বিদেশের মাটিতে দিন দিন চাহিদা কমছে দেশীয় চিংড়ির। গত এক দশকে রপ্তানি কমেছে ২২ হাজার টনের বেশি হিমায়িত চিংড়ি, যার বাজার দর আনুমানিক ২৫ কোটি ডলার। অন্যদিকে নানা সংকটে গত দুই দশকে চট্টগ্রামে ব্যবসা গুটিয়েছে অর্ধেকের বেশি মাছ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে ৫৪ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৪টি চালু থাকলেও এর মধ্যেও বন্ধ হওয়ার উপক্রম আরও কয়েকটির। বাকি ৩০ প্রতিষ্ঠান পুরোপুরি বন্ধ।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিদেশে চিংড়ির চাহিদা বেশি; কিন্তু হিমায়িত সাদা মাছের চাহিদা কম। বাংলাদেশে ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন না হওয়ায় অন্যান্য চিংড়ির রপ্তানি কমে যাওয়ায় বাজারে টিকতে পারছে না ব্যবসায়ীরা।
খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদেশে চিংড়ির চাহিদা থাকে ৯০ শতাংশ। যার বেশিরভাগই ভেনামি চিংড়ি। কিন্তু বাংলাদেশে ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন সেভাবে না হওয়ায় গলদা বা বাগদা চিংড়ি রপ্তানি করতে হচ্ছে। এ চিংড়ির বৈদেশিক চাহিদা না থাকায় দেশীয় যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত ছিল, তারা বিদেশে অর্ডার না পাওয়ায় তা-ও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার খরচ তোলা এবং ব্যাংকের ঋণ বা সুদ টানতে গিয়ে দেশীয় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
জানা যায়, এক হেক্টর জমিতে গলদা চিংড়ির তুলনায় ভেনামির উৎপাদন অন্তত ১০ গুণ বেশি হয়ে থাকে। গলদার দামও পাওয়া যায় তুলনামূলক কম। যে কারণে ভেনামি চিংড়ির উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে এর প্রভাব পড়বে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের খাত ও কর্মসংস্থানে।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) সিনিয়র সহসভাপতি আশরাফুল হোসেন মাসুদ জানান, মৎস্য অধিদপ্তরের আওতাধীন কক্সবাজারের চকোরিয়া-রামপুরায় চিংড়ি জোন হিসেবে ঘোষিত ৭ হাজার একর জমিতে ভেনামি চিংড়ির চাষ করতে হবে। কক্সবাজার এবং খুলনার পাইকগাছা বা বটিয়াঘাটাতে দুটি চিংড়ি ইকোনমিক জোন তৈরি করতে হবে। বেসরকারি উদ্যোগে চিংড়ি চাষের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আনতে হবে। ১২ থেকে ১৩ শতাংশ বিভিন্ন খাতে যে ট্যাক্স দিতে হয় তা কমিয়ে আনতে হবে।
মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ দপ্তরের তথ্যমতে, চট্টগ্রামে ২০০৬ সালে প্রায় ৫৪টি প্রতিষ্ঠান রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত ছিল। ২০২২ সালে ২৭টি রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও ২০২৩ সালে নিবন্ধন নিয়েছে মাত্র ২৪টি। অর্থাৎ দেড় যুগে শুধু চট্টগ্রামের ৩০টি প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছে। ২৪টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে গড়ে ১০ থেকে ১২টি তাদের কার্যক্রম পূর্ণাঙ্গভাবে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাকিগুলো চলছে কোনোরকমে। গত দেড় যুগে বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম মিনহার সি ফুড লিমিটেড ও মিনহার ফিশারিজ। এ ছাড়া ফিশ প্রিজারভার লিমিটেড, আকুয়া ফুড, কনসেফশন সি ফুড লিমিটেড, কুলিয়ারচর সি ফুড, সার অ্যান্ড কোং লিমিটেড ও মাহী ফিশ কোম্পানি অন্যতম। প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিষয়ে ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিদেশে চিংড়ির চাহিদা বেশি; কিন্তু হিমায়িত সাদা মাছের চাহিদা কম। বাংলাদেশে ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন না হওয়ায় অন্যান্য চিংড়ির রপ্তানি কমে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা বাজারে টিকতে পারেননি।
বিএফএফইএ’র পরিসংখ্যান বলছে, দেশে মৎস্য রপ্তানি খাতে যুক্ত আছে ১০৮ প্রতিষ্ঠান। সর্বশেষ ২০২৩ সালে চালু ছিল ৪০টির মতো। এর মধ্যে গড়ে ২০টি প্রতিষ্ঠান উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণের কাজ করছে। বাকিগুলো কোনোরকমে চালু আছে। রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর মৎস্য প্রক্রিয়াকরণের ক্ষমতা ৪ লাখ ৫০ হাজার টন হলেও মাত্র ৩০ থেকে ৪০ হাজার টন ধারণক্ষমতা ব্যবহার হচ্ছে। অর্থাৎ প্রায় ৮৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্ষমতা অব্যবহৃত আছে। দেশের প্রায় ২ লাখ ৬২ হাজার ৯৮০ হেক্টর জমিতে চিংড়ি চাষ হয়ে থাকে। এর মধ্যে প্রায় ২ লাখ হেক্টরে চাষ হয় বাগদা চিংড়ির। বাগদা হ্যাচারি ৫০টি ও গলদার হ্যাচারি রয়েছে ৩৯টি।
গবেষকরা জানান, বর্তমানে এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে ভারত, মিয়ানমার, তাইওয়ান, চীন, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইনসহ বিভিন্ন দেশে এ ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন করা হচ্ছে, যা ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে সরাসরি রপ্তানি করছে তারা। এশিয়ার অন্য দেশগুলো যেখানে ১৯৮৩ সাল পরবর্তী ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন শুরু করেছে, সেখানে বাংলাদেশের চাষিরা ২০২৪ সালে এসেও ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন হবে কি না, তা নিয়ে এখনো গবেষণা করছে। যার কারণে প্রতি বছর চিংড়ি রপ্তানিতে নিম্নমুখী অবস্থানে বাংলাদেশ।
সংগঠনের দেওয়া রপ্তানির তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৫৫ কোটি ডলারের ৪৭ হাজার ৬৩৫ টন হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি করা হয়। সেখানে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৫ হাজার টনের ৩০ কোটি ২ লাখ ডলারের হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি হয়েছে। অর্থাৎ গত এক দশকে ২২ হাজার টনের বেশি হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি কমেছে। যার বাজার দর ২৫ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) চিংড়ি ও হিমায়িত মাছ রপ্তানি হয়েছে ২১৫ মিলিয়ন ডলার। যেখানে এই সময়সীমার মধ্যে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২২৮ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এই সময়ে প্রায় ৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ রপ্তানি কম করেছে বাংলাদেশ।
বিএফএফইএর সভাপতি কাজী বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘প্রক্রিয়াকরণ মাছ রপ্তানিতে এক সময় নেতৃত্ব দিতেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা। কিন্তু গত কয়েক বছর শুধু চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা নন দেশের প্রতিটি অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। দেশে উৎপাদন বৃদ্ধি ঠিকই হচ্ছে, তবে বিদেশিদের চিংড়ির চাহিদা আমরা পূরণ করতে পারছি না। এ কারণে রপ্তানি কমে আসছে।’
চট্টগ্রামের মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ দপ্তরের উপপরিচালক শাহজাদা খসরু বলেন, ‘বিদেশে ভেনামি চিংড়ির চাহিদা বেশি। কিন্তু দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো চাহিদা অনুযায়ী হিমায়িত মাছ সরবরাহ করতে পারছে না। রপ্তানিকারক দেশে চাহিদা অনুযায়ী যদি মাছ সরবরাহ করা যায়, তাহলে এই খাতের সম্ভাবনা আরও বাড়বে।’
চট্টগ্রামের মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ দপ্তরের তথ্যমতে, ভেনামি চিংড়ি ১০ থেকে ৪২ ডিগ্রি পর্যন্ত তাপমাত্রা শোষণ করতে পারে। সেখানে আমাদের দেশীয় বাগদা বা গলদা চিংড়ি ২০ থেকে ৩৫ ডিগ্রি পর্যন্ত তাপমাত্রা শোষণ করতে পারে। পানিতে লবণাক্তের পরিমাণ পাঁচ পিপিএম পার মিলিয়নের নিচে এলেই মারা যায় দেশীয় চিংড়ি। সেখানে ভেনামি চিংড়ি ৩ পিপিএম থেকে ১২ পিপিএম পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। বাংলাদেশের বাগদা চিংড়ি ২৮ ডিগ্রির নিচে এবং গলদা ১০ ডিগ্রির নিচে এলে আর লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে না। সেখানে ভেনামি চিংড়ি সমুদ্রের পানিতে শূন্য থেকে ৪০ পিপিটি পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। পরিষ্কার পানিতে সেই মাছ বাঁচতে পারে ৪২ ডিগ্রি পর্যন্ত। সমুদ্রের লবণাক্ততার গড় পরিমাণ ৪২ পিপিটি।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) সহসভাপতি শাহজাহান চৌধুরী বলেন, শুধু বাগদা ও গলদা চিংড়ি রপ্তানি করে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় এখন আর টিকে থাকা যাবে না।