বীর সাহাবী
প্রকাশ : ২৬ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৬ জুলাই ২০২৫, ১০:১৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আইনে নিষিদ্ধ মিনিকেটে বাজার সয়লাব

অতিরিক্ত পালিশে নষ্ট হয় পুষ্টি উপাদান
নিষিদ্ধ মিনিকেট
আইনে নিষিদ্ধ মিনিকেটে বাজার সয়লাব

বাংলাদেশে মিনিকেট নামে কোনো ধান উৎপাদন হয় না। এ নামে কোনো ধানের জাতও নেই। বিআর-২৮ ও ২৯ জাতের ধান সংগ্রহের পর মিলগুলোতে আধুনিক যন্ত্রের মাধ্যমে ধান থেকে চাল আলাদা করা হয়। এরপর চালের গায়ের প্রাকৃতিক খোসা ও আবরণ তুলে ফেলতে একাধিকবার পালিশ করা হয়। এতে চাল সাদা ও চকচকে হয়ে ওঠে। এরপর চালগুলোকে কেটে ছোট ও সমান আকারের করা হয়, যেন দেখতে একরকম হয়। এই ছাঁটাই ও পালিশ প্রক্রিয়ার পরই একে বাজারে ‘মিনিকেট’ নামে বিক্রি করা হচ্ছে। আর প্রজ্ঞাপন জারি করে এই মিনিকেট গত বছরের মে মাসে নিষিদ্ধ করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও এই নামে বাজারে চাল বিক্রি করে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠীর বিভিন্ন ব্র্যান্ড।

বিশেষজ্ঞদের মতে, অতিরিক্ত পালিশের কারণে চালের গায়ের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান যেমন—ভিটামিন বি১, বি৬, আয়রন ও ফাইবার অনেকটাই নষ্ট হয়ে যায়। এর ফলে শরীরে শর্করার মাত্রা দ্রুত বাড়ে, যা ডায়াবেটিসসহ নানা রোগের ঝুঁকি তৈরি করে।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউশনের তথ্যমতে, দেশে মিনিকেট নামে কোনো ধানের জাত নেই। এই নামটি মূলত ভোক্তা আকৃষ্টকরণ ব্র্যান্ড, যা বিভ্রান্তিকর। সম্প্রতি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বাজারে মিনিকেট নাম ব্যবহার বন্ধে কয়েকটি চাল কোম্পানি নিয়ে বৈঠকও করেছে।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কার্যক্রম উপবিভাগের উপপরিচালক আতিয়া সুলতানা কালবেলাকে বলেন, এটা নিয়ে চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কিছুদিন আগে আমাদের একটা মিটিং হয়েছে। আমরা তাদের এগুলো যে নিষিদ্ধ, এই সম্পর্কে বলেছি। তারাও সহযোগিতা করবে বলে জানিয়েছেন। তবে সারা দেশের বাজার তো এগুলো দিয়ে ভরা। এগুলো তুলে নিতে একটু সময় তো লাগবে। এ ব্যাপারে আমাদের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

রাজধানীর শ্যামবাজার, নিউমার্কেট, গেন্ডারিয়া, সূত্রাপুরসহ বেশ কিছু বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে তীর, ডায়মন্ড, সাগর, রশিদ, মঞ্জুর, মোজাম্মেলসহ অনেক কোম্পানির মিনিকেট নামে চাল বিক্রি হচ্ছে। চালের মান ও গঠন একরকম হলেও ব্র্যান্ড আলাদা হওয়ায় দামও ভিন্ন। কেজিতে ৮০ থেকে ৮৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। আর ৫০ কেজির বস্তা ৩ হাজার ৮০০ থেকে ৪ হাজার ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যেখানে আটাশ চাল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

দেশের বিভিন্ন রাইস মিল থেকে মিনিকেট নামে চাল বিক্রি করা হলেও কৃষকের কাছে সেই ধান নেই। এটা মিলের মালিকরাও স্বীকার করছেন। তারাও বলছেন, বিআর-২৮ বা ২৯ ধান পালিশ করে মিনিকেট চাল করা হচ্ছে। এটা প্রতারণার শামিল। তা বন্ধ করতে হবে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ অটো রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ কে এম খোরশেদ আলম কালবেলাকে বলেন, বাংলাদেশে মিনিকেট নামে কোনো ধানের জাত নেই। ভারতে এ নামে আছে। যারা বলছেন, মিনিকেট ধানের চাষ হয়, তা ঠিক নয়। আমিও দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি, মিনিকেট নামে কোনো ধানের জাত বাংলাদেশে নেই। কেউ বিআর-২৮, কেউ বিআর-২৯ ধান কেটে বা পালিশ করে মিনিকেট নামে চাল বিক্রি করছেন। বিগত সরকারের আমলে খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে আইন করা হয়েছে যে, এই নামে কেউ চাল বিক্রি করতে পারবে না। যে ধানের চাল ঠিক সেই নামই লিখতে হবে। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি, এখনো এগুলো বন্ধ করা যায়নি।

মিনিকেটের নামে প্রতারণা ঠেকাতে ২০২৩ সালের ১১ জুলাই তৎকালীন সরকার একটি আইন প্রণয়ন করে। এই আইনে চালের বস্তার গায়ে মিনিকেটের মতো ভিন্ন নাম লিখলে দুই বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত দণ্ডের বিধান রাখা হয়। আইনটি প্রণয়নের এক বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো বাজারে মিনিকেটের রমরমা ব্যবসা চলছে।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেট ও বাদামতলীতে বেশিরভাগ চালের আড়ত। এই দুই বাজার থেকেই সারা ঢাকা শহরের অলিগলিতে ছোটখাটো দোকানের মাধ্যমে ভোক্তাদের ঘরে পৌঁছে যায় চাল। কৃষি মার্কেটে দেখা যায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া ও শেরপুরের বিভিন্ন কোম্পানির হরেক রকমের মিনিকেট চালে ভরা প্রায় সব আড়ত। এসব আড়তে বিভিন্ন রাইস মিল থেকে চাল উৎপাদিত হয়ে মিনিকেট নামেই প্যাকেটের গায়ে লেখা চাল বিক্রি করা হচ্ছে।

বাদামতলীর মেসার্স সাঈদ রাইস এজেন্সির আবু সাঈদ বলেন, রশিদ, গোল্ডেন, নজরুল, মা ভান্ডারি, অভিজাত, ইশানসহ বিভিন্ন কোম্পানির মিনিকেট চাল পাইকারি পর্যায়ে ৭০ থেকে ৭৫ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে। সেই চালই খুচরা পর্যায়ে ৮০-৮৫ টাকায় বিভিন্ন দোকানে খুচরা বিক্রেতারা বিক্রি করছেন। তবে মোজাম্মেল ও এরফান মিনিকেট আরও বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন কালবেলাকে বলেন, মিনিকেট হলো বহুল বিক্রীত চাল। আগের সরকারের আমলে এটার বিষয়ে বিক্রি না করার বিষয়ে বলা হয়েছিল। কয়েকদিন আগে ভোক্তা সংরক্ষণ চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সভা করে নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হয়েছে। এ নামে যেহেতু কোনো ধানের জাত নেই, তাই এই নামে চালও বিক্রি করা যাবে না। এখন আমরাও মনে করি তা বাতিল হওয়া দরকার। বিআর-২৮ চালকে মেশিন কাটছাঁট করে মিনিকেট নামে বিক্রি করে। বিআর ২৮ তো আর এত দাম না। আমরা বেশি দাম দিয়ে মিনিকেট কিনছি, কিন্তু চালের যে মূল পুষ্টি উপাদান, সেটা পাচ্ছি না। একদিকে যেমন আমি ভোক্তা হিসেবে বেশি দাম দিয়ে কিনছি, অন্যদিকে বঞ্চিত হচ্ছি পুষ্টি থেকে। তাই এটা বন্ধে সরকারের শক্তিশালী ভূমিকা প্রয়োজন।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান কালবেলাকে বলেন, খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে বলা আছে, মিনিকেট নামে কোনো জাত নেই। অনেক ভোক্তা আমাকে টেলিফোনে বলেন, এই নামে কোনো ধান নেই, তাহলে বাজারে চাল কেন আছে? কয়েকদিন আগে আমি সভা করলাম ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। তারা বললেন, ভারতে এই নামে চাল আছে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশে এমন কিছু আছে কি না, তা দেখাতে পারেননি। পরবর্তী সময়ে তারা বিভিন্ন বিতর্ক করে বলেছেন, তারা মিনিকেট বাজার থেকে তুলে নেবেন। তারা দুই-তিন মাস সময় চেয়েছেন বাজার থেকে এটা তুলে নিতে। আমরা বলেছি, ১৫ দিনের মধ্যে এটা তুলে নিতে হবে। পরে খবর এলো, এই চালগুলো তুলে নিলে বাজারে একটি সংকট তৈরি হবে। এখন এটা নিয়ে আমার মন খারাপ। এখন ভোক্তা অধিদপ্তর আইন অনুযায়ী কাজ করছে। এজন্য ভোক্তার ওপরও কোনো কোনো পক্ষ নাখোশ। এখন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উচিত এই আইনটা কিছুদিনের জন্য শিথিল করা। তাহলে বাজারে এটার নেতিবাচক প্রভাব বা সংকট সেভাবে হবে না।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ফেসবুকে এনসিপির সমাবেশ প্রতিহতের ঘোষণা, যুবলীগ নেতা আটক

হাতিয়ায় ৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত

‘ইমাম, কওমি মাদ্রাসা শিক্ষক ও সাংবাদিকদের সরকারি বেতন-ভাতা দিতে হবে’

বছর না পেরোতেই হাজার কোটি টাকার সড়কে ভাঙন

বিগত তিনটি নির্বাচনেই ভুয়া জনপ্রতিনিধিরা দেশ পরিচালনা করেছে : মঈন খান

প্রকাশ পেল সৌরভ অধিরাজের ‘একলা তারা’

তিন দিনের মধ্যে ঐকমত্যের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারব : আলী রীয়াজ

সড়কে ক্লাসের কর্মসূচি দিলেন রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা

বাংলাদেশিদের জন্য ১০ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাংকিং টিপস

১০ আগস্ট এসএসসির খাতা পুনর্নিরীক্ষণের ফল প্রকাশের সম্ভাবনা

১০

শহীদদের আবাসন প্রকল্পে ব্যয় দেখানো হয়েছে ৪৫ গুণ বেশি

১১

চাঁদাবাজির সময় হাতেনাতে ধরা রাজ্জাক পুলিশ কমিশনের সদস্য, দাবি মাহিনের

১২

সাইয়ারা’র রেকর্ড

১৩

ট্রাক-অটোরিকশা সংঘর্ষে নিহত ২

১৪

হোয়াটসঅ্যাপে একসঙ্গে সব আনরিড মেসেজ দেখবেন যেভাবে

১৫

গুগল নিয়ে এলো নতুন ফিচার ‘ওয়েব গাইড’

১৬

এক ইঞ্চি জায়গা আমরা পরাধীন হতে দেব না : আখতার

১৭

যে তরুণরা মাথার মুকুট ছিল, এখন তাদের নিয়ে অভিযোগ কেন : রাশেদ

১৮

যুদ্ধবিরতির আলোচনায় সম্মতি, তবুও চলছে পাল্টাপাল্টি হামলা

১৯

সুন্দরবনে ট্রলারসহ ৭০০ কেজি কাঁকড়া জব্দ 

২০
X