উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে মেট্রোরেল ছুটে চলেছে মতিঝিলের উদ্দেশে। গতকাল মঙ্গলবার বিকেল তখন ৩টা। উত্তরা দক্ষিণ স্টেশন পার হতেই ৩ নম্বর বগির (মেট্রোরেলের কোচ) পাশের আসনে বসে অঝোরে চোখের পানি ফেলছিলেন বয়স্ক এক ব্যক্তি। কান্নার কারণ জানতে চাইলে বিলাপের সুরে বলেন, বিমানের আগুনে তার ভাতিজা পুড়ে গেছে। গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ থেকে এসেছেন দেখতে। যাচ্ছেন বার্ন ইনস্টিটিউটে।
ততক্ষণে বয়স্ক মানুষটির নাম জানা গেল জাকির হোসেন। ভাতিজার নাম জানতে চাইলে বললেন, রোহান। এরপরই টানা বলতে থাকেন, ‘শরীরে আগুন নিয়ে, পোড়া শরীর নিয়ে বাঁচার জন্য স্কুলমাঠে দৌড়াচ্ছিল যে ছেলেটি, সে-ই আমার ভাতিজা।’ ততক্ষণে তার কান্নার আওয়াজ বাড়ে। সেই কান্না ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের আসনে বসা আরও কয়েক যাত্রীর মধ্যে।
জাকির হোসেন বিবরণ দেওয়ার পর বুঝতে আর বাকি রইল না, কে এই রোহান? গত সোমবার রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে যুদ্ধবিমান আছড়ে পড়ার পর পোড়া শরীর নিয়ে দৌড়াচ্ছিল যে শিশুটি, বাঁচার জন্য ছোটাছুটি করছিল—সে-ই রোহান। যে দৃশ্যের ভিডিও ক্লিপ ছড়িয়ে পড়ে অনলাইন জগতে। পুরো নাম রবিউল হাসান নাবিল, তবে স্বজনরা ডাকেন রোহান নামেই। মাইলস্টোন স্কুলের ইংরেজি ভার্সনের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী সে।
যদিও সেদিন রোহানের মতো অনেক শিশুই পোড়া শরীর নিয়ে বাঁচার জন্য দিগ্বিদিক ছুটছিল, যার অনেক ভিডিও ছড়িয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
বিমান বিধ্বস্তের পর ছড়িয়ে পড়া রোমহর্ষক সেই ভিডিওর শিশুদের একজন যে রোহান, গতকাল পর্যন্ত তা জানা যাচ্ছিল না। তবে যারা দেখেছেন সে দৃশ্য, তাদের কেউই কান্না আটকে রাখতে পারেননি। শিশুটির সুস্থতায় প্রার্থনা করেছেন দুই হাত তুলে। গতকাল মতিঝিলমুখী মেট্রোরেলের তিন নম্বর বগিতে বসে আগুনমাখা দগদগে পোড়া শরীর নিয়ে জীবন বাঁচানোর আকুতি জানিয়ে ছোটাছুটি করা সেই ছেলেটির (রোহান) বিবরণ দিলেন বাবা নিজাম উদ্দিন নিজেই। পেশায় পাইলিংয়ের ঠিকাদার এই বাবা অঝোরে কাঁদছিলেন আর বলছিলেন, ‘আমার ছেলেটার জন্য দোয়া করবেন।’
স্কুলমাঠে যুদ্ধবিমান আছড়ে পড়ার পর ছিটকে শ্রেণিকক্ষের মধ্যে ঢুকে পড়ার সেই ভয়ংকর ঘটনার বিবরণ দিয়ে এই বাবা বলেন, ‘রোহান পোড়া শরীর নিয়ে দৌড়াচ্ছিল। এক পর্যায়ে লোকজন একটি রিকশায় করে তাকে উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমরা তখনো কিছুই জানি না!’
‘আমার ছোট্ট ছেলেটা সাহসী’—বাক্যটি বলেই চোখের পানি মুছতে থাকেন নিজাম উদ্দিন। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে ফের বলতে শুরু করেন, ‘ততক্ষণে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ওর অবস্থার ভিডিও দেখে সবাই ঘাবড়ে গেলেও রোহানের মন শক্ত ছিল। হাসপাতালে গিয়ে লোকজনকে নিজেই ওর মায়ের মোবাইল নম্বর দেয়। এরপর আমরা ঘটনা জানতে পারি।’
মেট্রোর একই বগিতে ছিলেন রোহানের বড় চাচা মোতাচ্ছের হোসেনও। তিনিও ভাতিজার এই অবস্থার কথা শুনে গ্রামের বাড়ি সন্দ্বীপ থেকে ছুটে এসেছেন। চিকিৎসাধীন রোহানকে দেখতে উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরের ১৫ নম্বর রোডে তাদের বাসা থেকেই যাচ্ছিলেন জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। রোহানের বাবার সঙ্গে কথোপকথনের সময় কাঁদছিলেন তিনি।
রোহানের বাবা নিজাম উদ্দিন জানালেন, বড় ছেলে শিহাব এবং একমাত্র মেয়ে নাসরিন সুলতানা নূপুরও মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়েছে। স্কুলটাতে ছেলেমেয়েদের দীর্ঘ বছর ধরে দিয়ে আসেন তিনি। সোমবারও ছোট ছেলে রোহানকে পৌঁছে দিয়েছিলেন। স্কুল ছুটির পর সেই ছেলে আর বাসায় ফিরতে পারেনি। তার ঠাঁই হয়েছে বার্ন ইনস্টিটিউটে, চলছে চিকিৎসা। মা নাসিমা বেগম হাসপাতালে ছেলেকে দেখভাল করছেন।
চলন্ত মেট্রোরেলে রোহানের বাবা-চাচাদের সঙ্গে কথোপকথনের সময় তার সম্পর্কে টুকিটাকি তথ্য নেওয়ার সময় ৩ নম্বর বগিটার পরিবেশ অনেকটা ভারি হয়ে ওঠে। বগির সব যাত্রীর আলোচনার একমাত্র বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে পোড়া শরীর নিয়ে রোহানের দৌড়ানোর সেই ভিডিওটা। কেউ কেউ আফসোস করেন, কেউবা আবার সেই ভয়াবহতা স্মরণ হতেই এখনো আঁতকে ওঠার কথা জানান। সামনাসামনি কখনো দেখা না হলেও বগিটির সব যাত্রীর যেন আপন কেউ হয়ে ওঠে শিশু রোহান। সুস্থ হয়ে সে বাবা-মায়ের কোলে ফিরুক, স্কুলব্যাগ কাঁধে নিয়ে ফের যাক মাইলস্টোনের ক্যাম্পাসে—৩ নম্বর বগিতে তখন সেই প্রার্থনা সবার।
জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রোহান রাষ্ট্রায়ত্ত এই চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানটির পিঙ্ক ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন। তার শরীরের ৫০ শতাংশ পুড়ে গেছে।
জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন শাওন বিন রহমান বলেন, ‘শরীরের ৫০ শতাংশ দগ্ধ যে কেউ এমনিতেই সংকটাপন্ন অবস্থায় থাকে। শিশুদের ক্ষেত্রে তা আরও ভয়াবহ। তবে আমরা প্রত্যেকের চিকিৎসায় সর্বোচ্চ সতর্ক রয়েছি।’
মন্তব্য করুন