বিদ্যুৎ সংরক্ষণ করে পরে ব্যবহারের জন্য দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লেড অ্যাসিড ব্যাটারি (ল্যাব) এবং তুলনামূলকভাবে স্বল্প মাত্রায় ব্যবহৃত হচ্ছে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি। তবে লিথিয়ামের তুলনায় ল্যাব পুরোনো প্রযুক্তি, পরিবেশের জন্য মারাত্মক
ক্ষতিকর, অধিক বিদ্যুৎ গ্রহণকারী, ব্যয়বহুল ও কর্মদক্ষতা কম হলেও এর ব্যবহার কমানো
যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নীতিগত সহায়তার অভাবে থমকে আছে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির বিস্তৃতি। ইলেকট্রিক যানবাহন (ইভি) এবং সেগুলোর চার্জিং সম্পর্কিত দুটি নীতিমালা হলেও তাতে লিথিয়াম ব্যাটারিকে উৎসাহিত করার প্রস্তাব নেই। অভিযোগ আছে, একটি পক্ষের চাপে নীতিগত সহায়তা পাচ্ছে না লিথিয়াম ব্যাটারি।
বর্তমানে যানবাহনের মধ্যে দুই চাকার বাইক, তিন চাকার ইজিবাইক এবং অন্য মোটরযানে ল্যাব ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশেষ করে বাইক এবং তিন চাকার ইজিবাইক চার্জ দিতে জাতীয় গ্রিডের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিদ্যুৎ লাগছে। সম্প্রতি সংসদে সংসদ সদস্য শামীম ওসমান দাবি করেন, অটোরিকশা ৭০০ থেকে ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ করছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের হিসাবে গ্রিডের ৭ থেকে ৯ শতাংশই গ্রহণ করছে এসব ব্যাটারি। অথচ লিথিয়াম ব্যাটারি ব্যবহার করলে এর ৩০ শতাংশ সাশ্রয় হতো।
বৈদ্যুতিক যানবাহন নিয়ে কাজ করা স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান ক্যাসেটেক্সের প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা গোপাল কুমার মাহাতো বলেন, অটোরিকশাগুলোতে চার থেকে পাঁচটি করে লেড ব্যাটারি থাকে। এর দক্ষতা কম থাকায় ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত সিস্টেম লস থাকে। ফলে ৯ ইউনিট বিদ্যুৎ নিতে গ্রিড থেকে ১২ ইউনিট বিদ্যুৎ গ্রহণ করে একেকটি সেট। সম্প্রতি সংসদে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, দেশে প্রায় ৪০ লাখ অটোরিকশা আছে। এ হিসাবে সেগুলো দিনে ৪৮ হাজার মেগাওয়াট - ঘণ্টা বিদ্যুৎ গ্রহণ করছে। অথচ লিথিয়াম ব্যাটারির ব্যবহারে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বিদ্যুৎ সাশ্রয় হতো।
অন্যদিকে ল্যাব পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হতে পারে। ই-বর্জ্যের রি-সাইক্লিং নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান এনএইচ এন্টারপ্রাইজের এমডি নাজমুল হায়দার বলেন, দেশে পরিবেশ অধিদপ্তর অনুমোদিত কিছু প্রতিষ্ঠান ল্যাব রি-সাইক্লিং করা ছাড়া বেশিরভাগই যথাযথভাবে রি-সাইক্লিং করছে না। লেড বা সিসার সঙ্গে পানি সদৃশ অ্যাসিড যত্রতত্র ফেললে তা পরিবেশে ছড়াবে। মানিকগঞ্জের সিংগাইর এবং ঢাকার আশপাশে অনেক পরিমাণ ব্যাটারি, অ্যাসিড এবং লেডের মাধমে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইভির ব্যবহার যেভাবে বাড়ছে, তাতে ল্যাবকে নিরুৎসাহিত করে এবং লিথিয়াম ব্যাটারির ব্যবহারকে উৎসাহিত করে নীতিমালা প্রণয়নের আদর্শ সময় এটি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক সালেহ আহাম্মদ বলেন, লিথিয়ামের তুলনায় ল্যাবের নেতিবাচক দিক বেশি। এটি তুলনামূলক বেশি বিষাক্ত। সিসা সুপরিচিত ভারী ধাতু, যা কখনোই স্বাস্থ্যের জন্য ভালো না। এটার এনার্জি ডেনসিটি (শক্তি ঘনত্ব) সীমিত। তবে লিথিয়ামের প্রাপ্যতাও অত বেশি না। এক সময় এর ঘাটতি দেখা দেবে। তবে লিথিয়াম ব্যাটারি বাণিজ্যিকভাবে এগিয়ে আছে, কারণ এর এনার্জি ডেনসিটি সবার থেকে ভালো। লিথিয়ামে সহজে বিক্রিয়া হয়, প্বার্শ বিক্রিয়া কম হয়। ফলে বাণিজ্যিকভাবে লিথিয়ামের শতভাগ নির্ভরযোগ্য বিকল্প এখনো নেই।
ল্যাব প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো খুব সহজেই লিথিয়াম ব্যাটারি উৎপাদনে যেতে পারে মনে করে জবির অধ্যাপক সালেহ আহাম্মদ বলেন, এটা খুব সহজ। যখন কোনো প্রযুক্তির উন্নয়ন হয়, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো সেদিকে ঝুঁকে পড়ে। লেড থেকে লিথিয়ামে যেতে হবে; শুধু লেডকে পরিবর্তন করে লিথিয়াম ব্যবহার করবে।
ল্যাবের এত ক্ষতিকর দিক থাকার পরও সরকারি নীতিমালায় লিথিয়ামকে উৎসাহিত করা হয়নি। এ ছাড়া লিথিয়াম আমদানিতে উচ্চ কর রয়েছে।
যানবাহনে ব্যাটারির ব্যবহার সম্পর্কিত নীতিমালা বিশ্লেষণে দেখা যায়, টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (স্রেডা) ইভি চার্জিং গাইডলাইন প্রণয়ন করলেও সেখানে ল্যাবকে নিরুৎসাহিত করে এমন কিছু নেই। তবে ২০২২ সালে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের তৎকালীন যুগ্ম সচিব আনিসুর রহমানের প্রস্তাবিত ‘ইলেকট্রিক মোটরযান রেজিস্ট্রেশন ও চলাচল সংক্রান্ত নীতিমালা-২০২২’ এর খসড়ায় ইভিতে লিথিয়াম ব্যাটারি বাধ্যতামূলকভাবে ব্যবহারের সুপারিশ করা হয়েছিল। তবে চূড়ান্ত নীতিমালায় সেসব নেই। ওই বিভাগের বর্তমান সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী কালবেলাকে বলেন, হঠাৎ করে কোনো কিছু বাদ দেওয়া যায় না, পর্যায়ক্রমে হয়। পরিবেশ অধিদপ্তর ব্যাটারি ডিসপোজাল নীতিমালা করেছে। আমরা সেদিকে হাঁটছি।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ল্যাবের সঙ্গে বড় সিন্ডিকেট জড়িত। স্থানীয়ভাবে প্রস্তুতের পর বাজারে গ্রাহকের কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে
বড় একটি গোষ্ঠী ল্যাবের সঙ্গে জড়িত। এ গোষ্ঠীর চাপেই লেড ব্যাটারি নিরুৎসাহিত করে নীতিমালা করা যাচ্ছে না।
এদিকে পরিবেশ অধিদপ্তরেরে ব্যাটারি
ডিসপোজাল গাইডলাইনেও ল্যাবকে নিরুৎসাহিত এবং লিথিয়াম ব্যাটারিকে উৎসাহিত করে—এমন কিছুর উল্লেখ নেই। পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবদুল হামিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে হোয়াটসঅ্যাপে প্রশ্ন পাঠাতে বলেন। তবে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
নীতিমালার বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব হাবিবুর রহমান কালবেলাকে বলেন, গ্রিডের স্থিতিবস্থার জন্য ব্যাটারি স্টোরেজ সিস্টেম চালুর বিষয়ে কাজ করছি। কাজগুলো এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। নতুন প্রযুক্তি সংগ্রহ করা এবং কিছু
মডেল পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়ন করে ভবিষ্যতে বড় প্রকল্পের প্রস্তুতি নেওয়ার পর্যায়ে কাজ করছে। এসব কাজে লিথিয়াম ব্যাটারি ব্যবহৃত হচ্ছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো আমরাও লিথিয়াম ব্যাটারিতে জোর দিচ্ছি।