বাংলাদেশ রেলওয়ে দীর্ঘদিন ধরে নানা সংকটে ভুগছে। সবচেয়ে তীব্র সংকট এখন লোকোমোটিভ (রেলের ইঞ্জিন) নিয়ে। এ অবস্থায় সরকার চীনের কাছে ২০টি লোকোমোটিভ অনুদান হিসেবে চেয়েছে। শুধু তাই নয়, যদি চীন অনুদান দেয়, তবে কাস্টমস শুল্ক, ডিডি ও ভ্যাট বাবদ খরচও চীনকেই বহন করতে হবে—এমন শর্তও সরকারের আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। চীন আসলেই অনুদান দেবে কি না, তা এখনো নিশ্চিত নয়।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো—ভবিষ্যৎ রক্ষণাবেক্ষণ। চীনের ইঞ্জিন নষ্ট হলে বা নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন হলে বাংলাদেশ রেলওয়ের যথেষ্ট সক্ষমতা নেই। চীন তাদের নিজস্ব নেটওয়ার্কে মিটারগেজ লোকোমোটিভ ব্যবহার করে না, কেবল সীমিত শিল্পাঞ্চল বা খনিতে ব্যবহার করে। ফলে ভবিষ্যতে যন্ত্রাংশ পাওয়া কঠিন হতে পারে। চীনা ইঞ্জিন নিয়ে আগের অভিজ্ঞতাও ইতিবাচক নয়।
২০১৩ সালে চীন থেকে ৬৫৩ কোটি টাকায় ২০ সেট ডেমু ট্রেন কেনা হয়েছিল, যেগুলোর আয়ু ধরা হয়েছিল ২০ বছর। কিন্তু মাত্র ছয় বছরেই এগুলো অচল হয়ে পড়ে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এতে সরকারের বিপুল অর্থ অপচয় হয়েছে।
তাদের মতে, ‘সব অনুদান নিলেই লাভ হয় না। চালানোর মতো সক্ষমতা আছে কি না, সেটিও দেখতে হয়।’ তারা মনে করেন, অনুদান নেওয়ার আগে সম্ভাব্যতা যাচাই করা জরুরি। নতুন ইঞ্জিন আনা হলে সেগুলো একেবারে নতুন নাকি পুরোনো—তাও নিশ্চিত হওয়া দরকার। পুরোনো ইঞ্জিন আনা হলে বিপদ আরও বাড়বে।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, নীতিগত অনুমোদন ছাড়াই সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং ইআরডির মাধ্যমে এরই মধ্যে আবেদন করা হয়েছে। তবে চীন সরাসরি অনুদান দেবে নাকি শুধু সরবরাহ করবে—এ বিষয়ে কোনো লিখিত নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি।
গত ১৪ জুলাই প্রকল্প যাচাই কমিটির এক সভায় রেলওয়ের পক্ষ থেকে ‘২০টি মিটারগেজ ডিজেল ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ সংগ্রহ’ শীর্ষক প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়। সভায় অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বাদ দিয়ে রেলওয়ে মাস্টার প্ল্যান, এসডিজি, জাতীয় পরিবহন পরিকল্পনা এবং আইআইএফসির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের তথ্য যুক্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। পাশাপাশি খুচরা যন্ত্রাংশ, রক্ষণাবেক্ষণ এবং অন্তত ১০ বছর পর সার্ভিস ব্যবস্থার বিষয়টিও প্রস্তাবে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করার কথা বলা হয়।
রেল সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম বলেন, ‘চীন অনুদান দেবে কি না, লিখিতভাবে জানায়নি, তবে মৌখিকভাবে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। ইঞ্জিন আনার বিষয়টি কনক্রিট হয়নি।’
রেলওয়ের যন্ত্রপ্রকৌশল বিভাগের তথ্যে জানা যায়, পুরোপুরি অনুদান হিসেবে লোকোমোটিভ চাওয়া হয়েছে, এমনকি কাস্টমস ও ভ্যাটের খরচও চীনকে বহন করতে বলা হয়েছে। রেল কর্মকর্তাদের দাবি, লোকোমোটিভের তীব্র সংকট মোকাবিলায় অন্য কোনো বিকল্প নেই।
বর্তমানে রেলের বহরে ৩০৬টি লোকোমোটিভ আছে—এর মধ্যে ১৭৪টি মিটারগেজ এবং ১৩২টি ব্রডগেজ। কিন্তু মিটারগেজ লোকোমোটিভের ৭১ শতাংশই ২০ বছরের বেশি পুরোনো, এর মধ্যে ৬৮টি ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে। এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়বহুল ও যন্ত্রাংশ দুর্লভ হয়ে পড়েছে।
রেলের মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী, ধাপে ধাপে মিটারগেজ লাইনকে ডুয়েলগেজে রূপান্তরের পরিকল্পনা থাকলেও বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা দেখা দিয়েছে। ফলে অনুমান করা হচ্ছে, অন্তত ২০৫৫ থেকে ২০৬০ সাল পর্যন্ত মিটারগেজ ট্রেন চালু রাখতে হবে। সে কারণে নতুন মিটারগেজ লোকোমোটিভ আনা জরুরি হয়ে পড়েছে।
তবে চীনা লোকোমোটিভ নিয়ে আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘অনুদান আনা বড় বিষয় নয়, এগুলো ব্যবহারযোগ্য হবে কি না, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। চালাতে সমস্যা হলে বা যন্ত্রাংশ না পাওয়া গেলে এগুলো বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। ডেমু কেনায় যেমন অর্থ অপচয় হয়েছে, তেমন অভিজ্ঞতা যেন আবার না হয়।’
রেল সচিবও স্বীকার করেছেন, ‘বাংলাদেশে চীনা লোকোমোটিভ ব্যবহারের অভিজ্ঞতা নেই। তাই নতুন লোকোমোটিভ আনা হলে সার্ভিস ওয়ারেন্টি, রিপেয়ারিং প্লান্ট বা অন্তত পাঁচ বছরের সার্ভিস গ্যারান্টি নিশ্চিত করতে হবে।’
তবে এ প্রক্রিয়ায় নীতিগত অনুমোদন নিয়ে প্রশ্ন আছে। গাইডলাইন অনুযায়ী, বৈদেশিক অর্থায়নের জন্য প্রাথমিক প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদন নিতে হয়। চীনা লোকোমোটিভ প্রকল্পের ক্ষেত্রে তা অনুসরণ হয়নি বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। ফলে প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন রয়ে গেছে।
মন্তব্য করুন