শিকলে বাঁধা ৩০ বছর বয়সী মানসিক ভারসাম্যহীন যুবক সাইফুল ইসলাম। জন্মের পর থেকেই মানসিক ও শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার আরও অসুস্থতা বৃদ্ধি পায়। সাত বছর বয়স থেকে সাইফুল মানুষ দেখলে খামচি ও কামড় দেওয়ার চেষ্টা করত।
এর পর থেকেই তার মা রহিমা বেগম শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে শুরু করেন। দুই যুগ ধরে এভাবেই শিকলবন্দি জীবন কাটছে সাইফুলের।
সাইফুল ইসলামের বাড়ি টাঙ্গাইলের ঘাটাইল পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ধারিয়াল এলাকায়। সরকার থেকে পাওয়া ভাতা এবং ভিক্ষার টাকায় কোনোমতে চলে রহিমা বেগমের সংসার। অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে না পারায় দিন দিন ছেলের অবস্থা এমন হয়েছে—বললেন রহিমা বেগম।
ধারিয়াল গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তার পাশে একটি জীর্ণশীর্ণ টিনের ঘরের বারান্দায় খুঁটির সঙ্গে তালাবদ্ধ লোহার শিকলে বাঁধা সাইফুল ইসলাম। খালি গায়ে হাফপ্যান্ট পরিহিত সাইফুল ঘরের মেঝেতে বিছানো বেতের পাটিতে শুয়ে আছেন। উপস্থিতি টের পেয়ে তিনি উঠে বসে বড় বড় চোখে তাকিয়ে থাকেন। দীর্ঘদিন শিকলে বাঁধা থাকায় পায়ে ক্ষতচিহ্ন সৃষ্টি হয়েছে। শিকলে বাঁধা অবস্থাতেই চলে সাইফুলের খাবার গ্রহণ, ঘুমসহ অন্য সব কাজকর্ম। সাইফুলের শিকলবন্দি জীবনের একমাত্র সঙ্গী তার মা রহিমা বেগম।
বহর আলী ও রহিমা বেগমের সংসারে ১৯৮৮ সালের ২৯ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন সাইফুল। ২০ বছর আগে মারা যান বহর আলী। রহিমা বেগম জানান, জন্মের পর থেকেই মানসিক ও শারীরিক সমস্যা দেখা যায়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার অসুস্থতাও বৃদ্ধি পায়। সাত বছর বয়স থেকে সে মানুষ দেখলে খামচি ও কামড় দেওয়ার চেষ্টা করত। এসব থেকে সাইফুলকে ফেরানোর সব চেষ্টা ব্যর্থ হাওয়ায়, একপর্যায়ে এলাকাবাসী তার আচরণে ভয় পেতে শুরু করে। পরে বাধ্য হয়ে ৮ বছর বয়সে ১৯৯৫ সালে সাইফুলের পায়ে লোহার শিকল পরিয়ে ঘরে বেঁধে রাখা হয়।
রহিমা বেগম বলেন, অভাবের সংসারে আমার প্রতিবন্ধী ছেলে সাইফুলকে ঘিরেই চলে জীবনযাত্রা। ঘরের সামনে এক চিলতে বারান্দা তার ঠিকানা। সারা দিন তাকে তালাবদ্ধ ঘরে শিকলে বেঁধে রাখতে হয়। মন চাইলে ওখানেই ঘুমায়, নয়তো চোখ মেলে চেয়ে থাকে। তার মুখে কোনো ভাষা নেই। হাউমাউ করে কখনো যা বলে, তা বোধগম্য নয়। সরকার থেকে একটি ঘর দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া প্রতি তিন মাসে আমাকে ১ হাজার ৮০০ টাকা এবং সাইফুলকে ২ হাজার ৫০০ টাকা ভাতা দেয় সরকার। এতে দুজনের জীবন চলে না, তাই ভিক্ষাবৃত্তির পথ বেছে নিতে হয়েছে।
স্থানীয়রা বলেন, সাইফুলের বাবা বহর আলী মারা গেছেন প্রায় ২০ বছর আগে। বিধবা রহিমা সহায়সম্বল হারিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবনের ঘানি টানছেন। তাদের ঘরে রহিজ ও বাচ্চু নামে দুটি ছেলে আছে। বয়সে তারা সাইফুলের বড়। বিয়ে করে স্বল্প আয়ে পৃথকভাবে সংসার পেতেছেন। অভাবে কেউ কারও খোঁজ নেয় না।
স্থানীয় জহুরুল ইসলাম বলেন, সাইফুল আমাদের সমবয়সী। ছেলেবেলা থেকেই দেখছি সে শিকলে বাঁধা অবস্থায় দুর্বিষহ দিনাতিপাত করছে। তার শৈশব-কৈশোর কেটেছে এক বিপরীতমুখী পরিবেশে। সরকারের উচিত অসহায় সাইফুল ও তার মাকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা।
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আব্দুল হান্নান সরকার বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে আরও কোনো সহযোগিতা করা যায় কি না, তা খোঁজখবর নিয়ে চেষ্টা করা হবে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু সাঈদ বলেন, সরকার থেকে প্রাপ্ত ভাতায় যদি তাদের অভাব সংকুলান না হয়, তাহলে সহযোগিতার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মন্তব্য করুন