কৌশলে মিটারবিহীন আবাসিক গ্রাহকপ্রতি গ্যাসের বরাদ্দ বাড়িয়ে বেশি বিল আদায় করতে চায় তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। এজন্য একজন গ্রাহকের বিপরীতে বর্তমানে যে পরিমাণ গ্যাস বরাদ্দ রয়েছে, তা বাড়াতে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে প্রস্তাব করেছে দেশের সবচেয়ে বড় বিতরণী কোম্পানিটি। বর্তমানে কোম্পানির মিটারবিহীন গ্রাহক প্রায় ৩৪ লাখ। তিতাসের প্রস্তাব অনুযায়ী গ্যাসের বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ানো হলে এক চুলার বিপরীতে মাসে সোয়া ১৩ কোটি টাকা আদায় হবে। দুই চুলার ক্ষেত্রে আসবে প্রায় সাড়ে ১৭ কোটি টাকা।
গ্যাসের বরাদ্দ বাড়াতে তিতাসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মিটারবিহীন আবাসিক গ্রাহকরা বর্তমানে বরাদ্দের চেয়ে বেশি গ্যাস ব্যবহার করে। এই বেশি ব্যবহার করায় সিস্টেম লসের পরিমাণ বেড়ে গেছে। তাই বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ালে সিস্টেম লস কমে আসবে। প্রস্তাবটি আমলে নিয়েছে বিইআরসি। শিগগির এটি কমিশনের সভায় উত্থাপন করা হবে। পাশাপাশি অন্যান্য বিতরণ কোম্পানির এমন কোনো দাবি আছে কি না, তা জানতে চেয়ে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়েছে সংস্থাটি।
বিইআরসি চেয়ারম্যান নুরুল আমিন এ প্রসঙ্গে কালবেলাকে বলেন, তিতাস গ্যাস থেকে একটি প্রস্তাব এসেছে। আমরা সেটি শিগগির কমিশনের সভায় উত্থাপন করব। পাশাপাশি অন্যান্য বিতরণ কোম্পানির একই দাবি আছে কি না, তা জানতে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানকে আমরা চিঠি দিয়েছি। এজন্য গণশুনানি করা হবে কি না—এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, কমিশনের সভায় সে সিদ্ধান্ত হবে। কেন তিতাস এমন প্রস্তাব দিয়েছে, জানতে চাইলে চেয়ারম্যান এ বিষয়ে কিছু বলতে চাননি।
বিইআরসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, তিতাসের আওতাধীন এলাকায় বর্তমানে মিটারবিহীন গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় ৩৪ লাখ। তিতাস বর্তমানে এক চুলার বিপরীতে বরাদ্দকৃত গ্যাসের পরিমাণ ৫৫ ঘনমিটার থেকে বাড়িয়ে ৭৬ দশমিক ৬৫ ঘনমিটার করার প্রস্তাব করেছে। প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ১৮ টাকা। এই হিসাবে বর্তমানে এক চুলার বিল ৯৯০ টাকা। প্রস্তাব অনুযায়ী বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ানো হলে এক চুলার বিল ১ হাজার ৩৭৯ দশমিক ৭ টাকা। চুলাপ্রতি বাড়বে ৩৮৯ দশমিক ৭ টাকা। ৩৪ লাখ গ্রাহক হিসাবে প্রতি মাসে বিল বাবদ ১৩ কোটি ২৪ লাখ ৯৮ হাজার টাকা বেশি আদায় হবে। একইভাবে দুই চুলার বিপরীতে বর্তমান বরাদ্দ ৬০ ঘনমিটার থেকে বাড়িয়ে ৮৮ দশমিক ৪৪ ঘনমিটার করার প্রস্তাব করেছে। বর্তমানে দুই চুলার মাসিক বিল ১ হাজার ৮০ টাকা। বরাদ্দ বাড়লে টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ দাঁড়াবে ১ হাজার ৫৯১ দশমিক ৯২ টাকা। চুলাপ্রতি বাড়বে ৫১১ দশমিক ৯২ টাকা। ৩৪ লাখ গ্রাহক হিসেবে বাড়তি ১৭ কোটি ৪০ লাখ ৫২ হাজার ৮০০ টাকা।
ওই কর্মকর্তা জানান, গত মে মাসে এই আবেদন করে তিতাস গ্যাস। ওই সময় বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হলে বিইআরসি এ-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত থাকে। সম্প্রতি পুনরায় তিতাসের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হলে প্রস্তাবটি বিবেচনার কার্যক্রম শুরু করেছে বিইআরসি।
সর্বশেষ গত বছরের ৫ জুন আবাসিকসহ সব শ্রেণির গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির ঘোষণা বিইআরসির। এর আগে মার্চ মাসে গণশুনানি করে সংস্থাটি। ওই সময় বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রি-পেইড মিটারে গ্যাস ব্যবহারের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রি-পেইড গ্রাহকরা মাসে এক চুলায় গড়ে ৪০ ঘনমিটার ও দুই চুলায় সর্বোচ্চ ৫০ ঘনমিটার ব্যবহার করছে। প্রি-পেইড গ্রাহকের ব্যবহারের পরিসংখ্যান বিবেচনায় নিয়ে মিটারবিহীন গ্রাহকদের ক্ষেত্রে এক চুলা ৭৩ দশমিক ৪১ ঘনমিটার থেকে কমিয়ে ৫৫ ঘনমিটার এবং দুই
চুলা ৭৭ দশমিক ৪১ ঘনমিটার থেকে কমিয়ে ৬০ ঘনমিটার করা হয়।
ওই সময় বিইআরসির সদস্য (গ্যাস) দায়িত্বে ছিলেন পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান মকবুল-ই-এলাহী চৌধুরী। বিষয়টি নিয়ে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মিটারবিহীন গ্রাহকদের বর্তমানে যে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে, তার চেয়ে কম ব্যবহার হচ্ছে। ফলে বরাদ্দ কমানো উচিত। তিনি বলেন, প্রি-পেইড গ্রাহকরা মাসে কী পরিমাণ ব্যবহার করে, সেটি আমলে নিলেই এটি পরিষ্কার হয়ে যাবে। তিনি বলেন, গত বছর যখন গ্রাহকপ্রতি গ্যাসের বরাদ্দ কমানো হয়, তখন তিতাসকে প্রি-পেইড গ্রাহকদের মাসে কী পরিমাণ ব্যবহার হয়, তা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল। ওই সময় দেখা গেছে, একজন প্রি-পেইড গ্রাহক মাসে গড়ে ৪৫ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার করে। এটি আমলে নিয়েই গ্রাহকপ্রতি বরাদ্দ নির্ধারণ করে দাম ঠিক করা হয়েছিল।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, চুরির কারণে তিতাসের সিস্টেম লস বেড়ে গেলেও এখন কোম্পানিটি গ্রাহকদের ব্যবহারের ওপর দায় চাপাতে চাইছে। প্রি-পেইড মিটার বসানোর আগে অনেকেরই ধারণা ছিল আবাসিকে বরাদ্দের চেয়ে বেশি গ্যাস ব্যবহার হচ্ছে। তবে ২০১৬ সালে রাজধানীর লালমাটিয়ায় প্রথমবারের মতো গ্যাসের প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের পর দেখা যায়, এক চুলা ও দুই চুলা গ্রাহকদের মাসিক বিল দুই থেকে আড়াইশ টাকা। আর ওই সময় মিটারবিহীন গ্রাহকে থেকে আদায় করা হতো দুই চুলা সাড়ে চারশ টাকা।
পরে গ্যাসের ব্যবহারের বিপরীতে বিল বৈষম্য দূর করতে ২০১৮ সালে বিইআরসি গ্যাসের দাম বৃদ্ধির আদেশে দ্রুত প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের আদেশ দেন। আদেশে গ্রাহক যাতে নিজেরা মার্কেট থেকে মিটার কিনে স্থাপন করতে পারে, সেই সুবিধা উন্মুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। পরে দীর্ঘদিন পর একটি নীতিমালা করা হয়। নীতিমালায় বলা হয়, গ্রাহক নিজের পছন্দমতো দোকান থেকে মিটার ক্রয় করে বিতরণ কোম্পানিতে জমা দেবেন। বিতরণ কোম্পানিগুলো পরীক্ষা করে গ্রাহকের আঙিনায় স্থাপন করবে। তবে নীতিমালা আমলে নেয়নি বিতরণ কোম্পানিগুলো। বরং কোম্পানিগুলো নির্দিষ্ট মিটার বেশি দামে কিনতে বাধ্য করছে গ্রাহকদের।
২০২২ সালে প্রি-পেইড মিটার সংক্রান্ত একটি চিঠি ইস্যু করে বিইআরসি। এতে বলা হয়, ২০১৮ সালের ১৬ অক্টোবর গেজেটে পর্যায়ক্রমে সব আবাসিকে প্রি-পেইড গ্যাস মিটার স্থাপনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে এ বিষয় বিতরণ কোম্পানিগুলোর গৃহীত ব্যবস্থা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নয়। নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে প্রি-পেইড মিটার স্থাপন কার্যক্রম ত্বরান্বিত হবে বলে কমিশন আশা করে। আবাসিকের সব গ্রাহক প্রি-পেইড মিটার ব্যব্হার করলে চুলাপ্রতি ৩৩ ঘনমিটার গ্যাস সাশ্রয় হবে। এতে বছরে ৫৩ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সাশ্রয় হবে।