ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের মতো মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর নতুন এক সংকটে পড়েছে প্রতিবেশী দেশ কানাডা। এটা যে সে সংকট নয়, রীতিমতো অস্তিত্বের সংকট। যে সংকটের কথা আগে কখনো ভাবতেও পারেনি দেশটির সরকার ও জনগণ। নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ট্রাম্প কেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকে বারবার গভর্নর বলে সম্বোধন করছিলেন তার মর্মার্থ যেন এখন ভালোভাবেই বুঝতে পারছেন কানাডার সাধারণ মানুষ। কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম অঙ্গরাজ্য বানানোর মতো কথা প্রায়ই বলে আসছেন ট্রাম্প। সর্বশেষ ডোনাল্ড ট্রাম্প কানাডাকে যুক্ত করে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন যে মানচিত্র প্রকাশ করেছেন, তা নিয়ে রীতিমতো তোলপাড় পড়েছে সারা বিশ্বে। যদিও ট্রাম্পের এসব কর্মকাণ্ড ও বক্তব্য নাকচ করে দিয়ে কানাডার বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেছেন, ‘কানাডা কখনো যুক্তরাষ্ট্রের অংশ হবে না।’ কিন্তু তারপরও ট্রাম্পের এসব হুমকি খুব সরলভাবে দেখতে নারাজ বিশ্লেষকরা।
কানাডাকে যুক্ত করে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন মানচিত্র প্রকাশ করেছেন নবনিযুক্ত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার ট্রাম্প তার নিজস্ব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথে সেই মানচিত্রের ছবি প্রকাশ করে লেখেন, ‘ওহ কানাডা।’ একই দিন ফ্লোরিডায় নিজের বাড়িতে প্রেস কনফারেন্সে কানাডার ব্যাপারে আলোচনা করেন ট্রাম্প। সেখানে তিনি বলেন, ‘কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র এক হবে। কৃত্রিম সীমান্ত থেকে মুক্তি নিন। এরপর দেখুন বিষয়টি দেখতে কেমন লাগে। বিষয়টি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বেশ ভালো হবে।’ কানাডার সামরিক ব্যয় নিয়ে ট্রাম্প বলেন, ‘তাদের সেনাবাহিনী খুবই ছোট। তারা আমাদের সেনাদের ওপর নির্ভরশীল। সব ঠিক আছে। কিন্তু আপনারা জানেন, তাদের এজন্য অর্থ দিতে হয়। এটি খুবই অযৌক্তিক।’ ট্রাম্পকে এ সময় এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কানাডাকে একীভূত করতে তিনি সামরিক শক্তি প্রয়োগ করবেন কি না। জবাবে তিনি বলেন, ‘না, বরং
অর্থনৈতিক শক্তি প্রয়োগ করব।’ এদিকে ট্রাম্পের এমন বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন কানাডার বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। কানাডা কখনো যুক্তরাষ্ট্রের অংশ হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা একে অন্যকে সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক ও নিরাপত্তা সহযোগী। এতে দুই দেশের কর্মী ও সমাজ উপকৃত হচ্ছে। কানাডা কখনো যুক্তরাষ্ট্রের অংশ হবে না।’
নভেম্বরে ট্রাম্প ফের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর এ সংকটের শুরু হয়। সে সময় ট্রাম্প ঘোষণা দেন, হোয়াইট হাউসে প্রবেশের পর তার প্রথম দিনের প্রথম কাজই হবে চীন এবং প্রতিবেশী কানাডা ও মেক্সিকোর ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা। দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনেই যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা কানাডা ও মেক্সিকোর সব পণ্যের ওপর অতিরিক্ত করারোপের নির্বাহী আদেশে সই করবেন তিনি। ট্রাম্পের এ ঘোষণার পর কানাডার ট্রুডো সরকার ও জনগণের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। এর কিছুদিন পর জাস্টিন ট্রুডো যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় ট্রাম্পের মার-এ লাগোর বাসভবনে তার সঙ্গে দেখাও করতে যান। কিন্তু এখানে গিয়েও বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয় ট্রুডোকে। সেখানে সবার উপস্থিতিতে ট্রাম্প তাকে গভর্নর বলে সম্বোধন করেন। পরে বিষয়টিকে ট্রাম্পের একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল বলে মনে করা হলেও পরদিন ট্রাম্প সামাজিক মাধ্যমে ফের একই সম্বোধন করলে টনক নড়ে সবার। এর পর থেকে তিনি বলে আসছেন যে, কানাডা যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম অঙ্গরাজ্য হওয়া উচিত। কানাডার বেশিরভাগ মানুষ সেরকমটাই চান বলেও তিনি দাবি করেন। আর সর্বশেষ মঙ্গলবার কানাডাকে যুক্ত করে তো যুক্তরাষ্ট্রের নতুন মানচিত্রই প্রকাশ করে দিলেন।
তার এসব কর্মকাণ্ড নিয়ে কানাডায় সাধারণ মানুষের মধ্যে এরই মধ্যে এক ধরনের আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। এমনিতেই কানাডায় এখন রাজনৈতিক সংকট চলছে। বিভিন্ন ইস্যুতে জনআস্থা হারানোর প্রেক্ষাপটে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন দেশটির দীর্ঘ সময়ের প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। দেশটি এখন নতুন প্রধানমন্ত্রী পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। এরকম অবস্থায় ট্রাম্পের এসব কর্মকাণ্ড কানাডার জনমনে আরও ভীতির সঞ্চার করেছে। যদিও ট্রাম্প মঙ্গলবারের বক্তব্যে সামরিক শক্তি দিয়ে কানাডাকে দখলের বিষয়টি নাকচ করে দিয়েছেন। বিশ্লেষকরাও বলছেন, মনে রাখতে হবে ট্রাম্প একজন ব্যবসায়ী। তিনি ব্যবসাটাই আগে বোঝেন। মূলত কানাডাকে অর্থনৈতিকভাব খুব চাপে রাখতে চান ট্রাম্প। এ কারণেই তিনি এসব হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন। তাদের মতে, এখনকার সময়ে ভূখণ্ড দখল করার চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে কোনো দেশকে নিয়ন্ত্রণ করাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্প সে পথেই হাঁটবেন বলে মনে করা হচ্ছে। তবে রিপাবলিকান পার্টি যদি ভবিষ্যতে ট্রাম্পের এ মনোভাব নিয়ে এগিয়ে যায় তাহলে এক সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেশী এ দেশটি অস্তিত্ব সংকটে পড়তে পারে বলে মনে করছেন তারা।
গ্রিনল্যান্ড-পানামা খাল নিয়েও ট্রাম্পের হুমকি চলছে: এদিকে গ্রিনল্যান্ড ও পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যেন অনড়। একই সঙ্গে এ বিষয়ে তিনি হুমকিও দিয়ে চলেছেন। মূলত গ্রিনল্যান্ড ও পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ নিতে কিছুদিন আগে তিনি যে ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন, সেখান থেকে সরে আসার কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। বরং ওই দুই এলাকাকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ অভিহিত করে সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিতে ক্রমাগত হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন রিপাবলিকান এই নেতা। ট্রাম্পের হুমকি-ধমকির পরও ডেনমার্ক ও পানামা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে, তারা কোনো পরিস্থিতিতেই নিজেদের ভূমির মালিকানা ছাড়বে না। তাহলে ট্রাম্প ঠিক কীভাবে গ্রিনল্যান্ড ও পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ নেবেন?
তিনি কি সামরিক বা অর্থনৈতিক শক্তি ব্যবহার করে ভূখণ্ড দুটি দখল করার চিন্তা করছেন? সাংবাদিকরা মঙ্গলবার প্রশ্ন করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে। জবাবে ট্রাম্প বলেন, ‘না, এই দুটির কোনোটির ব্যাপারেই আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে পারছি না। তবে আমি এটা বলতে পারি, (যুক্তরাষ্ট্রের) অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য ওই এলাকাগুলো আমাদের প্রয়োজন।’ ট্রাম্পের এমন হুমকির পর ডেনমার্কের স্বায়ত্তশাসিত এই অঞ্চলের নেতা কোপেনহেগেনে ডেনিশ রাজার সঙ্গে বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন। ডেনমার্কের রাজার সঙ্গে বৈঠক করতে মঙ্গলবার কোপেনহেগেনে পৌঁছেন গ্রিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মিউটে এগেডে। যদিও সেখানে পৌঁছানোর আগেই রাজার সঙ্গে তার বৈঠক বাতিল ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে পরে ডেনমার্কের রাজকীয় আদালত বলেন, ডেনমার্কে রাজা ফ্রেডরিকের সঙ্গে গ্রিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মিউটের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া এই বৈঠকের বিষয়ে বিস্তারিত আর কোনো তথ্য জানাননি ডেনমার্কের রাজকীয় আদালত। শুধু ট্রাম্পের এসব মন্তব্যই নয় তার ছেলে ট্রাম্প জুনিয়রের গ্রিনল্যান্ড সফরের বিষয়টিও আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে ডেনমার্কে। ট্রাম্প দুদিন আগে বলেন, ট্রাম্প জুনিয়র শিগগির গ্রিনল্যান্ড সফরে যাবেন। এটা তার সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত সফর বলে ট্রাম্প মন্তব্য করেন। কিন্তু তার এমন বক্তব্যে কিছুতেই আশ্বস্ত হতে পারছে না গ্রিনল্যান্ড ও ডেনমার্ক।