বৈশ্বিক মানদণ্ডে বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধায় অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষক সমাজ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা। সরকারি শিক্ষকদের তুলনায় দীর্ঘদিন ধরে তারা বৈষম্যের শিকার। ২০১৫ সালের অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেলের পর সেই বৈষম্য আরও প্রকট হয়ে ওঠে। এরপর শিক্ষকরা চার দফায় আন্দোলনে নামলেও প্রতিবারই রাজনৈতিক রং লাগার কারণে দাবিগুলো পূরণ হয়নি।
তবে টানা দেড় দশকের লড়াইয়ের পর প্রথমবারের মতো আংশিক সাফল্যের মুখ দেখেছেন তারা। তাদের ভাষ্য, এটি শুধু বেতন-ভাতার সাফল্য নয়, বরং শিক্ষক মর্যাদা পুনরুদ্ধারের প্রাথমিক বিজয়। তাদের পরবর্তী লক্ষ্য জাতীয়করণের আন্দোলন।
শিক্ষক নেতাদের মতে, আগের সব আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ ছিল সরকারপন্থি শিক্ষকদের বিরোধিতা। কখনো ভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছাপ লাগিয়ে আন্দোলন ভিন্ন খাতে নেওয়া হয়। এবারও একটি রাজনৈতিক দলের শিক্ষক সংগঠন বিরোধিতা করলেও আন্দোলনে রাজনৈতিক রং লাগেনি, ফলে সাফল্য এসেছে।
তারা জানান, আন্দোলনের শুরু থেকেই জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, ডাকসুর সাবেক ভিপি, ছাত্রশিবিরসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল একাত্মতা প্রকাশ করে। শেষদিকে বিএনপির প্রকাশ্য সমর্থনে সরকার চাপের মুখে পড়ে এবং শিক্ষকদের বাড়ি ভাড়া ভাতা দুই ধাপে ১৫ শতাংশে উন্নীত করে।
শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শিক্ষা জাতীয়করণের জন্য প্রথম বড় আন্দোলন শুরু হয় ২০১৩ সালে। তখন শিক্ষকরা ঢাকায় টানা অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। তবে সরকার পতনের আন্দোলন হিসেবে প্রচার করে পুলিশ লাঠিচার্জ করে আন্দোলনটি ছত্রভঙ্গ করে দেয়। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে টানা ১১ দিন অবস্থান ধর্মঘট চালিয়েও একই পরিণতি হয়।
২০২৩ সালের জুলাইয়ে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় এবং দীর্ঘস্থায়ী শিক্ষক আন্দোলন হয়। বাংলাদেশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ) ও অন্যান্য সংগঠনের আয়োজনে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে টানা ১৭ দিন চলা এই আন্দোলনের সময় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি নানা মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ করেন। একপর্যায়ে শিক্ষক নেতা কাওসার আলীকে একটি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা তুলে নিয়ে যান। পরে শিক্ষক সমাজের চাপে তাকে ফেরত দেওয়া হলেও, পরবর্তী সময়ে তার এমপিও স্থগিত করা হয় এবং তাকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
এ প্রসঙ্গে কাওসার আলী বলেন, ‘আমাদের সেই আন্দোলনেরই ফসল এবার পেয়েছেন শিক্ষকরা। তখন আমাকে যে পরিমাণ হয়রানি করা হয়েছে, তা বলে শেষ করা যাবে না। সরকারের চেয়ে বেশি দোষী ছিলেন সরকারপন্থি শিক্ষকরা। তাদের বিরোধিতার কারণেই আগের বড় বড় আন্দোলন সফল হয়নি।’
চলমান আন্দোলনে ১১ দিন কর্মসূচি পালনের পর সরকার বাড়ি ভাড়া ভাতা ১৫ শতাংশে উন্নীত করার ঘোষণা দেয়। আন্দোলনের শুরু থেকেই একটি বড় রাজনৈতিক দলের শিক্ষক সংগঠন এর বিরোধিতা করে। তারা আন্দোলনকারীদের আওয়ামী লীগ ও জামায়াতপন্থি হিসেবে আখ্যা দেয়। ১৬ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে সেলিম ভূঁইয়া বলেন, ‘রাজপথে যারা কর্মসূচি পালন করছেন তারা শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছেন। তাদের নেতা একজন আওয়ামী দোসর, তার প্রমাণ রয়েছে।’ তিনি আরও দাবি করেন, ‘আন্দোলনকারীরা আওয়ামী লীগের কাছ থেকে টাকা নিয়ে মাঠে নেমেছে।’
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মো. সেলিম ভূঁইয়া কালবেলাকে বলেন, ‘আমি আন্দোলনের বিরোধিতা করিনি। আমরা বলেছি, ১৫ শতাংশ নয়, আমরা জাতীয়করণের পক্ষে। যারা খুচরা দাবি নিয়ে আন্দোলন করছেন তারা আওয়ামী লীগ-জামায়াতের হয়ে মাঠে নেমেছেন।’ তবে তার এমন বক্তব্যের পর অধ্যক্ষ দেলোয়ার হোসেন আজিজী তাকে দল থেকে অব্যাহতির দাবি জানান।
আন্দোলনের সার্বিক দিক নিয়ে দেলোয়ার হোসেন আজিজী বলেন, ‘সরকার এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন আমাদের পাশে ছিল, তাই আমরা সফল হয়েছি। বিএনপিপন্থি শিক্ষক সংগঠনগুলোর বিরোধিতা দুঃখজনক। অতীতেও তাদের বিরোধিতার কারণে অনেক আন্দোলন সফলতার দ্বারপ্রান্তে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছে।’
টানা আন্দোলনের মুখে সরকার বাড়ি ভাড়া ভাতা ১৫ শতাংশে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে সুবিধাটি দুই ধাপে কার্যকর হবে। শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক সি আর আবরার ও আন্দোলনরত শিক্ষক নেতাদের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকের পর অর্থ মন্ত্রণালয় ছয় শর্তে সম্মতিপত্র জারি করে।
সম্মতিপত্র অনুযায়ী, আগামী ১ নভেম্বর থেকে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা মূল বেতনের ৭.৫ শতাংশ (ন্যূনতম ২ হাজার টাকা) হারে বাড়ি ভাড়া পাবেন। দ্বিতীয় ধাপে ১ জুলাই ২০২৬ থেকে আরও ৭.৫ শতাংশ বাড়িয়ে মোট ১৫ শতাংশ করা হবে। সরকারের এমন ঘোষণায় শিক্ষকরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন এবং আন্দোলন স্থগিত করে শ্রেণিকক্ষে ফেরার ঘোষণা দেন শিক্ষক নেতা দেলোয়ার হোসেন আজিজী।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস শিক্ষকদের শ্রেণিকক্ষে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘তাদের দাবি যৌক্তিক হলেও দেশের অর্থনীতি এখনই ২০ শতাংশ ভাড়া ভাতা দেওয়ার অবস্থায় নেই। তাই সরকার বাস্তবতার নিরিখে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ তিনি সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টাদের ধন্যবাদ জানান এবং আশা প্রকাশ করেন, শিক্ষকরা নবউদ্যমে শিক্ষাদানে ফিরে যাবেন।
শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক সি আর আবরার এক বিবৃতিতে বলেন, ‘এটি শিক্ষা খাতের জন্য ঐতিহাসিক অর্জন। শিক্ষকরা তাদের ন্যায্য পাওনা পেয়েছেন। আমরা জানি, তারা আরও বেশি পাওয়ার যোগ্য।’ তিনি জানান, প্রধান উপদেষ্টা ও অন্য উপদেষ্টাদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতেই এই সিদ্ধান্ত হয়েছে।
মন্তব্য করুন