

প্রকৃতির ঝাড়ুদার হিসেবে খ্যাত শকুন আজ সময়ের বিবর্তনে বিলুপ্তির পথে। এক সময় গ্রাম ও শহরের বিভিন্ন জায়গায় শকুনের অবাধ বিচরণ ছিল। মৃত প্রাণীর দেহাবশেষ বক্ষণ করে পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখতে শকুনের ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। সুন্দরবন ছাড়াও হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার রেমা-কালেঙ্গায় রয়েছে কিছু শকুন। এখানে শকুন রক্ষায় কাজ করছে বন বিভাগ ও আন্তর্জাতিক জোট সংস্থা আইইউসিএন।
চুনারুঘাট উপজেলার গাজীপুর ইউনিয়নে অবস্থিত রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্য। এটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত। ১৯৮২ সালে প্রায় ১৭৯৫ হেক্টর আয়তনের এ বনভূমি রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। রেমা, কালেঙ্গা ও ছনবাড়ীর বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিয়ে রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্য বিস্তৃত। এই অভয়ারণ্য়ে প্রায় ৬৩৮ প্রজাতির বৃক্ষরাজি, প্রায় ৬২ স্তন্যপায়ী, উভচর ও সরীসৃপ প্রাণী এবং প্রায় ১৬৭ প্রজাতির পাখি ও শকুনের আবাস।
রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য বাংলাদেশের শকুনের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল। যেখানে তাদের প্রজনন ও বিশ্রামের ব্যবস্থা আছে। শকুনের সংখ্যা বাড়াতে এবং তাদের সুরক্ষিত রাখতে নিরলসভাবে কাজ করছে আন্তর্জাতিক এনজিও আইইউসিএন। তাদের মতে, এখানে অন্তত ৫০টি শকুন রয়েছে। এই বন ছাড়া দেশে বেশিরভাগ শকুন টিকে আছে সুন্দরবন অঞ্চলে।
বিভিন্ন কারণে মূল্যবান প্রাণী শকুন আজ বিলুপ্তির পথে। এর মধ্যে রয়েছে গবাদি পশু চিকিৎসায় ব্যবহৃত ‘ডাইক্লোফেনাক’ ওষুধ। এটি শকুনের জন্য মারাত্মক বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে, যা তাদের কিডনি বিকল করে মৃত্যুর কারণ হয়। খাদ্যের উৎসের অভাব ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন শকুনের সংখ্যা কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। এ ছাড়া শকুনের বিভিন্ন রোগ, বাসস্থান ধ্বংস এবং মানুষের আগ্রাসন শকুনের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শকুনের নিরাপদ খাবারের জন্য বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের উদ্যোগে রেমা-কালেঙ্গার ময়না বিলে ‘বিশেষ রেস্তোরাঁ’ স্থাপন করা হয়েছে। এই রেস্তোরাঁ বা ফিডিং স্টেশনে খাবার হিসেবে সপ্তাহপ্রতি একটা করে গরু জবাই করে দেওয়া হয়। গরুর মাংস শকুনরা খেয়ে আবার চলে যায় তাদের অন্য গন্তব্যে। শকুন সংরক্ষণের উদ্দেশ্য প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএন ও বন অধিদপ্তরের উদ্যোগে এই রেস্তোরাঁ চালু করা হয় ২০১৪ সালে। মূলত প্রজননকালে সাত মাস খাবার দেওয়া হয় এই রেস্তোরাঁয়। একটি আস্ত গরুকে সাত দিন কোয়ারেনটাইনে রেখে জবাই করে শকুনকে খেতে দেওয়া হয়। যেসব শকুন বাসা বানায় ও ডিমে তা দেয়, তারা সহজেই নিরাপদ খাবার পায়।
এই বনে শকুনের রেস্তোরাঁর পাশাপাশি একটি শকুনের মনিটরিং সেন্টারও আছে। সেই ঘরের ভেতর থেকে ছোট্ট একটি ফুটো দিয়ে শকুনের রেস্তোরাঁটির সবকিছু দেখা যায়। সেখান থেকে মনিটরিং করা হয় শকুনের খাবারের পুরো সময়।
শকুন প্রায় বিলুপ্ত হওয়ার কারণে মৃত প্রাণীর দেহাবশেষ সহজে পচে না, যা অ্যানথ্রাক্স, যক্ষ্মা এবং জলাতঙ্কের মতো রোগের বিস্তার ঘটাতে পারে। প্রকৃতির পরিচ্ছন্নতাকর্মী শকুন মৃত প্রাণীর দেহাবশেষ খেয়ে পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখে এবং রোগজীবাণুর বিস্তার রোধ করে। শকুন বিলুপ্তির ফলে দিনকে দিন পরিবেশের স্বাভাবিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। শকুনের বংশবিস্তারে উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
রেমা-কালেঙ্গায় বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে রয়েছে বিরল প্রজাতির মালায়ন বড় কাঠবিড়ালি, কুলু, রেসাস ও লজ্জাবতী বানর, মায়া হরিণ, মুখপোড়া হনুমান, উল্লুক, চশমা হনুমান, মেছোবাঘ, গন্ধগোকুল, বন্যশূকর, সজারু, বেজি, সাপ, হিল ময়না, মথুরা, ভীমরাজ, লাল মাথা কুচকুচি, টিয়া, সিপাহি বুলবুল, চিল, বসন্তবৌরি, শকুন, বনমোরগ, পেঁচা, ঈগল ও মাছরাঙা অন্যতম।
রেমায় আইইউসিএনের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রোগ্রাম অ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসার সুলতান আহমেদ জানান, অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত শকুনের প্রজনন সময়ে গরু জবাই করে তাদের নিরাপদ খাবার দেওয়া হয়। এরই সঙ্গে মনিটরিং করাও হয়। তিনি আরও বলেন, চব্বিশের অক্টোবর থেকে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত আমাদের পক্ষ থেকে গরু দেওয়া হয়েছে। পরে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত নিরাপদ এই খাবার দিয়েছে বন বিভাগ।
বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. আবুল কালাম জানান, প্রকৃতির ঝাড়ুদার হিসেবে পরিচিত শকুন সংরক্ষণে বন বিভিন্ন কাজ করে যাচ্ছে। কেউ যাতে শকুন না মারতে পারে সেদিকে তাদের নজর রয়েছে। এ ছাড়া তাদের নিরাপদ খাদ্য প্রদানে বন বিভাগ উদ্যোগ নিয়েছে।
মন্তব্য করুন