টানা বৃষ্টিতে নদনদীর পানি বেড়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লাখো মানুষ। সড়ক, পুকুর, ঘরবাড়ি ও বিদ্যালয় প্লাবিত হয়ে দুঃসহ দুর্দশায় পড়েছেন বন্যার্ত মানুষ। রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলায় বন্যার পানিতে পড়ে দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। সিলেট অঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকলেও দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কিছু এলাকায় পরিস্থিতির অবনতির আভাস দিয়েছে পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।
দেশজুড়ে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে এলেও সিলেট, চট্টগ্রাম ও রংপুর বিভাগে মাঝারি ধরনের ভারি থেকে ভারি বৃষ্টির আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এ ছাড়া দেশের অধিকাংশ জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে।
বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের তথ্য বলছে, কুশিয়ারা নদী ছাড়া দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য প্রধান নদীগুলোর পানি সমতল সার্বিকভাবে কমছে, এ অবস্থা আগামী ২৪ ঘণ্টা অব্যাহত থাকতে পারে। তাতে সিলেট অঞ্চলের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে। তবে আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দেশের উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার ও ঘাঘট নদীর পানি দ্রুত বাড়তে পারে। ফলে তিস্তা ও দুধকুমার নদীর পানি কিছু পয়েন্টে স্বল্পমেয়াদে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে এবং ধরলা ও ঘাঘট নদী সংলগ্ন কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার কিছু নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি হতে পারে।
এ ছাড়া পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টায় দেশের উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের যমুনেশ্বরী, করতোয়া, বাঙালি, আপার করতোয়া, পুনর্ভবা, টাঙ্গন, ইছামতি-যমুনা, আত্রাই, মহানন্দা এবং ছোট যমুনা নদীর পানি দ্রুত বাড়তে পারে। ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা এবং গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি সমতলে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আগামী ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। তাতে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জ জেলার ব্রহ্মপুত্র, যমুনা নদীসংলগ্ন নিম্নাঞ্চলের বন্যার পরিস্থিতি অবনতি হতে পারে এবং টাঙ্গাইল জেলার কিছু পয়েন্টে পানি বেড়ে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে।
বৃহস্পতিবার দেশের নয়টি নদীর পানি ১৯টি পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছিল। এর মধ্যে পাঁচটি পয়েন্টে পানি কমার প্রবণতা দেখা গেলেও বাকি ১৪ পয়েন্টে বাড়ছিল। এবার জুনের শুরুতে প্রবল বর্ষণ আর উজানের ঢলে সিলেটে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়। কয়েক দিন পর পরিস্থিতির উন্নতি হলেও গত ১৭ জুন কোরবানির ঈদের আগের দুদিন থেকে টানা বৃষ্টিতে সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনাসহ আশপাশের জেলার অনেক এলাকা ডুবে যায়। উজানের ঢলে জুলাইয়ের শুরুতে নতুন করে বন্যা দেখা দেয় ওই তিন জেলায়।
বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান বলেন, উজানে এখন একটু ভারি বৃষ্টিপাত আছে, তবে সিলেট অঞ্চলে পরিস্থিতির অবনতি হবে না আশা করা যাচ্ছে। ৭ জুলাই থেকে দেশের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।
আবহাওয়াবিদ আফরোজা সুলতানা বলেন, বৃষ্টির পরিমাণ কমে এসেছে; এক-দুই দিনের মধ্যে আরও কিছুটা কমবে। তবে বৃষ্টি থাকবে। এই বৃষ্টি হলো, রোদ উঠল, আবার বৃষ্টি হলো- এমন অবস্থা থাকবে।
রাঙামাটিতে বন্যার পানিতে পড়ে দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। একজনের লাশ বাঘাইছড়ি পৌর এলাকার বাঘাইছড়ি গ্রাম সংলগ্ন নারিকেল বাগান এলাকা থেকে গতকাল ভোরে উদ্ধার করা হয়। আরেকজনের লাশ বুধবার বিকালে বাঘাইছড়ি উপজেলার বঙ্গলতলী ইউনিয়নের বালুখালী গ্রাম থেকে উদ্ধার হয়।
মৃতরা হলো-পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মিল্টন চাকমার ছেলে স্কুলছাত্র কৃতিত্ব চাকমা (১৩) এবং বালুখালী গ্রামের মহিমী কুমারের মেয়ে সোহামনি চাকমা (১১)।
তিনদফা বন্যায় নিঃস্ব সিলেটের মানুষ। বন্যা শেষ হতে না হতেই ফের বন্যায় ভোগান্তির শেষ নাই মানুষের। বিভিন্ন উপজেলায় যাদের ঘরবাড়িতে পানি উঠেছে তাদের যেন-সব শেষ। মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, খাবার নেই। বিশুদ্ধ পানি, স্যানিটেশন ব্যবস্থার তীব্র সংকটের কারণে পানিবাহিত রোগবালাইয়ের শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সিলেটের গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর, কানাইঘাটসহ সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলোয় কিছু পানি কমলেও বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ ও ফেঞ্চুগঞ্জে পানি বেড়েছে। তবে সিলেটের উত্তর-পূর্ব উপজেলা জকিগঞ্জে কুশিয়ারা নদীর বেশ কয়েকটি পয়েন্টে ডাইক ভেঙে প্রবল স্রোতে পানি প্রবেশ করে নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পৌর এলাকার নরসিংহপুরসহ কয়েকটি এলাকায় ডাইক ভেঙে এবং ডাইক উপচে নদীর পানি লোকালয়ে ঢুকে প্রায় ৮৫টি গ্রামের লাখো মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছেন।
তিনবার বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়ে উপজেলার নিম্নাঞ্চলের লোকজনের ভোগান্তি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। বন্যাকবলিত এলাকার স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদ গোরস্থানসহ গ্রামীণ রাস্তাঘাট এবং শেওলা-জকিগঞ্জ সড়কের একটি অংশ পানিতে তলিয়ে গেছে। চলমান পরিস্থিতিতে রান্না করা খাবার, বিশুদ্ধ পানি, স্যানিটেশন, পানিবাহিত রোগবালাই ও গবাদিপশুর খাবার সংকটে চরম দুর্ভোগে বানভাসিরা।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানায়, জেলার ১৩ উপজেলায় ৯৬টি ইউনিয়ন বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। ১ হাজার ১৬০টি গ্রামের ৬ লাখ ১৭ হাজার ৭৯৩ জন মানুষ বন্যায় আক্রান্ত। জেলার ৬৪৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৯ হাজার ২৩৪ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।
জকিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আফসানা তাসলিম জানান, এখন পর্যন্ত উপজেলার লাখো মানুষ পানিবন্দি হয়েছেন। পাঁচটি আশ্রয়কেন্দ্রে ৩০টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে রয়েছে প্রশাসন। জুন মাসের ৩০ তারিখে প্রতিটি ইউপিতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে; ওই বরাদ্দ এখন বিতরণ করা হবে। নতুন করে চাহিদা পাঠানো হবে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে।
সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান বলেন, জেলার অভ্যন্তরীণ নদনদীর পানি ছয়টি পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উজানের উপজেলাগুলো থেকে ঢলের পানি নামতে থাকায় ভাটির উপজেলাগুলোতে বন্যা পরিস্থিতির কোথাও উন্নতি; আবার কোথাও অবনতি হচ্ছে। বন্যা পরিস্থিতিতে ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান তিনি।
এদিকে, জৈন্তাপুর উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামের মানুষের চলাচলের একমাত্র রাস্তাটি বানের পানির ধাক্কায় ১৫০ ফুট পর্যন্ত ভেঙে গভীর খালের সৃষ্টি হয়। পরে স্থানীয়রা স্বেচ্ছাশ্রমে রাস্তা সংস্কার করে চলাচলের উপযোগী করেন।
বগুড়ায় যমুনার পানি বৃদ্ধিতে ৮২১ হেক্টর ফসলি জমি নিমজ্জিত হয়েছে। সারিয়াকান্দি উপজেলার কর্নিবাড়ি, কামালপুর, হাটশেরপুর, ফুলবাড়ী ও চালুয়াবাড়ি ইউনিয়নের চরাঞ্চলের নিচু জায়গা তলিয়ে গেছে। জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম ইতিমধ্যে সারিয়াকান্দী, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলায় বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ঘুরে দেখেছেন। তিনি বলেন, জনগণের যেন কোনো ক্ষতি না হয় সেজন্য সংশ্লিষ্টদের দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি সজাগ থাকতে বলা হয়েছে। কৃষি কর্মকর্তা মতলুবুর রহমান জানান, যমুনার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় সারিয়াকান্দি ও সোনাতলা উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা তলিয়ে গেছে। এতে করে সারিয়াকান্দিতে ৫৬০ হেক্টর এবং সোনাতলা উপজেলায় ২৬১ হেক্টর ফসলি জমি নিমজ্জিত হয়েছে। এসব জমিতে পাট, ভুট্টা ও সবজি চাষ করা হয়েছিল।
কুড়িগ্রামে প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। অবনতি হচ্ছে বন্যা পরিস্থিতির। চর ভগবতিপুরর এলাকার বাসিন্দা তোফাজ্জল হোসেন জানান, তার ঘরের ভেতর এখন তিন থেকে চার ফুট পানি। পানিতে ভেসে গেছে ১০টি মুরগি, দুটি ছাগল। মঙ্গলবার রাত থেকে তারা শুকনো খাবার খেয়ে আছেন। উলিপুর উপজেলার হাতিয়া গ্রামে পানিবন্দি হোসনা বেগম জানান, তাদের সবগুলো ঘরেই এখন পানি। গরু-ছাগল-হাঁস-মুরগি নিয়ে তারা বাঁধের ওপর আশ্রয় নিয়েছেন। আছেন পলিথিনের ঝুপড়িতে। সরকারিভাবে ১০ কেজি চাল পেলেও তাদের দরকার শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানি।
ফুলবাড়ী উপজেলার বড়ভিটা গ্রামের দিনমজুর মজিবুর রহমান জানান, আশপাশের সব এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়ায় দুই-তিন দিন ধরে কোনো কাজ নেই তার। কোনো ত্রাণও পাননি তিনি। কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ বলছেন, তাদের কাছে যথেষ্ট ত্রাণ আছে। পর্যায়ক্রমে সব বানভাসি মানুষের কাছে তা পৌঁছে দেওয়া হবে।
গাইবান্ধায় নদীর তীরবর্তী এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। সিরাজগঞ্জে প্লাবিত হচ্ছে নিম্নাঞ্চল। তলিয়ে যাচ্ছে চরাঞ্চলের ফসলি জমি। পানি বাড়ার সঙ্গে যমুনার তীরবর্তী অঞ্চলগুলোতে শুরু হয়েছে তীব্র ভাঙন। গত চার দিনে জেলার কাজীপুরের খাসরাজবাড়ী ও শাহজাদপুর উপজেলার কৈজুরী এবং জালালপুর ইউনিয়নে শতাধিক বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। নদীতে চলে গেছে শতাধিক একর ফসলি জমিও। এ ছাড়াও ভাঙন চলছে সদর উপজেলার কাওয়াকোলা ইউনিয়নেও।
খাসরাজবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম বলেন, গত চারদিনের মধ্যে দক্ষিণ খাসরাজবাড়ী গুচ্ছগ্রামের ৬০-৭০টি বাড়িঘর এবং একটি কমিউনিটি ক্লিনিক নদীগর্ভে চলে গেছে।
বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ না থাকায় জামালপুরের ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ, বকশীগঞ্জ, মাদারগঞ্জ ও সরিষাবাড়ীর লোকালয় প্লাবিত হয়েছে। এতে কিছু কিছু জায়গায় বন্ধ হয়ে গেছে যানবাহন চলাচল। এ ছাড়া লালমনিরহাট ও রংপুরের সবকটি নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে।
তিস্তা নদীবেষ্টিত রংপুরের গংগাচড়া উপজেলার মর্ণেয়া ইউনিয়নের আলফাজ টারী গ্রামের বাসিন্দা আব্দুস সাত্তার। অশ্রুসিক্ত চোখে আগ্রাসী তিস্তার দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, ‘ঈদের আগ থাকি হামার এত্তি কোনা পানি আসছে। হামরা মনে করছি নো এবার বুঝি এইপাকে (এদিকে) নদীভাঙন হবার নেয়। কিন্তু তিস্তা কয় থাকিস তোর বাড়িটায় আগত ভাঙি নিয়া যাং। চোখের ইশারাত তিস্তা হামার সোগকিছু (সবকিছু) ভাঙি নিয়া গেইল। নদী গরিব-দুঃখী বোঝে না বাহে। বুঝলে কি আজই হামাক চিন্তাত থাকা নাগে।’
মহারশি, সোমেশ্বরী ও চেল্লাখালী নদীর পানিতে শেরপুরে প্লাবিত হয়েছে নতুন এলাকা। নালীতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলার নিম্নাঞ্চলের ৪০টি গ্রামের মানুষ তিন দিন ধরে দিন কাটাচ্ছে পানিবন্দি অবস্থায়। রাজশাহীর গোদাগাড়ী, পবা ও বাঘা উপজেলায় পদ্মা নদীর চরগুলোতে হঠাৎই পানি বৃদ্ধির ফলে চরে চাষ করা নানান ফসল তলিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে বাঘা উপজেলার চকরাজাপুর ইউনিয়নের ১৫টি চরের প্রায় ৩ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তলিয়ে গেছে শত শত বিঘা জমির ফসল। বাঘা উপজেলার মানিকের চরে পানিতে তলিয়ে গেছে অর্ধশত চাষির ফসল। এমন অবস্থায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারা।