নাটোরের বাগাতিপাড়ার সরু মেঠো পথ ধরে যেতে হয় প্রত্যন্ত সান্যালপাড়া গ্রামে। ওই গ্রামের টিনের জীর্ণ কুটিরে বেড়ে ওঠা কিশোরী কনা আক্তারের। দুর্গম গ্রামের কাদামাখা উঠানে দৌড়ঝাঁপ করা কিশোরী আজ বাংলাদেশের হকির উজ্জ্বল নাম!
দারিদ্র্যের সঙ্গে ছিল রক্ষণশীল সমাজের চোখরাঙানি। দুটিকে উপেক্ষা করা ছিল যুদ্ধজয়ের মতো! দিনমজুর বাবা আবু বক্করের রোজগারে চলে ছয় সদস্যের পরিবার। মা চামেলী বেগম অভাবের সংসারে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জারি রেখেছেন এখনো। যেখানে তিন বেলা খাবারের জোগাড় করাই চ্যালেঞ্জ, সেখানে খেলাধুলা তো বিলাসিতা। সেটা যদি হয় হকির মতো বিশেষায়িত, ব্যয়বহুল খেলা—তবে তো কথাই নেই। তবুও স্বপ্ন থামেনি, থামেনি কনার এগিয়ে চলা। সহোদর বীনাকে দেখেই খেলার প্রতি আগ্রহ জন্মায় কনার। বীনা ফুটবলে পারদর্শী ছিলেন, খেলেছেন বিভাগীয় পর্যায়ে। কিন্তু অর্থকষ্ট আর সামাজিক চাপের কাছে হার মেনে অষ্টম শ্রেণিতেই বিয়ে হয়ে যায়, এক প্রতিভার স্বপ্নযাত্রা। সেই থেকেই যেন নতুন শপথ নেয় কনা।
শীতের কুয়াশামাখা ভোরে যখন সারা গ্রাম ঘুমিয়ে, তখন মাঠে ছুটত কনা। পরিবারের সদস্যদের লুকিয়ে প্রতিদিনের কঠোর অনুশীলন ছিল তার রুটিন। সে সময় তার পাশে ছিলেন সান্যালপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৎকালীন শিক্ষক কামরুল হাসান। যিনি শুধু শিক্ষক নন, ছিলেন কনার অনুপ্রেরণা, পথপ্রদর্শক! কামরুল হাসানের উদ্যোগে ২০২১ সালে বিকেএসপির রাজশাহী অঞ্চলের বাছাইয়ে অংশ নেয় কনা। টাকা ধার করে ট্রায়ালে গিয়ে হকি, ফুটবল ও জিমন্যাস্টিকস তিন ডিসিপ্লিনে নির্বাচিত হয় সে। হকি ও জিমন্যাস্টিকসে প্রথম স্থান অর্জন করে কনা, আর ফুটবলে হয় ২৩তম। শেষ পর্যন্ত হকিকে বেছে নেয় সে।
কিন্তু বিকেএসপিতে ভর্তিতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় ৩৫ হাজার টাকা। টাকার অভাবে যখন সুযোগ হারানোর আশঙ্কা তৈরি হয়, তখন ছাগল-হাঁস বিক্রির পাশাপাশি মানুষের সহায়তায় বিকেএসপিতে ভর্তির ব্যবস্থা হয়েছিল। ওটাই ছিল ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট। এখান থেকেই পেশাদার হকির যাত্রা শুরু। বিকেএসপিতে ভর্তির দুই বছরের মধ্যে জাতীয় পর্যায়ের কার্যক্রমে যুক্ত হয় কনা—অনূর্ধ্ব-২১ এএইচএফ কাপ দিয়ে হয়েছে আন্তর্জাতিক অভিষেক। পরে সিঙ্গাপুর, ওমান ঘুরে সর্বশেষ ২০২৫ সালে চীনের দাঝুতে অনূর্ধ্ব-১৮ এশিয়া কাপে অংশ নেয় কনা। আসরের ৭ ম্যাচের দুটিতে ম্যাচসেরা হয়েছে কনা।
উত্তরণে সবচেয়ে বড় ভূমিকা মা চামেলী বেগমের। মেয়ের উঠে আসার পথে নানা লড়াই-সংগ্রামের গল্পটা এভাবে বললেন চামেলী বেগম, ‘অনেক কথা শুনতে হয়েছে; কিন্তু আজ মেয়ের অবস্থানই সঠিক জবাব। অনেক কষ্ট হয়েছে। ইচ্ছার জোরেই এ পর্যন্ত এসেছে সে।’ কনার অনুপ্রেরণার উৎস শিক্ষক কামরুল হাসান বলেন, ‘কনার মধ্যে অদম্য স্পৃহা ছিল। শুধু একটু সহায়তা পেলেই একটি প্রতিভা কত দূর এগিয়ে যেতে পারে, কনা তার প্রমাণ। এখনো তার পরিবার আর্থিক সংকটে রয়েছে। বিকেএসপির ১২ মাসের বেতন এখনো বাকি।’ দেশের হয়ে নিয়মিত খেলা, দেশকে আরও উচ্চতা নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখা কনা চায় হকির মাধ্যমে অভাব তাড়াতে!
মন্তব্য করুন