথমেই জাতির প্রশ্ন। মহাজাতি কিংবা মহাভাষার কাল্পনিক প্রকল্পগুলো নানাবিধ বৈজ্ঞানিক নিরীক্ষা ও পরীক্ষার নামে অনেকটাই অকাট্য করে তোলা হয়েছে, পরিস্থিতি এমন যে, কেউ এখন প্রশ্নগুলো উত্থাপনেই দ্বিধান্বিত থাকেন কারণ তার হাতে পাশ্চাত্য পন্থায় কোনো প্রমাণ নেই। তবে বাস্তব অবস্থা কিন্তু সম্পূর্ণ উল্টো সাক্ষ্য দিচ্ছে, বলছে ভিন্ন কোনো সমীকরণের কথা, কারণ আমাদের হাতে আছে ভৌগোলিক ও প্রকৃতি সমর্থিত বাস্তবতা। অযথা ক্ষিপ্ত না হয়ে ভাবতে বসুন, সভ্যতার সূচনা হওয়ার জন্য কী কী অনুষঙ্গের উপস্থিতি প্রয়োজন, এর কোনটি সৃষ্টির শুরু থেকেই এ উপমহাদেশে অনুপস্থিত অথবা আপনি যেসব তীর্থভূমিকে সভ্যতার জন্মস্থান হিসেবে চিনে এসেছেন তাদের শ্রেষ্ঠত্ব কোন কোন বিষয়ে যে সেখানেই ভাষা-সভ্যতা-মানুষের জন্ম হতে হলো? আমরা ভুলে গেছি, শিখিয়ে দেওয়া, উদ্ধৃত করা বুলি ও তথ্যের বাইরে একটি বিশাল জগৎ পড়ে আছে। সেই জগতের ভাষা, স্থানীয় পরিচয় ও বিভিন্ন সংকেত আছে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর অনুসারীকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা

চাঁদাবাজদের উপযুক্ত জবাব দেওয়া হবে : কফিল উদ্দিন

ডাকসুর জিএস ফরহাদ হোসেনকে রাঙামাটিতে সংবর্ধনা

পুলিশ সদস্যদের হামলা ও অপদস্তের প্রতিবাদ দুই সংগঠনের 

ফুটপাতে পাওয়া সেই নবজাতককে নিতে চান ২৩ দম্পতি

আগামী বছর থেকে ফুটবল ক্যালেন্ডারে আসছে বড় পরিবর্তন

ট্রাম্পের জন্মদিনে হোয়াইট হাউসে ইতিহাস রচনা করবে ইউএফসি লড়াই

বিএনপি ক্ষমতায় গেলে শিক্ষা সংস্কার কমিশন করা হবে : তারেক রহমান

আধুনিক যন্ত্রেই নিশ্চিত হবে নিরাপদ খাদ্য : মেয়র শাহাদাত

শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচন স্থগিত

১০

একযোগে গণঅধিকার পরিষদের ৩৬ নেতার পদত্যাগ

১১

মেঘনা নদীতে নৌযানে চাঁদাবাজি, সংঘর্ষে পুলিশসহ আহত ৫

১২

ইরাক থেকে প্রচুর তেল নিচ্ছে চীন-ভারত

১৩

‘রোহিত-বিরাটের বিদায়ের পিছনে দায় গম্ভীরের’

১৪

৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ, এনবিআরের সদস্য বেলালের নামে দুদকের মামলা

১৫

ঢাকার আদালতে ১৩৫ কোটি টাকার মাদক ধ্বংস

১৬

আ.লীগ নেতার হিমাগারে সেফটিপিন ফুটিয়ে তিন ভাইবোনকে নির্যাতন

১৭

ক্রিকেট বোর্ডের নির্বাচনে সরকারের হস্তক্ষেপের প্রমাণ আছে : আমিনুল হক

১৮

প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এসএসএফ স্টাফ কারাগারে

১৯

ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে কাজের সুযোগ, আবেদন যেভাবে

২০
X