রাশেদ রাব্বি ও মাহমুদুল হাসান
প্রকাশ : ১৬ জুলাই ২০২৪, ০২:২৫ এএম
আপডেট : ১৬ জুলাই ২০২৪, ০৭:৪৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

অনুদানের আইসিইউর টাকা আত্মসাৎ!

সাভার গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল
অনুদানের আইসিইউর টাকা আত্মসাৎ!

উচ্চশিক্ষায় জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়েছিলেন সাবরিনা কামাল তন্বী। করোনায় আক্রান্ত হয়ে সেখানেই তার মৃত্যু হয়। তখন বৈশ্বিক যোগাযোগ বন্ধ থাকায় দূর প্রবাসে সন্তানের চিকিৎসায় অর্থ ব্যয়ের সুযোগ হয়নি মা-বাবার। তাই সন্তানের আত্মার শান্তি কামনায় চিকিৎসার টাকা মানবিক কাজে ব্যয়ে মনস্থির করেন তারা। এই লক্ষ্যে ৫০ লাখ টাকা দিয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে সন্তানের নামে পাঁচ শয্যার নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) স্থাপনের পরিকল্পনা করেন। পুরো টাকা তুলে দেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের দায়িত্বরতদের হাতে। সিদ্ধান্ত হয় সাভার গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে স্থাপিত হবে আইসিইউ ইউনিট। কিন্তু আজো সেই ইউনিট স্থাপন হয়নি।

এ ক্ষেত্রে অর্ধকোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তুলেছেন প্রয়াত তন্বীর মা ঢাকা কলেজের ইতিহাস বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নাসরীন বেগম। গত ২ জুলাই তিনি এ-সংক্রান্ত অভিযোগ জমা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। এই মানবিক কাজের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ যাদের নামে, তারা হলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের নির্বাহী প্রধান ডা. মনজুর কাদির আহমেদ, ডায়ালাইসিস সেন্টারের সমন্বয়কারী ও গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ডা. মুহিব উল্লাহ খোন্দকার এবং তৎকালীন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পরিচালক (ফাইন্যান্স) মনিকা রানী সরকার।

অধ্যাপক নাসরীন বেগমের অভিযোগ থেকে জানা যায়, বড় মেয়ে সাবরিনা কামাল তন্বী জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতেন। কভিড মহামারির শুরুতে ২০২০ সালের ১৯ মে জার্মানিতে তার মৃত্যু হয়। সন্তানের চিকিৎসায় তারা প্রায় ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা করেন। কিন্তু সেই সুযোগ না পাওয়ায় টাকা দেশের গরিব মানুষের চিকিৎসায় ব্যয়ের সিদ্ধান্ত নেন। সেই লক্ষ্যে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে যোগাযোগ করেন। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পক্ষ থেকে তাকে জানানো হয়, সাভারের গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে আইসিইউ নেই। হাসপাতালের ডায়ালাইসিস ইউনিটে আইসিইউ স্থাপন করা হবে। প্রস্তাবে রাজি হয়ে অধ্যাপক নাসরীন বেগম দুটি চেকের মাধ্যমে ৫০ লাখ টাকা পরিশোধ করেন। চুক্তি অনুসারে পাঁচ শয্যার আইসিইউ স্থাপনে অতিরিক্ত টাকার প্রয়োজন হলে তা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জোগান দেবে। ইউনিটের নাম হবে সাবরিনা কামাল আইসিইউ ইউনিট। চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের নির্বাহী প্রধান ডা. মনজুর কাদির আহমেদ, ডায়ালাইসিস সেন্টারের সমন্বয়কারী ও গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ডা. মুহিব উল্লাহ খোন্দকার এবং তৎকালীন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পরিচালক (ফাইন্যান্স) মনিকা রানী সরকার।

অভিযোগে আরও বলা হয়, আইসিইউ ইউনিটের কাজের অগ্রগতি জানতে চাইলে কর্তৃপক্ষ শুধু আশ্বাস দেয়। এ নিয়ে গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি প্রয়াত ডা. জাফরুল্লাহর কাছে প্রতিকার চাইলে অভিযুক্তরা অধ্যাপক নাসরীনকে অপমানও করেন। এরপর তড়িঘড়ি করে ২০২১ সালের ২৯ অক্টোবর ডা. জাফরুল্লাহকে না জানিয়ে ‘সাবরিনা কামাল তন্বী নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র’ উদ্বোধন করা হয়। অধ্যাপক নাসরীনের ধারণা অভিযুক্তরা নিজেদের দুর্নীতি আড়াল করতে প্রতিষ্ঠানের ট্রাস্টিকে না জানিয়ে গোপনে সাভারে থাকা ডায়ালাইসিসের বেড ও ঢাকা নগর হাসপাতালের আইসিইউ থেকে তিনটি কার্ডিয়াক মনিটর এনে এবং ডায়ালাইসিসের রোগীদের আইসিইউ সিটে রেখে উদ্বোধন নাটক সাজায়। পরে ইউনিট ঘুরে দেখা যায়, কয়েকটি শয্যা ছাড়া আর কিছুই নেই।

তন্বীর খালা ঢাকা মেডিকেল কলেজের সার্জারি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ডা. নিশাত বেগম এবং হলি ফ্যামিলি মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ডা. নাজনীন বেগম পূর্ণাঙ্গ আইসিইউ ইউনিট চালু হতে কতদিন লাগবে জানতে চাইলে বলা হয় এক সপ্তাহের মধ্যে পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হবে। এরপর ডা. মুহিব উল্লাহ খোন্দকারের কাছে আইসিইউ কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বারবার জানিয়েছেন আইসিইউ সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে। অধ্যাপক নাসরীনও বিষয়টি বিশ্বাস করেন। কিন্তু একাধিক সূত্রে জানতে পারেন, ইউনিট সক্রিয় নেই। উদ্বোধনের পর কখনো কোনো রোগী সেখানে সেবা পাননি। শয্যাগুলোর পাশে পড়ে আছে কেমিক্যাল জার।

অভিযোগে আরও বলা হয়, ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বেঁচে থাকতেই ডা. মুহিব উল্লাহ খোন্দকার ও ডা. মনজুর কাদির বিপুল টাকার দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এ কথা জাফরুল্লাহ চৌধুরী মৃত্যুর আগে গণমাধ্যমেও বলেছিলেন। অভিযোগ আছে, ডা. মুহিব উল্লাহ খোন্দকার ও ডা. মনজুর কাদির আহমেদ শুধু এমবিবিএস পাস। তাদের ডিগ্রিও প্রশ্নবিদ্ধ। তারা যে পদে চাকরি ও বেতন পান, তা যথাযোগ্য ডিগ্রি নয়। ২০২৩ সালের ১ জুলাই ডা. মুহিব উল্লাহ খোন্দকার ও মনিকা রানী সরকারকে গুরুতর অপরাধে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

ডা. মুহিব উল্লাহ খোন্দকারের দুর্নীতি প্রমাণ হওয়ায় চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি চাকরি থেকে স্থায়ী বহিষ্কার করা হয়। গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি ডা. আবুল কাশেম চৌধুরী গত ২০ জানুয়ারি তার অব্যাহতি চেয়ে চেয়ারপারসনের কাছে আবেদন করেন। এরপর ১৫ ফেব্রুয়ারি বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার করা হয়। ২৯ ফেব্রুয়ারি দেড় লাখ টাকা বেতনে সাভার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পরিচালক হিসেবে ডা. মুহিব উল্লাহ খন্দকারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা বিতাড়িত করলে তিনি সেখানে যাওয়া থেকে বিরত আছেন।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি ডা. নাজিম উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে গোপন বৈঠক এবং অন্যান্য দুর্নীতির অভিযোগে কেন্দ্রের নির্বাহী কর্মকর্তা ডা. মনজুর কাদির আহমেদকে সব কার্যক্রম থেকে সাময়িক অপসারণ করা হয় গত বছরের ১৮ জুন। সেখানে সার্জারি বিভাগের কনসালট্যান্ট ডা. গোলাম রহমান শাহজাহানকে ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। দুর্নীতির প্রমাণ থাকার পরও ডা. মনজুর কাদেরকে চাকরি থেকে বহিষ্কার ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে গত বছরের ২১ অক্টোবর পদোন্নতি দিয়ে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা প্রজেক্টসহ এনজিওবিষয়ক ব্যুরো এবং বিদেশি সাহায্যপুষ্ট প্রজেক্টগুলোর দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে তার দুর্নীতির তথ্য বিদেশি সাহায্য সংস্থাগুলো জানার পর তাকে ফের ১৯ মার্চ সাভার গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

অভিযোগ প্রসঙ্গে ডা. মনজুর কাদির বলেন, অনুদান নিয়েছিল গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। এরপর সাভারে পাঁচ শয্যার আইসিইউ স্থাপন করা হয়। কিন্তু ডায়ালাইসিস সেন্টার চালানো সম্ভব হয়নি। তৎকালীন সমন্বয়ক হিসেবে এ বিষয়ে আমাকে জড়ানো হলেও ইউনিট স্থাপনে যুক্ত ছিলাম না। তাই অর্থ আত্মসাতের প্রশ্নই উঠে না।

অভিযোগকারী অধ্যাপক নাসরীন বেগম বলেন, আইসিইউ ইউনিট স্থাপন করা হয়নি। তারা ঢাকা থেকে মনিটর ও অন্য ইউনিট থেকে শয্যা এনে আমাদের সামনে উদ্বোধন নাটক করেন। তারা আমাদের অর্থ নিয়ে প্রতারণা করেছেন। ইউনিট স্থাপনে টাকা দেওয়া হয়েছিল দরিদ্র মানুষের সেবায়, অথচ তারা সেই টাকা আত্মসাৎ করেছেন। আমি এই বিষয়ের তদন্ত ও অভিযুক্তদের শাস্তি চাই।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আপনারা কি তামাশা করেন, প্রশ্ন আবিদের

ডাকসু নিয়ে সিবগাতুল্লাহ সিবগার পোস্ট

দেব-শুভশ্রীর পাল্টাপাল্টি জবাব, নায়িকার সম্মানহানি চাননি নায়ক

চবিতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষের পর স্থানীয়দের সাত দফা দাবি

ডাকসু নির্বাচন হতে কোনো বাধা নেই : ঢাবি প্রশাসন

দেশে স্বৈরাচার ঠেকাতে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে : মনি

বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে জিয়ার সমাধিতে যুবদলের শ্রদ্ধা

নিজ হাসপাতালে পড়ে ছিল চিকিৎসকের গলাকাটা মরদেহ

হ্যারি পটার সিরিজে নতুন চমক

এলাকাবাসীর মাঝে হিজড়াদের মিষ্টি বিতরণ

১০

বিশ্বকাপজয়ী মার্টিনেজ নয়, অখ্যাত এক বেলজিয়ানের ওপর ভরসা ম্যানইউর

১১

জশনে জুলুসকে সামনে রেখে চট্টগ্রাম নগরজুড়ে চলছে দৃষ্টিনন্দন সাজসজ্জা

১২

গুজবে কান না দিতে প্রধান উপদেষ্টার প্রতি সেনাপ্রধানের আহ্বান 

১৩

ডাকসু-জাকসু-রাকসু-চাকসু হতেই হবে : সারজিস

১৪

টস জিতে বোলিংয়ের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের, দেখে নিন একাদশ

১৫

শ্রাবন্তীর বোল্ড লুক, নিজের মতো খুশি থাকার শিক্ষা

১৬

কেন ক্ষমা চাইব? আমি তো কোনো অন্যায় করিনি : বাকৃবি উপাচার্য

১৭

একটা লোককে ভিপি বানাতে ডাকসু আয়োজন করা হচ্ছে, অভিযোগ মেঘমল্লার বসুর

১৮

নদীতে গোসলে নেমে তলিয়ে গেল দুই শিশু

১৯

হঠাৎ হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাওয়া কীসের ইঙ্গিত? যা বলছেন চিকিৎসক

২০
X