রাজধানীর কমলাপুর রেলওয়ে হাসপাতালে রোগীদের জন্য অনুদান হিসেবে দেওয়া উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি জেনারেটর বাংলাদেশ রেলওয়ের কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সিদ্ধান্তে চলে গেছে পদ্মা সেতু রেল লিঙ্ক প্রকল্পে। প্রায় ১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা মূল্যের এই জেনারেটরটি ছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুদান, কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে হাসপাতালের জরুরি বিদ্যুৎ ব্যবস্থার জন্য। গুজব ছড়িয়েছে, এটি ‘অফিসিয়ালি’ হস্তান্তর দেখিয়ে বিক্রি করা হয়েছে মাত্র ৮৫ লাখ টাকায়। বিষয়টি ঘিরে রেলওয়ের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের বক্তব্য, অস্বীকার, যুক্তি ও পাল্টা যুক্তিতে তৈরি হয়েছে বিতর্ক ও প্রশ্ন।
২০১৯ সালের শেষদিকে করোনা মহামারির প্রারম্ভে রাজধানীর কমলাপুর রেলওয়ে হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসা কার্যক্রম নির্বিঘ্ন রাখতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অনুদান হিসেবে দেয় ৫০০ কেভিএ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি জেনারেটর। এটি ইতালির ‘ফারবো’ কোম্পানির তৈরি, ২০১৯ সালের মডেল, স্পিড ১৫০০ আরপিএম, ওজন প্রায় ৩৭১৫ কেজি এবং সিরিয়াল নম্বর ২১৪৫২৯।
২০২৪ সালের ২২ মে রেলওয়ের তৎকালীন বিভাগীয় বৈদ্যুতিক প্রকৌশলী (ডিইই) ফারহানা সুলতানা এই জেনারেটরটি বিক্রি ও হস্তান্তর করেন পদ্মা সেতু রেল লিঙ্ক প্রকল্পে। তিনি বদলি হয়ে পাহাড়তলীতে যোগদানের পূর্ব মুহূর্তে হস্তান্তরের কাজ সম্পন্ন করেন। প্রকল্প সূত্র বলছে, এই জেনারেটর হস্তান্তরের ব্যাপারে আগে দরদাম চূড়ান্ত হয় পদ্মা সেতু রেল লিঙ্ক প্রকল্পের চিফ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার প্রদীপ কুমার সাহার সঙ্গে। মধ্যস্থতায় ছিলেন উপসহকারী প্রকৌশলী মাহাবুবুর রহমান, যিনি বর্তমানে প্রকল্পটিতে কর্মরত আছেন।
এ নিয়ে গুজব ছড়িয়েছে, অফিসিয়ালি হস্তান্তর দেখিয়ে জেনারেটরটি মাত্র ৮৫ লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে।
তৎকালীন বিভাগীয় ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার (ডিইই) প্রকৌশলী ফারহানা সুলতানা বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, ‘বিক্রি নয়, হাসপাতালের জেনারেটরটি অফিসিয়ালি পদ্মা ব্রিজ রেল লিঙ্ক প্রজেক্টে বাংলাদেশ রেলওয়ে হস্তান্তর করেছে। বিষয়টি রেলওয়ের মহাপরিচালকও (ডিজি) জানেন। উনি যখন পিডি ছিলেন, ওনার ডিসিশনেই এটা হয়েছে। তাই এটি প্রজেক্টের কাছে দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া এটিও তো রেলওয়ের কাছেই আসবে।’
কেন পদ্মা ব্রিজ রেল লিঙ্ক প্রজেক্টের কাছে জেনারেটরটি হস্তান্তর করলেন—এমন জিজ্ঞাসায় তিনি বলেন, ‘রেল হাসপাতালে এটি ব্যবহার না হওয়ায় এবং পদ্মা ব্রিজ রেল লিঙ্ক প্রজেক্টে এরকম জেনারেটর দরকার হওয়ায় এবং এতে সরকারি অর্থের অপচয় হবে বলে। যেহেতু এই জেনারেটরটি পড়ে আছে, নতুন করে এটি ক্রয় করতে গেলে অনেক টাকা সরকারের ব্যয় হতো, তাই সরকারের খরচ কমানোর জন্য তাদের দেওয়া হয়েছে।’
এটা কতটা আইনসিদ্ধ—এমন জিজ্ঞাসায় তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় শুধু জেনারেটরটিই দিয়েছিল, কানেকশনের কেবলসহ অন্য মালপত্র না দেওয়ায় এটি হাসপাতালে ব্যবহার হচ্ছিল না। এ ব্যাপারে ডিটেইল ডিজি বলতে পারবেন। তার সঙ্গে কথা বললে সব জানতে পারবেন, তিনি সব জানেন।’
আপনারা এটি প্রায় ১ কোটি টাকায় বিক্রি করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে—এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমার কিছু জানা নেই।’
অন্যদিকে, এসব যুক্তি খণ্ডন করেছেন রেলওয়ের একজন প্রকল্প পরিচালক। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই প্রকৌশলী বলেন, ‘কোনো প্রকল্পের কাজ শুরুর আগেই তার জন্য নির্ধারিত সামগ্রী ও বাজেট চূড়ান্ত থাকে। হঠাৎ করে বাইরে থেকে কিছু সংযোজন করার নিয়ম নেই। এর জন্য উচ্চপর্যায়ের অনুমোদন প্রয়োজন।’
তবে কমলাপুর রেল হাসপাতালের জেনারেটর আছে কি না—সেটিই জানেন না বলে দাবি করেছেন রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘রেলওয়ে হাসপাতালে ব্যবহারের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কোনো জেনারেটর দিয়েছে বলে তো আমার জানা নেই। তবে আমি জানি, আমাদের একটি সাব স্টেশন ছিল কমলাপুর আইসিডি এলাকায়, সেটিকে আমরা স্থানান্তর করে টিটিপাড়ায় সাব-স্টেশন করি। তখন এই সাব-স্টেশনের একটি জেনারেটর ওখানে স্থানান্তর করা হয়। জেনারেল হাসপাতালের কোনো জেনারেটরের বিষয় আমার কিছুই জানা নেই।’
পদ্মা সেতু রেল লিঙ্ক প্রকল্পের চিফ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার প্রদীপ কুমার সাহা বলেন, ‘পদ্মা সেতু রেল লিঙ্ক প্রকল্পে আমরা রেলওয়ে থেকে যে জেনারেটরটি নিয়েছি, তা ক্রয় করে নেওয়া হয়নি। সেটি তারা অফিসিয়ালি প্রকল্পে দিয়েছে।’
হাসপাতালের নির্ধারিত জেনারেটর প্রকল্পে দেওয়া সমীচীন কিনা—এমন জিজ্ঞাসায় তিনি বলেন, ‘এটি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের বিবেচনার বিষয়, আমি এ ব্যাপারে কিছু বলতে চাই না।’
রেলওয়ের এক প্রকৌশলী জানান, ফারহানা সুলতানা তার দায়িত্বকালীন শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট তৈরি করেছিলেন। ক্ষমতার প্রভাবে তার বদলি আদেশ এপ্রিল মাসে হলেও তিনি গড়িমসি করে মে মাসের শেষে পাহাড়তলী স্টেশনে যোগ দেন। পরবর্তী মাসেই ফের তাকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনা হয় ‘বিশেষ সুবিধায়’ এবং বর্তমানে তিনি রেল ভবনে উপপ্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা-২ পদে কর্মরত।’
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ এবং বুয়েট অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক বলেন, ‘প্রয়োজন ছিল বলেই সরকার রেলওয়ে হাসপাতালকে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন জেনারেটরটি অনুদান হিসেবে দিয়েছিল। কিন্তু সেটি যদি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ হাসপাতালে ব্যবহারের ব্যবস্থা না করে, তাহলে তা তদন্তের প্রয়োজন রয়েছে। এমনকি জেনারেটরটি সরকারের যে প্রতিষ্ঠান হাসপাতালে ব্যবহারের জন্য দিয়েছে, তারাও এটি তদন্ত করতে পারে। আর তদন্তে যে বা যারা দোষী সাব্যস্ত হবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। অনুদানের এই জেনারেটরটি বিক্রি করা দূরে থাক, অন্য কিছুতে সংযোজন করাটাও ঠিক নয়।’
বাংলাদেশ রেলওয়ের ঢাকা বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) মোহাম্মদ মহিউদ্দিন আরিফ বলেন, ‘জেনারেটর বিক্রির বিষয়টি আমার নজরে নেই। তবে খোঁজ নিয়ে প্রমাণ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জানানো হবে।’
বাংলাদেশ রেলওয়ে ঢাকা বিভাগীয় বৈদ্যুতিক প্রকৌশলী (ডিইই) শাকের আহমেদ বলেন, ‘জেনারেটর বিক্রির বিষয়টি আমার জানা নেই। আমি যোগদানের পর শুনেছি পদ্মা সেতু রেল লিঙ্ক প্রকল্পে একটি জেনারেটর অফিসিয়ালভাবে হস্তান্তর করা হয়েছে।’
রোগীদের জন্য বরাদ্দ অনুদানের জেনারেটর হাসপাতালের বদলে অন্য প্রকল্পে চলে যাওয়ার ঘটনায় রেলওয়ের একাধিক কর্মকর্তা, প্রকৌশলী ও বিশেষজ্ঞদের বক্তব্যে উঠে এসেছে নানা প্রশ্ন ও অসংগতি। সরকারি সম্পদের যথাযথ ব্যবহার ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতে প্রয়োজন নিরপেক্ষ তদন্ত ও যথাযথ ব্যবস্থা।
মন্তব্য করুন