জুলাই অভ্যুত্থানের রক্তক্ষয়ী ঘটনার এক বছর পেরিয়ে গেলেও শহীদদের পরিবার এখনো গভীর শোক ও মানসিক আঘাত থেকে বের হতে পারেনি। রাজধানীসহ সারা দেশে আন্দোলনের সময় শহীদ হওয়া ছাত্র-জনতার স্মৃতি এখনো পরিবারগুলোর মনে তাজা ক্ষতের মতো। শহীদদের স্বজনরা অনেকে এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। সন্তান হারানো মায়েরা প্রতিদিনই স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। অনেক পরিবার আর্থিক ও সামাজিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের স্বজন এবং আহতরাও সবচেয়ে বেশি ট্রমাটাইজ অবস্থায় আছেন। অনেকেই ফিরতে পারছেন না স্বাভাবিক জীবনে। তারা নানারকম হতাশায় ভুগছেন। যারা সরাসরি আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন এবং এ সময়ের মধ্য দিয়ে গেছেন, তাদের অনেকেই এখনো খাওয়া-দাওয়া করতে পারছেন না, ঘুমাতে পারছেন না। তারা সঠিকভাবে মানসিক স্বাস্থ্যসেবাও পাচ্ছেন না। সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে জোর দেওয়ার দাবি জানান তারা।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, জুলাই অভ্যুত্থানে নিহতদের পরিবারের জন্য দীর্ঘমেয়াদি মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা ও পুনর্বাসন কর্মসূচি জরুরি। পাশাপাশি, বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত না হলে পরিবারগুলোর ক্ষোভ ও বেদনা আরও গভীর হবে। চট্টগ্রামের এক শহীদের মা জানান, এখনো রাতে ঘুমের মধ্যে ছেলের নাম ধরে ডাকেন তিনি। পরে পরিবারের অন্য সদস্যরা তাকে ঘুম থেকে তুলে পানি খাওয়ান। শুধু তিনি নন, শহীদ পরিবারের সদস্যরা সবাই প্রায় এমন পরিস্থিতিতে আছেন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
শহীদ মিরাজের ছোট ভাই পাভেল হোসেন বলেন, মিরাজের আয় দিয়েই আমাদের সংসারটা চলত। তাকে হারিয়ে আমরা যেন সবকিছুই হারিয়েছি। মা-বাবা সারাক্ষণ কান্না করেন। এখনো ঠিকমতো ঘুমান না, খান না। আমরা এ হতাশা থেকে কোনোভাবেই বের হতে পারছি না।
আমাদের পুরো পরিবারই এখনো ট্রমাটাইজ। এখন পর্যন্ত বিচার দেখতে না পাওয়াও আমাদের জন্য বড় হতাশার।
শহীদ আরাফাতের বড় ভাই হাসান আলী বলেন, আরাফাতের প্রতিটি মুহূর্ত আমাদের কাঁদাচ্ছে। তার সব স্মৃতি চোখে জ্বলজ্বল করছে। আমার ভাইয়ের খুব পছন্দের ছিল মাংস। সে চলে যাওয়ার পর থেকে আম্মা-আব্বাসহ আমরা আর মাংস খাই না। খেতে বসলেও আমরা খেতে পারি না। তার শোক আমরা কোনোভাবেই ভুলতে পারছি না।
আক্ষেপের সঙ্গে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে গুলিতে শহীদ মামুন হাওলাদারের স্ত্রী জাকিয়া বেগম বলেন, আমার স্বামী ঢাকায় ব্যবসা করতেন। এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে আমরা ছোট পরিবার ছিলাম। তার মৃত্যু আমাদের জীবনে অন্ধকার নেমে আসে। এখনো কোনো কাজ জোটেনি। আত্মীয়স্বজনের সাহায্যে কোনোরকমে বেঁচে আছি। মানসিকভাবে আমরা একদমই ভেঙে পড়েছি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক আঞ্চলিক পরিচালক ও পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এম. মুজাহেরুল হক বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতরা ছাড়াও আহত এবং নিহতদের পরিবারের সদস্যরাও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তারা নানারকম হতাশায় ভুগছেন। তারা একটি সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছেন না। তাদের আবার সুস্থ জীবনযাপনে ফিরিয়ে আনতে হলে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তারা যে মানসিক অবসাদে ভুগছেন, তা কাটিয়ে উঠতে তাদের যথাযথ চিকিৎসা নিতে উৎসাহী করতে হবে এবং তারা সঠিক চিকিৎসা যাতে পান, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
আঁচল ফাউন্ডেশনের সভাপতি তানসেন রোজ বলেন, জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে আহত ও শহীদ পরিবারের শতকরা ৭৫ ভাগ বিষণ্নতায় ভুগছেন। অনেকে শারীরিকভাবে আহত হননি, কিন্তু মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর অ্যাকিউট স্ট্রেস ডিজঅর্ডার এবং পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার হওয়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি আমরা। জুলাই বিপ্লবের পর যে মানসিক স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এবং হবে সেটি মোকাবিলা করা, ১৮ কোটি মানুষের জন্য সার্বিক মানসিক স্বাস্থ্যের কর্মকৌশল নির্ধারণে কাজ করতে হবে।
মন্তব্য করুন