শেখ হারুন
প্রকাশ : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯:২২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

প্রকল্প সমাপ্তির প্রতিবেদন দিতে গড়িমসি

জবাবদিহি প্রশ্নবিদ্ধ
প্রকল্প সমাপ্তির প্রতিবেদন দিতে গড়িমসি

দেশে প্রতি বছর উন্নয়ন প্রকল্পের সংখ্যা বাড়ছে, হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে, বাড়ছে বিপুল ব্যয়। কিন্তু প্রকল্প শেষ হওয়ার পর তা কতটা কার্যকর হলো, প্রকল্পের উদ্দেশ্য পূরণ বা জনগণ উপকৃত হলো কি না, ব্যয় স্বচ্ছভাবে হলো কি না—এসব প্রশ্নের উত্তর মেলে প্রকল্প সমাপ্তি প্রতিবেদনে (পিসিআর)। এই প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে মূল্যায়ন করে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। আইনের বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও প্রকল্প পরিচালকরা (পিডি) সময়মতো এ প্রতিবেদন জমা দেন না। ফলে সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমের জবাবদিহি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে।

আইএমইডি সূত্রে জানা গেছে, গত তিন অর্থবছরে (২০২১-২২ থেকে ২০২৩-২৪) ৯৪৯টি প্রকল্প শেষ হয়েছে। এর মধ্যে ২১৮টি প্রকল্পের পিসিআর জমা হয়নি। ২০২১-২২ অর্থবছরে শেষ হওয়া ৩৪৪ প্রকল্পের মধ্যে ২৭টির, ২০২২-২৩ অর্থবছরের ৩১২ প্রকল্পের মধ্যে ৭১টির এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ২৯৩ প্রকল্পের মধ্যে ১২০টির পিসিআর জমা দেয়নি প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

আইন অনুযায়ী, প্রকল্প শেষ হওয়ার তিন মাসের মধ্যে সমাপ্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। নির্ধারিত সময় তো দূরের কথা, চার থেকে পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও অনেক প্রকল্পের পিসিআর জমা হয়নি। আইএমইডির একাধিক কর্মকর্তা কালবেলাকে জানান, বারবার তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও অনেক প্রকল্প পরিচালক প্রতিবেদন জমা দেন না। প্রকল্পের অনিয়ম-দুর্নীতি ঢাকতে এবং প্রকল্প চলাকালীন কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠার আশঙ্কায় পিসিআর জমা দিতে গড়িমসি করেন তারা।

আইএমইডির তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩৪৪ প্রকল্প সমাপ্ত হলেও ২৭টির পিসিআর পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া ৩২টি প্রকল্পের পরিদর্শন বাকি রয়েছে এবং ১৪টির মূল্যায়ন প্রতিবেদন জারি হয়নি। সামগ্রিকভাবে ৭৩টি প্রকল্পের মূল্যায়ন কাজ অসমাপ্ত রয়েছে।

২০২২-২৩ অর্থবছরে শেষ হওয়া ৩১২ প্রকল্পের মধ্যে ৭১টির পিসিআর পাওয়া যায়নি। ১৮৬টি প্রকল্পের মাঠপর্যায়ে পরিদর্শন হলেও ৫৫টির বাকি রয়েছে। ১৬৪টি প্রকল্পের মূল্যায়ন প্রতিবেদন জারি হলেও ২২টির কাজ অসম্পূর্ণ। এভাবে ১৪৮টি প্রকল্পের মূল্যায়ন কাজ বাকি।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে শেষ হওয়া ২৯৩ প্রকল্পের মধ্যে ১২০টির পিসিআর জমা হয়নি। ৮৫টি প্রকল্প পরিদর্শন করা হলেও ৮৮টির কাজ অসমাপ্ত। ৫৫টির মূল্যায়ন প্রতিবেদন জারি হলেও ৩০টির কাজ আটকে আছে। ফলে ২৩৮টি প্রকল্পের মূল্যায়ন এখনো বাকি।

কেবল সাম্প্রতিক বছরেই নয়, অতীতেও একই চিত্র দেখা গেছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে শেষ হওয়া ১১টি প্রকল্পের পিসিআর ছাড়াই আইএমইডিকে মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করতে হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরেও একই ঘটনা ঘটে। এতে প্রকল্পের কার্যকারিতা নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।

সমাপ্ত প্রকল্পের মূল্যায়নে জট: আইএমইডির সমন্বয় সভা সূত্রে জানা গেছে, সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প শেষ হলেও সমাপ্ত প্রকল্পের পিসিআর প্রণয়ন ও প্রকাশে মারাত্মক জটিলতা তৈরি হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের সমাপ্ত প্রকল্প প্রতিবেদন চার খণ্ডে প্রকাশের কাজ চললেও এখনো সব খণ্ড প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। আর ২০২১-২২ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত তিন বছরে মোট ৪৫৯টি প্রকল্পের পিসিআর এখনো বাকি রয়েছে।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বাস্তবায়নের পর পিসিআর সংগ্রহ থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ে পরিদর্শন এবং মূল্যায়ন প্রতিবেদন জারি—সব জায়গায় শিথিলতা রয়েছে। মন্ত্রণালয় ও বাস্তবায়নকারী সংস্থার উদাসীনতার কারণে নির্ধারিত সময়ে পিসিআর জমা হচ্ছে না; মাঠপর্যায়ে পরিদর্শন না করায় মূল্যায়ন আটকে যাচ্ছে এবং প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়ের ঘাটতির কারণে পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট খাতগুলোও দ্রুততার সঙ্গে কাজ এগিয়ে নিতে পারছে না।

আইএমইডির তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট সমাপ্ত প্রকল্প ৩৪৪টি; পিসিআর পাওয়া গেছে ৩১৭টি এবং পাওয়া যায়নি ২৭টির। প্রকল্প পরিদর্শন করা হয়েছে ২৮৫টি, পরিদর্শন বাকি রয়েছে ৩২টি। পরিদর্শনের পর মূল্যায়ন প্রতিবেদন জারি হয়েছে ২৭১টি এবং প্রতিবেদন জারি বাকি রয়েছে ১৪টি। সামগ্রিকভাবে মূল্যায়ন কাজ অসমাপ্ত রয়েছে ৭৩টি।

২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট সমাপ্ত প্রকল্প ৩১২টি; পিসিআর পাওয়া গেছে ২৪১টি এবং পাওয়া যায়নি ৭১টি। প্রকল্প পরিদর্শন করা হয়েছে ১৮৬টি, পরিদর্শন বাকি রয়েছে ৫৫টি। পরিদর্শনের পর মূল্যায়ন প্রতিবেদন জারি হয়েছে ১৬৪টি এবং প্রতিবেদন জারি বাকি রয়েছে ২২টি। সামগ্রিকভাবে মূল্যায়ন কাজ বাকি রয়েছে ১৪৮টি।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট সমাপ্ত প্রকল্প ২৯৩টি; পিসিআর পাওয়া গেছে ১৭৩টি, পাওয়া যায়নি ১২০টি। পরিদর্শন করা হয়েছে ৮৫টি, পরিদর্শন বাকি রয়েছে ৮৮টি। পরিদর্শনের পর মূল্যায়ন প্রতিবেদন জারি হয়েছে ৫৫টি, প্রতিবেদন জারি বাকি রয়েছে ৩০টি। সামগ্রিকভাবে মূল্যায়ন কাজ বাকি রয়েছে ২৩৮টি।

আইএমইডির কর্মকর্তারা বলছেন, পিসিআর না পাওয়ায় তারা সরেজমিন যাচাই করতে পারছেন না। ফলে প্রকল্প এলাকায় কোনো অনিয়ম হয়েছে কি না, লক্ষ্য পূরণ হয়েছে কি না, ব্যয় স্বচ্ছভাবে হয়েছে কি না—এসব খতিয়ে দেখা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তারা মনে করেন, শাস্তি বা জবাবদিহির ব্যবস্থা না থাকায় প্রকল্প পরিচালকরা ইচ্ছাকৃতভাবে পিসিআর দেওয়ার বাধ্যবাধকতা অমান্য করেন।

এ বিষয়ে আইএমইডি সচিব মো. কামাল উদ্দিন কালবেলাকে বলেন, প্রকল্প মূল্যায়নের ম্যান্ডেট থাকলেও আইএমইডির ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার নেই। যতটুকু ক্ষমতা আছে তার মধ্যে থেকে আইএমইডি চেষ্টা করে যাচ্ছে, যাতে প্রকল্প শেষ হওয়ার তিন মাসের মধ্যেই পিসিআর পাওয়া যায়। কারণ পিসিআর না পেলে সমাপ্ত প্রকল্পের মূল্যায়ন করা যা না। এজন্য নির্ধারিত সময়ে সমাপ্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার বিষয়ে তাগাদা দেওয়া হয়। কিন্তু বারবার তাগাদা দিয়েও অনেক ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না।

বিশ্লেষকরা বলছেন, পিসিআর শুধু অর্থনৈতিক বা কারিগরি মূল্যায়নের বিষয় নয়, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় ভুল-ত্রুটি এড়াতেও এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্ধারিত সময়ে পিসিআর না দিলে প্রকল্পের কার্যকারিতা বোঝা যায় না, বাজেটের সঠিক ব্যবহার যাচাই হয় না, একই ধরনের ভুল নতুন প্রকল্পেও ঢুকে যায়। এতে জাতীয় বাজেট ও উন্নয়ন পরিকল্পনার স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

তাদের মতে, প্রকল্প বাস্তবায়নের এমন অবস্থা জনগণের করের টাকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। যেখানে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে, সেখানে মূল্যায়ন প্রক্রিয়া অবহেলা করার মানে হলো জনস্বার্থকে উপেক্ষা করা। শুধু নির্দেশনা নয়, বাস্তবে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায় সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমের অগ্রগতি ও জবাবদিহি উভয়ই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে।

পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সচিব মামুন আল রশীদ কালবেলাকে বলেন, কোন প্রকল্পে কী কাজ হলো, কোন অংশে সমস্যা হলো—সবই পিসিআরে থাকার কথা। পিসিআর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দলিল এবং প্রকল্প শেষে এটা জমা দেওয়া ম্যানডেটরি। এর পরও এটা জমা না দেওয়ার মতো উদাসীনতা গ্রহণযোগ্য নয়। যেসব প্রকল্প পরিচালক পিসিআর জমা দেননি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। আবার পিসিআর না নিয়ে প্রকল্প পরিচালককে রিলিজ করলে সেই কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

তিনি বলেন, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়কেও এ বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। নতুন প্রকল্প অনুমোদনের আগে সংশ্লিষ্ট সংস্থা যদি পুরোনো প্রকল্পের পিসিআর জমা না দেয়, তাহলে তাদের নতুন প্রকল্পে অনুমোদন দেওয়া উচিত নয়। এতে প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা আসবে, জবাবদিহি নিশ্চিত হবে। না হলে প্রকল্প শেষ হলেও মূল্যায়ন হবে না, এই ধারা চলতেই থাকবে।

অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, আইএমইডির কাজ সমাপ্ত প্রকল্পের পিসিআর মূল্যায়ন করে ত্রুটিবিচ্যুতি তুলে ধরে প্রতিবেদন দেওয়া। কিন্তু প্রকল্পে কোনো অনিয়ম হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার তাদের নেই। এ কারণে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা আইএমইডির কথা তেমন পাত্তা দেয় না। আর আইন না মানলে যেহেতু কোনো শাস্তি হয় না, তাই প্রকল্প পরিচালকদের এটা নিয়ে মাথাব্যথা থাকে না। এক্ষেত্রে কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না সেটার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকেই জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। জবাবদিহি নিশ্চিত না হলে এ অনিয়ম বন্ধ হবে না।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সাতক্ষীরায় ট্রাফিক আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক জরিমানা শুরু

নির্বাচন হতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই : দুদু

জবি ক্যাম্পাস সংলগ্ন এলাকা থেকে অবৈধ বাসস্ট্যান্ড সরানোর দাবিতে মানববন্ধন 

নির্বাচনের সাড়ে ৩ বছর পর শপথ নিলেন ইউপি সদস্য

নদীর পানির দাবিতে চিংড়ি ও কাঁকড়া চাষিদের মানববন্ধন

শুধু রাজনীতিতে নয়, অর্থনীতিতেও গণতন্ত্র আনতে হবে : আমীর খসরু 

নিজের উত্তরসূরিকে প্রকাশ্যে আনলেন কিম?

ইসরায়েলের সঙ্গে চুক্তি ভাঙার হুঁশিয়ারি দিল এক মুসলিম দেশ

দুর্নীতি মামলা / বেরোবির সাবেক উপাচার্য কলিমুল্লাহর জামিন নামঞ্জুর 

দায়িত্ব পাওয়া নিঃসন্দেহে বিরাট সম্মানের : মেহজাবীন

১০

নির্বাচন ঠেকানো সম্ভব নয় : ফারুক

১১

কম পানি খেলে কি সত্যিই কিডনিতে পাথর হয়? যা বলছে গবেষণা

১২

হাসিনা-জয়ের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারির আবেদন দুদকের

১৩

চিলির বিপক্ষে মারাকানায় যে একাদশ নিয়ে নামতে পারে ব্রাজিল

১৪

দেশে আসছে ‘দ্য কনজ্যুরিং: লাস্ট রাইটস’

১৫

প্লট দুর্নীতি / শেখ রেহানা-টিউলিপ-আজমিনার মামলায় তৃতীয় দিনে ৫ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ 

১৬

বৃষ্টি ও তাপমাত্রা নিয়ে আবহাওয়া অফিসের নতুন বার্তা

১৭

তিতাস কমিউটার ট্রেন লাইনচ্যুত

১৮

দুর্নীতি দমনেই গণতন্ত্র পুনর্গঠন সম্ভব : টিআই চেয়ারপারসন

১৯

গ্যাসের চুলা জ্বালাতেই বিস্ফোরণ, একই পরিবারে শিশুসহ দগ্ধ ৫

২০
X