তিন মেয়াদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির (জাপা) রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচি নেই। সাংগঠনিক কার্যক্রমও স্থবির বলা চলে। দলটির রাজধানীর কাকরাইলে কেন্দ্রীয় কার্যালয় খোলা হয় না অনেক দিন। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই নেতাকর্মীদের ভিড় কমেছে এখানে। বনানীতে দলের চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে মাঝেমধ্যে বসেন জি এম কাদের। তিনি যেদিন আসেন, সেদিন কিছু মানুষের উপস্থিতি দেখা যায়। এর বাইরে সব সময় নীরব থাকে বনানীর কার্যালয়। পার্টির গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা থেকে শুরু করে ঘরোয়া কিছু অনুষ্ঠান সম্প্রতি জি এম কাদেরের উত্তরার বাসায় হচ্ছে।
পার্টির অন্তত ১০ জন দায়িত্বশীল নেতার সঙ্গে কথা বলে আরও জানা গেছে, দিন দিন দলটি ছোট থেকে ছোট হয়ে আসছে, নিষ্প্রাণ হয়ে আসছে। বিরোধী দলের কার্যক্রম আস্তে আস্তে পার্টির চেয়ারম্যানের বাসাকেন্দ্রিক হচ্ছে। প্রেস রিলিজ নির্ভর হচ্ছে দল। সরকারি দলের সঙ্গে অঘোষিত সমঝোতার কারণে রাজনৈতিক কর্মসূচি নেই বলেও মনে করেন তারা।
এর বাইরে সাংগঠনিক কার্যক্রমও স্থবির। বর্তমানে পার্টির মহাসচিব ও বিরোধী দলের চিফ হুইপ মুজিবুল হক চুন্নু আছেন কানাডায়। ১৭ জুন দেশের বাইরে যান তিনি। ৪ জুলাই তার ফেরার কথা রয়েছে। এ কারণে চেয়ারম্যানও খুব একটা বনানী কার্যালয়মুখী হন না।
নেতারা বলছেন, রাজনৈতিক সব ইস্যুতে জাপা নিশ্চুপ। যেখানে অনিয়ম, দুর্নীতি, অর্থ পাচার, সেন্টমার্টিন, নিত্যপণ্য, রোহিঙ্গা, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চুক্তি, অর্থ ও ডলার সংকট, বন্যাসহ গুরুত্বপূর্ণ নানা বিষয়ে সোচ্চার দলগুলো, সেখানে বিরোধী দলের ভূমিকায় বসে রহস্যজনকভাবে নীরব জাপা। আগে মাঝেমধ্যে সংসদে সরকারের সমালোচনা করলেও এখন এ অবস্থান থেকেও সরে এসেছে দলটি।
কেন এই নীরবতা? এ নিয়ে দলের মধ্যে আলোচনা বিস্তর। কারও বক্তব্য, সরকারের সঙ্গে আসন সমঝোতার মধ্য দিয়ে ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। তাই রাজনৈতিক কর্মসূচি বা ব্যক্তিগত আক্রমণের মধ্য দিয়ে সরকারকে বিব্রত না করতে দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত। এ কারণেই রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচিতে যাচ্ছে না দলটি। তা ছাড়া জাপার প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্ত্রী রওশনের নেতৃত্বে এ যাবৎকালের সর্ববৃহৎ ভাঙন হয়েছে দলে। সাত টুকরো জাপায় এখন সবচেয়ে বড় অংশ রওশনের অনুসারী। সেইসঙ্গে সর্বশেষ নির্বাচন নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের মতবিরোধ নিরসন হয়নি। তাই ধীরে চলো নীতিতে এক জায়গায় স্থবির দলটির সবকিছু। অনেকেই নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার হতাশা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তাই মাঠ পর্যায়ে জাপার কার্যক্রম ধরে রাখতে কষ্ট হচ্ছে। জেলা ও উপজেলার নিবেদিত নেতাদের অনেকেই নির্বাচনের পর কার্যত নিষ্ক্রিয়।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, সাংগঠনিক কার্যক্রমও ঢিলেঢালা। ৭৭টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ৪৫টির সম্মেলন হয়েছে। বাকি ৩২টির সম্মেলনের খবর নেই। ২০১৯ সালে সর্বশেষ কেন্দ্রীয় কাউন্সিল হয়েছিল। এরশাদের মৃত্যুর পর এই কাউন্সিলের মধ্য দিয়েই পার্টির চেয়ারম্যান হন জি এম কাদের। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তিন বছর পরপর সম্মেলন করার কথা। তা না করতে পেরে দলের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়ে দুবার কাউন্সিলের জন্য সময় নেওয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে, চলতি অক্টোবর মাসে সম্মেলনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে; কিন্তু তারিখ চূড়ান্ত হয়নি। পার্টির সাংগঠনিক টিমের একাধিক সদস্যের দাবি, কাউন্সিলের জন্য অচিরেই শুরু হবে সাংগঠনিক সফর। পাশাপাশি সব জেলার সম্মেলন শেষ করা হবে।
জানা গেছে, পার্টির উপজেলা, মহানগর, পৌরসভা, থানা থেকে শুরু করে ওয়ার্ড পর্যায়ের কমিটি কার্যত নামসর্বস্ব। অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোও নিষ্ক্রিয়। উপজেলা নির্বাচনে একটিতেও জিততে পারেননি দলের প্রার্থীরা। প্রণোদনার আশ্বাস দিয়েও উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী মিলাতে পারছে না জাপা।
পার্টির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বিরোধী দলের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা বা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে গিয়ে সরকারবিরোধী হাজারো ইস্যু থাকতেও মাঠে নামতে পারছে না জাপা। এ কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে দিন দিন জাপার গ্রহণযোগ্যতা কমছে। এর বাইরে সর্বশেষ দলের ভাঙনে হেভিওয়েট অনেক নেতা দলছুট হয়েছেন। তারাই মূলত ঢাকাকেন্দ্রিক যে কোনো কর্মসূচি সফল করতে অর্থ ও জনবল নিশ্চিত করতেন।
রওশনপন্থিদের একটি অংশ সম্প্রতি কাকরাইলে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় দখলের চেষ্টা চালায়। দলের লাঙ্গল প্রতীক পেতে নির্বাচন কমিশনের কাছে লিখিত আবেদনও করেন তারা। যদিও কমিশন তা নাকচ করেছে। এতে হাল ছাড়েননি রওশন অনুসারীরা। তারা বলছেন, এরশাদের স্ত্রী হিসেবে দল করার অধিকার রওশনের বেশি। তাই প্রতীকের অধিকারও রয়েছে। এজন্য প্রয়োজনে আইনি লড়াইয়ের ঘোষণা এসেছে এই অংশ থেকে। জানা গেছে, সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সংঘাত এড়াতে কর্মসূচি ও অফিসমুখী কম হচ্ছেন জি এম কাদেরপন্থিরা।
জানতে চাইলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নূরুল আমিন বেপারী কালবেলাকে বলেন, গত ২০ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে জাপা মানুষের জন্য কাজ করেনি। এখন তো আওয়ামী লীগের বি টিম এই দল। তাই তাদের পক্ষে সরকারের ব্যর্থতার নানা ইস্যু নিয়ে রাজনৈতিকভাবে মাঠে নামা নিজের পায়ে কুড়াল মারার শামিল। এভাবে আস্তে আস্তে দলটি অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়বে। এক সময় প্রেস রিলিজ নির্ভর দল হবে জাতীয় পার্টি।
দলটির বেশ কয়েকজন নেতা কালবেলা বলেছেন, গত ১০ বছরে জাপার রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচি নেই। দলটির নাম যতবার গণমাধ্যমে এসেছে, এর বেশিরভাগ প্রেস রিলিজ পাঠানোর কারণে। ছোট্ট পরিসরে কিছু আয়োজন হয় বনানী কার্যালয়ে, যা কার্যত গণমাধ্যমে আসার মতোও নয়। এই পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে হলে মানুষের প্রয়োজনে রাজনীতি করার পরামর্শ কেন্দ্রীয় নেতাসহ তৃণমূলের কর্মীদের।