ইতালির পিসা টাওয়ারের মতো দেখতে বরিশালের গৌরনদী উপজেলার অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন মাহিলাড়া সরকার মঠ। প্রায় তিনশ বছরের পুরোনো মঠটি স্থানীয়ভাবে সরকার মঠ নামে পরিচিত হলেও এটি মূলত শিখর মন্দির শিল্পের এক অপূর্ব নিদর্শন হিসেবে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে সুদৃশ্য মঠটি দেখতে সোজা মনে হলেও কাছে গেলেই দেখা যায়, এটি দক্ষিণ-পূর্ব কোণে হেলে রয়েছে। মঠের দেয়ালে খোদিত কোনো লিপি না থাকলেও মঠের ইতিহাস থেকে জানা গেছে, নবাব আলীবর্দী খাঁ (১৭৪০-১৭৫৬) শাসনামলে সরকার রূপরাম দাশগুপ্ত নামে স্থানীয় এক প্রভাবশালী ব্যক্তি মঠটি নির্মাণ করেছিলেন।
মঠ নির্মাণের পর থেকে এখানে পূজা ও সনাতন ধর্মীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠান হতো। বর্তমানে মঠের পাশেই একটি আশ্রম ও মন্দির রয়েছে। সরকার মঠটি হেলে থাকার রহস্য নিয়ে জনশ্রুতি রয়েছে—মঠ প্রতিষ্ঠাতার সময় রূপরাম দাশের মায়ের সমাধি স্থল রয়েছে মঠের অভ্যন্তরে। প্রতিষ্ঠাতা মঠ স্থাপন করে দম্ভের সঙ্গে রূপরাম বলেছিলেন, মা তোমার দুধের ঋণ শোধ করে দিলাম। এরপর থেকেই মঠটি দক্ষিণ-পূর্ব কোণে হেলে গিয়েছে। তবে অনেকেই আবার ভিন্নমত পোষণ করে বলেছেন, মঠ সংলগ্ন সুবিশাল দিঘি থাকার কারণেই সুউচ্চ মঠটি কিছুটা হেলে গেছে।
ভূপৃষ্ঠ থেকে মঠটি প্রায় ২৭ দশমিক ৪০ মিটার উঁচু।
অষ্টভুজাকারে নির্মিত এ মঠের নিচের দিকের প্রতিটি ভুজ বা বাহুর দৈর্ঘ্য ১ দশমিক ৯১ মিটার। এ বাহুগুলো ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৬ দশমিক ২ মিটার ওপর পর্যন্ত একই দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট। এরপর মঠটি ক্রমেই সরু হয়ে ওপরের দিকে উঠে গেছে। সরু অংশটি অসংখ্য ধনুক আকারের কার্ণিসের অলংকরণ শোভিত হয়ে শিখরে গিয়ে শেষ হয়েছে। মঠের অভ্যন্তরে বর্গাকারে নির্মিত একটি ছোট কক্ষও আছে। এ কক্ষটির একমাত্র প্রবেশপথ মঠের পশ্চিম দেয়ালে।
প্রবেশ পথটির ওপরে অবস্থিত প্যানেলটিতে বেশ কিছু জ্যামিতিক অলংকরণ রয়েছে। এরূপ অলংকরণ মঠের অন্যান্য দিকেও দেখা যায়। কক্ষের ভেতরে মঠের দুই পাশে আড়াআড়িভাবে লাগানো কমপক্ষে ৮ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি বাঁশ রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, নির্মাণকাল থেকেই বাঁশটি ওই অবস্থায় রয়েছে। এ মঠটি বাংলাদেশ সরকারের একটি সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। বর্তমানে মঠের বিভিন্ন অংশের পলেস্তারা খসে পড়েছে। দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার না করায় এবং মঠের দক্ষিণ পাশের দিঘিতে কোনো পাইলিং না থাকায় চরম হুমকিতে রয়েছে প্রাচীন এ নিদর্শনটি।
স্থানীয় বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা সুধীর কুমার দাস (বীরপ্রতীক) জানিয়েছেন, ১০ বছর আগে মঠটি সংস্কার করা হয়েছে। বর্তমানে মঠের বিভিন্ন স্থানের পলেস্তারা খসে পড়েছে। দিঘির পাড়ে পাইলিং না থাকায় মঠটি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। প্রাচীন এ নিদর্শনটি রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
সরকার মঠের সামনের দুর্গামন্দির কমিটির সাধারণ সম্পাদক রতন কুমার দাস বলেন, দেশ-বিদেশের পর্যটকরা মঠটি পরিদর্শন করতে এসে খুবই খুশি হন। কিন্তু এখানে ভালো কোনো ওয়াশরুম, পর্যটকদের জন্য রেস্ট রুম, কিংবা বসার ব্যবস্থা না থাকায় দর্শনার্থীরা হতাশ হয়ে ফিরে যান।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রিফাত আরা মৌরি জানিয়েছেন, এ উপজেলার পুরাকীর্তিগুলো এখনো ঘুরে দেখা হয়নি। শিগগির প্রাচীন নিদর্শনগুলো পরিদর্শন করে সব সমস্যা সমাধানের জন্য প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হবে।
মন্তব্য করুন