রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে ভেঙে দেওয়া হয়েছে পাকিস্তানের পার্লামেন্ট। প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের পরামর্শে গত বুধবার রাতে পাকিস্তানের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেন দেশটির প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি। ১২ আগস্ট জাতীয় পরিষদের পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ হতো। পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ায় দেশটিতে একটি সাধারণ নির্বাচনের পট প্রস্তুত হলো। জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে তিন দিনের মধ্যে দেশটিতে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হবে। তবে দুর্নীতির মামলায় সদ্য দণ্ডিত হয়ে কারাগারে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। খবর দ্য ডন, জিও নিউজ ও বিবিসির।
কারাদণ্ডে দণ্ডিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পিটিআইর চেয়ারম্যান ইমরান খান ২০১৮ সালে দেশটিতে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। কিন্তু মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে হেরে ক্ষমতা হারান। পরে তোশাখানা দুর্নীতির মামলায় দোষীসাব্যস্ত হয়ে তিন বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন তিনি। এরপর তাকে পাঁচ বছরের জন্য রাজনীতিতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে দেশটির নির্বাচন কমিশন। পাকিস্তানের নিয়মানুযায়ী, দোষীসাব্যস্ত কোনো ব্যক্তি দেশটির নির্বাচন কমিশনের বেঁধে দেওয়া সময়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন না।
পাকিস্তানে পার্লামেন্টে ভেঙে দেওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারই জাতীয় নির্বাচনের সময় দায়িত্ব পালন করে। সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফকে পাকিস্তানের নতুন অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগে তিন দিনের সময় বেঁধে দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি। এ ছাড়া ৯০ দিনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের বন্দোবস্ত করতে বলেছেন।
এরই মধ্যে দেশটিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভির কাছ থেকে একটি চিঠি পাওয়ার পর গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ও জাতীয় পরিষদের বিরোধী দলীয় নেতা রাজা রিয়াজের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রীর মনোনয়ন নিয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়েছে। যদিও এই নির্বাচন আগামী বছর পর্যন্ত বিলম্বিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে বিদায়ী সরকার।
এর আগে দেশটির বিদায়ী সরকারের আইনমন্ত্রী ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, চলতি বছর নভেম্বরে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও দেশে নতুন আদমশুমারির কাজ শুরু হওয়ায় ভোট কয়েক মাস পিছিয়ে যেতে পারে। আদমশুমারি শেষ করতে এবং নতুন নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ করতে প্রায় চার মাস সময় লাগতে পারে।
এর অর্থÑনভেম্বরে নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও তা অন্তত কয়েক মাস পিছিয়ে যেতে পারে বলে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনের সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা কুনওয়ার দিলশাদ বলেন। তার মতে, পরিস্থিতি বেশ জটিল রূপ নিতে যাচ্ছে। আদমশুমারির অর্থ পুরো দেশজুড়ে নতুন করে নির্বাচনী এলাকার সীমা নির্ধারণ করতে হবে। সেই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সাংবিধানিকভাবে প্রয়োজনীয় সময়সীমার মধ্যে নির্বাচন সম্ভব নয়। এ কারণে ধারণা করা হচ্ছে, আগামী বছর ফেব্রুয়ারির আগে নির্বাচন আয়োজন সম্ভব হবে না।
বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচনে বেশি দেরি হলে তাতে জনঅসন্তোষ সৃষ্টি হতে পারে। ফলে দেশটিতে বিদ্যমান অস্থিরতা আরও বাড়তে পারে। কিন্তু পাকিস্তানকে যেহেতু অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় রীতিমতো সংগ্রাম করতে হচ্ছে, সেহেতু এ নির্বাচন স্থগিত রাখার কথা চিন্তা করছে শাহবাজ সরকার। যদিও পাকিস্তানের এই অস্থিতিশীল পরিবেশ যুক্তরাষ্ট্রকেও সতর্ক অবস্থানে রেখেছে। হোয়াইট হাউস মুখপাত্র জন কিরবি বলেন, সহিংসতার মতো ঘটনা নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন। এ ধরনের ঘটনা দেশটিকে আরও অস্থিতিশীল করে দিতে পারে।
অন্যদিকে পাকিস্তানে এমন আলোচনা আছে—নির্বাচন বিলম্বিত হওয়ার মূল কারণ হলো ইমরান খানের জনপ্রিয়তা। ক্ষমতাসীন পাকিস্তান মুসলিম লীগের (নওয়াজ) জোট নির্বাচনে জয়ের বিষয়ে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী নয়। পাশাপাশি আইএমএফের সহযোগিতা সত্ত্বেও ব্যাপক মূল্যস্ফীতির প্রভাব পড়েছে সেখানে। এক সময় ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকলেও ইমরান এমনভাবে সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছেন যা তার আগে কোনো রাজনীতি করেননি। বিশ্লেষক রাসুল বখশ রাইসের মতে, গ্রেপ্তারের কারণে ইমরান খানের জনপ্রিয়তা আরও বাড়বে।
এর আগে গত মে মাসে ইমরানের গ্রেপ্তার নিয়ে দেশটিতে ব্যাপক সহিংসতা হয়। সে সময় মারা যায় অন্তত আটজন এবং নজিরবিহীন হামলা হয় সামরিক কিছু স্থাপনাতেও। ৭০ বছর বয়সী এ রাজনীতিক দাবি করেন, সামরিক বাহিনীর লক্ষ্য হলো তাকে বন্দি রেখে তার দলকে ধ্বংস করে দেওয়া। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যতই দাবি করেছে—তারা রাজনীতিতে জড়াতে চায় না, কিন্তু ইমরানের ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী চিরাচরিত নিয়ম অনুসরণ করেছে। অতীতে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে যে চ্যালেঞ্জ করেছেন, তাকেই সরে যেতে হয়েছে। এমনকি সেটা ইমরান খানের মতো আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব হলেও তাকে সরে যেতে হবে। ১৯৭০ সাল থেকেই এটি হয়ে আসছে এবং এ তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন হলেন ইমরান।
সাবেক সিনেটর আফরাসিয়াব খাত্তাক বলেন, পাকিস্তানে সমান্তরালভাবে দুটি সরকার কাজ করে। তার ভাষায়, অনুমোদনহীন ডি ফ্যাক্টো ফোর্স সবসময় সংসদীয় প্রক্রিয়ার ওপর খবরদারি করতে চায়। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী সবসময়ই ক্ষমতাবান। কিন্তু তারা আরও ক্ষমতা চায়, যাতে তাদের অনুমোদিত কর্মকাণ্ড কেউ চ্যালেঞ্জ না করেÑসেটা রাজনীতিক, অধিকার কর্মী কিংবা সাংবাদিক যেই হোন না কেন।
গত সপ্তাহে পাকিস্তানের পার্লামেন্টে দুটি ড্রাকোনিয়ান ল উপস্থাপিত হয়েছে। এর উদ্দেশ্যে হলো সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার ক্ষমতা বাড়ানো। শতাব্দীপ্রাচীন অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের দুটি সংশোধনীর প্রস্তাব করা হয়েছে যেটা মোটা দাগে আইএসআই এবং আইবিকে (ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো) অফিশিয়াল সিক্রেটস লঙ্ঘনের অভিযোগে গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেবে।
এ ছাড়া নতুন বিলটিতে এমন বিধানের প্রস্তাব করা হয়েছে, যাতে কেউ গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের নাম প্রকাশ করলে তার তিন বছর জেল হবে। এসব সংশোধনীর প্রস্তাব নিয়ে তীব্র হট্টগোল হয়েছে পার্লামেন্টে। পিটিআই ও পিএমএল-এন এর জোট সঙ্গীরা তড়িঘড়ি করে এসব ড্রাকোনিয়ান ল কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই পাসের তীব্র সমালোচনা করেছেন।
জামায়াত-ই-ইসলামির সিনেটর মুশতাক আহমেদ বলেন, এ আইন গোয়েন্দা সংস্থাকে ওয়ারেন্ট ছাড়াই তল্লাশি ও আটকের ব্যাপক ক্ষমতা দেবে। তার ভাষায়, এর প্রভাব পড়বে মানবাধিকার, ব্যক্তি অধিকার ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে নিয়মিতই বিরোধী রাজনীতিক, অধিকার কর্মী ও সাংবাদিকদের আটকের অভিযোগ ওঠে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দৃষ্টিতে প্রতি মাসেই বাড়ছে জোরপূর্বক গুম হওয়ার ঘটনা। সরকারি সংস্থার হিসাবে শুধু জুলাইয়ে ১৫৭টি এ ধরনের ঘটনা সম্পর্কে রিপোর্ট হয়েছে।
পার্লামেন্টে উত্থাপিত বিলগুলো প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভির কাছে পাঠানো হয়েছে। প্রেসিডেন্ট আলভি পিটিআইর একজন সহপ্রতিষ্ঠাতা। মূলত পার্লামেন্টে বিল পাসের পর আইনে পরিণত করতে হলে প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
মন্তব্য করুন