বাংলাদেশের বৃহত্তম গ্রাম বানিয়াচংয়ে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টে অভ্যুত্থানের দিনে সংঘর্ষ, থানায় হামলা, পুলিশের গুলিতে গ্রামবাসীর মৃত্যুর পর সেনাবাহিনী, প্রশাসনের সঙ্গে স্থানীয়দের ‘পুলিশ হত্যা’র দাবি নিয়ে দরকষাকষির এক নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে। ওইদিন বিক্ষুব্ধরা বানিয়াচং থানায় আক্রমণ চালিয়ে অস্ত্র লুট ও অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় অর্ধশতাধিক পুলিশকে অবরুদ্ধ করা হয়।
এর আগে এলাকাটিতে পুলিশের গুলিতে অন্তত আট গ্রামবাসী নিহত হয়। পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর পর হাজার হাজার গ্রামবাসী থানা ঘেরাও করে। এরপর তারা সব পুলিশকে হত্যার হুমকি দেয়। দিনভর আলাপ-আলোচনার পর গভীর রাতে পুলিশ সদস্যদের থানার ভেতর থেকে উদ্ধারের সময় এসআই সন্তোষ চৌধুরীকে থানা চত্বরেই পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পরদিন ৬ আগস্ট তার মরদেহ থানার সামনে একটি গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী এবং স্থানীয়রা জানান, বানিয়াচংয়ে বিক্ষুব্ধ জনতা শেষ পর্যন্ত সন্তোষ চৌধুরীকে জনতার হাতে তুলে দেওয়ার দাবিতে অনঢ় অবস্থানে ছিলেন। সেনাবাহিনীর সঙ্গে জেলার এসপি, ডিসি এমনকি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতারা একযোগে উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তাকে বাঁচানো যায়নি।
ঘটনার এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, প্রথমে তারা সব পুলিশকে মারতে চেয়েছিল। কিন্তু সেনাবাহিনী দেয়নি। একপর্যায়ে তারা সন্তোষকে না দিলে রাস্তা আটকে রাখার হুশিয়ারি দেয়। এমননিক একজনকেও নিয়ে যেতে দেওয়া হবে না বলেও জানায় বিক্ষুব্ধরা।
ঘটনার দিনে থানায় অবরুদ্ধ অর্ধশতাধিক পুলিশ সদস্যকে উদ্ধার করে সরিয়ে নেয় সেনাবাহিনী। উদ্ধার হওয়া এক পুলিশ কর্মকর্তা মো. আবু হানিফ বলেন, তারা বেঁচে ফিরবেন সেটা ভাবতেও পারেননি। সেনাবাহিনী তাদের সঙ্গে আলোচনা করছে। কিন্তু পরে উপায় না পেয়ে আটকাতে পারেনি। আমরা ভেবেছিলাম তাকে থানার ভিতরে রেখে আমাদের উঠিয়ে সেনাবাহিনী একটা কিছু করবে। সেনাবাহিনী হয়তো তাকে এসকোর্ট করে নিবে। কিন্তু সন্তোষ যখন থানার ভেতর থেকে বের হয়ে লাইনে দাঁড়ায় তখনই পাবলিক তাকে থাবা মেরে নিয়ে যায়।
এ ঘটনার ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসআর) ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বিবিসি জানিয়েছে, এসআই সন্তোষকে কেন টার্গেট করা হলো তার পেছনে দুটি বিষয় কাজ করেছে। প্রথমত, ৫ আগস্ট গুলি করা এবং এলাকায় পুলিশ হিসেবে তার অতীত ভূমিকা। উদ্ধার হওয়া পুলিশ কর্মকতা জানান, ওইদিন গুলি চালিয়ে একাধিক মানুষ হত্যার দায়ে সন্তোষ চৌধুরীকে অভিযুক্ত করা হয়। এছাড়া অতীতের কিছু কর্মকাণ্ড নিয়েও একটি অংশ তার ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন।
বানিয়াচংয়ের স্থানীয় এক ব্যবসায়ী বলেন, তার উপর কিছু মানুষের ক্ষোভ ছিল। সে অনেক মানুষরে জ্বালাইছে। আওয়ামী লীগ বিরোধীদের ধরে টাকা-পয়সা আদায় করছে। তার প্রতি ক্ষোভ ছিল।
থানার কাছে গ্রামের একজন বাসিন্দা অবশ্য ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সন্তোষকে টার্গেট করার বিষয়টি সামনে আনেন। তার ভাষায় সাধারণ মানুষের জন্য সন্তোষ ভালো মানুষ ছিলেন।
অন্যদিকে কোন পর্যায়ে গুলি করতে গেলেন- এ প্রশ্নে থানার তৎকালীন পরিদর্শক তদন্ত আবু হানিফ বলেন, তাৎক্ষণিকভাবে সন্তোষ ভেবেছিল গুলি করলে ওরা চলে যাবে। হাজার হাজার মানুষ থানা ঘেরাও করে ইট-পাটকেল মারছিল, থানায় আগুন দিয়েছিল। দোতলা বিল্ডিংয়ে প্রতিটা রুমে আগুন দেওয়া হয়। নিচতলায় আগুন, উপর তলায় একটা রুমে আমরা ৬০-৬৫ জন বন্দি হয়ে পড়ি। নিচে অস্ত্রাগার পুড়ছিল আর ধোঁয়া আমাদের চোখে মুখে লাগছিল। হয়তো আর ১০-১৫ মিনিট থাকলে আমরা শ্বাসকষ্টে মারা যেতাম।
মন্তব্য করুন