প্রতিবারের মতো এবারও বর্ষা মৌসুমের আগমনে পদ্মাপাড়ে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ ও আতঙ্ক। বর্ষা এলেই পদ্মা রূপ নেয় চিরচেনা আগ্রাসী ধারায়। শরীয়তপুরের জাজিরার পদ্মার তীরবর্তী এলাকার মানুষ প্রতি বছরই এই সময়টায় উদ্বিগ্ন থাকেন। তবে এ বছর উদ্বেগের মাত্রা বেড়েছে বহুগুণ। কারণ, পদ্মা সেতু প্রকল্পের পূর্ব পাশের দুই কিলোমিটার রক্ষা বাঁধটি চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সম্প্রতি এক সমীক্ষার ভিত্তিতে জানিয়েছে, বর্ষা মৌসুমে এই বাঁধের একাধিক স্থানে বড় ধরনের ভাঙন দেখা দিতে পারে।
সমীক্ষা অনুযায়ী, নদীর তলদেশের গভীরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং তীরে অতিরিক্ত চাপে মাটি সরে যাওয়ায় বাঁধটির একটি বড় অংশ এরই মধ্যে দুর্বল হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে, জাজিরা উপজেলার নাওডোবা ইউনিয়নের মঙ্গল মাঝি-সাত্তার মাদবর বাজার, পালেরচর এবং আশপাশের আরও অন্তত চার গ্রামের প্রায় পাঁচ শতাধিক পরিবার এখন সরাসরি ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে। এসব এলাকার মানুষের ঘরবাড়ি, কৃষিজমি, স্কুল, হাটবাজার এমনকি কবরস্থানও বিপন্ন হয়ে উঠেছে।
গত বছরের নভেম্বরে পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তের নাওডোবা জিরোপয়েন্ট এলাকায় বাঁধের প্রায় ১০০ মিটার অংশ নদীতে ধসে পড়ে। নদীগর্ভে তলিয়ে যায় সিসি ব্লকসহ কংক্রিটের নির্মাণসামগ্রী। সেই ঘটনার পর পাউবো এবং বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ) যৌথভাবে সমীক্ষা চালায়। সমীক্ষায় উঠে আসে, এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নদীর গভীরতা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাঁধের নিচের মাটি সরে যাচ্ছে। বাকি এক কিলোমিটারের ক্ষেত্রে নদীর গতিপথ সরাসরি বাঁধের গা ঘেঁষে চলে এসেছে। সেখানেও মাটি ভেঙে নদীতে পড়ছে।
পাউবো ও স্থানীয় সূত্র জানায়, ২০১০-১১ অর্থবছরে পদ্মা সেতু প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ) ১১০ কোটি টাকা ব্যয়ে নাওডোবা আলমখাঁরকান্দি জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত মাঝিরঘাট হয়ে দুই কিলোমিটার রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করে। তখন এই বাঁধটি সেতু প্রকল্পের বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হতো। দীর্ঘদিনেও পূর্ণ সংস্কার বা টেকসই উন্নয়ন হয়নি। ফলে বছরের পর বছর নদীর ভাঙনে বাঁধটি দুর্বল হয়ে পড়ে। ২০২৩ সালের ৩ নভেম্বর থেকে ধীরে ধীরে মাঝিরঘাট এলাকায় ধস শুরু হয়। ১৬ নভেম্বরের মধ্যেই ১০০ মিটার এলাকা ধসে পড়ে। নদীতে তলিয়ে যায় সিসি ব্লকসহ বাঁধের সুরক্ষাব্যবস্থা। এরপর এলাকাজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয়রা প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বাঁধটির পুনর্নির্মাণের দায়িত্ব পায় পাউবো। প্রাথমিকভাবে ধসে যাওয়া অংশে ২ কোটি ৮৭ লাখ টাকা ব্যয়ে বালুভর্তি জিওব্যাগ এবং নতুন সিসি ব্লক বসানোর কাজ শুরু হয়। তবে বাঁধের বাকি অংশ এখনো ঝুঁকিমুক্ত নয়।
নদীর গভীরতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে স্থানীয়রা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অবৈধ বালু উত্তোলনকে দায়ী করেছেন। স্থানীয়দের দাবি, প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে কিংবা কখনো সরাসরি প্রশাসনের মদদে এই অবৈধ কার্যক্রম দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। ফলে নদীর তলদেশের গঠন অসম হয়ে যাচ্ছে, স্রোত তীরের মাটিকে দুর্বল করে ফেলছে। এর প্রভাবে শুধু রক্ষা বাঁধ নয়, আশপাশের পুরো জনপদ এখন নদীভাঙনের মুখে। স্থানীয়দের দাবি পদ্মা নদীর এই ভয়াবহ ভাঙন প্রতিরোধে এখনই যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে শুধু সেতু প্রকল্পই নয়, বরং পুরো এলাকার জনজীবন হুমকির মুখে পড়বে।
বাঁধসংলগ্ন এলাকার আরেক বাসিন্দা জলিল তালুকদার বলেন, ‘নদী এখন একেবারে আমাদের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। গতবারও বাঁধের অনেকটা অংশ ভেঙে গেছে। এবার তো মনে হচ্ছে পুরো বাঁধটাই ভেঙে যাবে। যদি সরকার একটি মজবুত বাঁধ নির্মাণ করত, তাহলে আমাদের ঘরবাড়ি রক্ষা পেত।’
ভাঙনকবলিত এলাকার কেয়া আক্তার বলেন, ‘এই বাঁধ বহুবছর আগে তৈরি করা হয়েছে। এখন পদ্মা নদী ভাঙতে ভাঙতে একেবারে বাঁধের গায়ে এসে লাগছে। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে আমাদের বাড়িঘর নদীতে চলে যাবে। আমরা চাই আমাদের জমিজমা ও ঘরবাড়ি যেন রক্ষা পায়।’
পাউবো শরীয়তপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ তারেক হাসান বলেন, ‘পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকার রক্ষায় সেতু কর্তৃপক্ষের দুই কিলোমিটার বাঁধ প্রায় একযুগ আগের। বর্তমানে এটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। পাউবো এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ে টেকসই বাঁধ নির্মাণের জন্য প্রস্তাব পাঠিয়েছে। অনুমোদন মিললেই কাজ শুরু হবে।
মন্তব্য করুন