

বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা প্রদান করার উদ্দেশ্যে সারা দেশে বিশেষায়িত বাণিজ্যিক আদালত স্থাপন করতে যাচ্ছে সরকার। ব্যবসা-বাণিজ্যে গতিশীলতা আনতে বাণিজ্যিক বিরোধগুলো দ্রুত ও কার্যকরভাবে নিষ্পত্তির বিধান থাকছে এই অধ্যাদেশে। অধ্যাদেশের অধীনে উদ্ভূত যে কোনো বাণিজ্যিক বিরোধ মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তিতে জোর দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া কোনো মামলার চূড়ান্ত শুনানি শুরু হওয়ার পর থেকে ৯০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তির বিধান রাখা হয়েছে। কোনো পক্ষের ইচ্ছাকৃত কর্ম, কর্মবিরতি বা গাফিলতির কারণে এই নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে কোনো মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব না হলে বাণিজ্যিক আদালতকে সংশ্লিষ্ট পক্ষের ওপর উপযুক্ত পরিমাণ খরচ আরোপ করতে পারবেন মর্মে বিধান রাখা হয়েছে। এ ছাড়া আরোপিত ওই খরচ পরিশোধ না করা পর্যন্ত সেই পক্ষ মামলার বিচারিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারবে না বলেও বিধান রাখা হয়েছে।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আজ বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অধ্যাদেশটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য উত্থাপন করা হচ্ছে। এর আগে আন্তঃমন্ত্রণালয় সংক্রান্ত যাচাই-বাছাই কমিটি অধ্যাদেশটির খসড়া চূড়ান্ত করে।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর সারা দেশে বিশেষায়িত বাণিজ্যিক আদালত প্রতিষ্ঠাসংক্রান্ত একটি প্রস্তাব সুপ্রিম কোর্ট থেকে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের তত্ত্বাবধানে এই অধ্যাদেশের একটি খসড়া প্রস্তুত করেও পাঠানো হয়। আইন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানোর আগে অংশীজনের মতামত নেওয়া হয় ওই খসড়ার ওপর। সুপ্রিম কোর্টের প্রস্তাবে, ব্যবসায়ী, ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বণিকদের সাধারণ লেনদেন থেকে শুরু করে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম, বিমান ও নৌপরিবহন, নির্মাণ ও অবকাঠামোগত প্রকল্প, ফ্র্যাঞ্চাইজ চুক্তি, বিতরণ ও লাইসেন্সিং, প্রযুক্তি উন্নয়ন, ট্রেডমার্ক, কপিরাইট, পেটেন্ট, শিল্প নকশা, ডোমেইন নাম, ভৌগোলিক নির্দেশক, বীমা এবং অংশীদারত্ব চুক্তি, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, পরিষেবা খাত এবং শেয়ারহোল্ডার বা যৌথ উদ্যোগ-সম্পর্কিত বিরোধকে বিশেষায়িত বাণিজ্যিক আদালতের এখতিয়ারভুক্ত করার কথা বলা হয়। সুপ্রিম কোর্টের ওই খসড়া প্রস্তাবের আলোকে মন্ত্রণালয় থেকে বাণিজ্যিক আদালত অধ্যাদেশ-২০২৫-এর খসড়া চূড়ান্ত করা হয়।
চূড়ান্ত খসড়ায় বলা হয়েছে, বাণিজ্যিক আদালত, বাণিজ্যিক বিরোধ সংক্রান্ত মোকদ্দমার বিচারকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে দেওয়ানি কার্যবিধি-এর বিধানাবলি অনুসরণ করবে।) এই অধ্যাদেশের অধীন আনীত কোনো মোকদ্দমায় চূড়ান্ত শুনানির পূর্বে যে কোনো পক্ষ উপযুক্ত কারণ প্রদর্শনপূর্বক সর্বোচ্চ তিনবার সময় আবেদন করতে পারবে এবং বাণিজ্যিক আদালত সন্তুষ্ট হলে যুক্তিসংগত খরচ নির্ধারণ করে ওই আবেদন মঞ্জুর করতে পারবে। যে তারিখে মামলাটিকে চূড়ান্ত শুনানির জন্য নির্ধারণ করবে, সেই তারিখ থেকে পরবর্তী ৯০ (নব্বই) দিনের মধ্যে, কোনো প্রকার ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে, চূড়ান্ত শুনানি সম্পন্ন করতে হবে।
যেক্ষেত্রে বাণিজ্যিক আদালত মনে করে, উভয়পক্ষের দাখিলি এফিডেভিটকৃত বক্তব্য, দালিলিক প্রমাণ ও শুনানির ওপর ভিত্তি করে কোনো মোকদ্দমার রায় প্রদান সম্ভব, সেক্ষেত্রে বাণিজ্যিক আদালত মৌখিক সাক্ষ্য গ্রহণ ব্যতিরেকেই রায় প্রদান করতে পারবে।
চূড়ান্ত খসড়ায় বলা হয়েছে, বাণিজ্যিক আদালতের রায়ে কোনো পক্ষ সংক্ষুব্ধ হলে সেই রায় প্রদানের ৬০ দিনের মধ্যে হাইকোর্ট বিভাগে আপিল আবেদন দায়ের করতে পারবেন। এসব রায় বা আদেশের বিরুদ্ধে আপিল ও রিভিশন শুনানির জন্য প্রধান বিচারপতি হাইকোর্ট বিভাগে এক বা একাধিক বাণিজ্যিক আপিল বেঞ্চ গঠন করবেন। বাণিজ্যিক আদালতের বিচারক হবেন জেলা জজ বা অতিরিক্ত জেলা জজ। এ ছাড়া এ ধরনের আদালতের সীমানা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে নির্ধারণ করবেন।
মধ্যস্থতা সম্পর্কিত বিশেষ বিধান রাখা হয়েছে এই অধ্যাদেশে। এতে বলা হয়েছে, এই অধ্যাদেশের অধীন কোনো মোকদ্দমায় কোনো জরুরি অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিকার জড়িত না থাকলে, মামলা দায়েরের পূর্বে বাদীকে সরকার কর্তৃক প্রণীত বিধি অনুসরণ করে মামলা দায়েরের পূর্বেই মধ্যস্থতা পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। মামলা দায়েরের পর রায়ের পূর্বে যে কোনো পর্যায়ে, উভয়পক্ষ সম্মত হলে বাণিজ্যিক আদালত মধ্যস্থতার মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তির অনুমতি প্রদান করতে পারবে এবং এরূপ ক্ষেত্রে প্যানেল মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে কিংবা পক্ষগণের সম্মতি ও আদালতের অনুমতিক্রমে অন্য যে কোনো উপযুক্ত মধ্যস্থতাকারী নিয়োগ করে বিরোধ নিষ্পত্তি করা যাবে। তবে শর্ত থাকে যে, মধ্যস্থতা কার্যক্রম ৩০ (ত্রিশ) দিনের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মধ্যস্থতা কার্যক্রম সম্পন্ন করা সম্ভব না হলে বিষয়টি আদালতে উপস্থাপিত হবে এবং এক্ষেত্রে বাণিজ্যিক আদালত উপযুক্ত মনে করলে মধ্যস্থতার জন্য অতিরিক্ত ৩০ (ত্রিশ) দিন সময় বর্ধিত করতে পারবেন। পক্ষগণ মধ্যস্থতার মাধ্যমে কোনো সমঝোতায় উপনীত হলে, সেক্ষেত্রে তা লিখিত চুক্তি আকারে প্রণীত হবে এবং বিরোধের সকল পক্ষ এবং মধ্যস্থতাকারী এতে স্বাক্ষর করবেন। স্বাক্ষরিত ওই চুক্তিনামা এখতিয়ারসম্পন্ন আদালতে উপস্থাপিত হবে এবং ওই আপসনামা দ্বারা তৃতীয় পক্ষের কোনোরূপ স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয় নাই মর্মে বাণিজ্যিক আদালত সন্তুষ্ট হলে ওই আপসানামা একটি ডিক্রি হিসাবে গণ্য হবে ও বাণিজ্যিক আদালত কর্তৃক কার্যকর করা যাবে।
অধ্যাদেশে এ ধরনের বিরোধের সংক্ষিপ্ত বিচারের বিধান রাখা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এই অধ্যাদেশের অধীন বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে বিবাদীর প্রতি সমন জারি করার পর মোকদ্দমার যে কোনো পক্ষ, ইস্যু গঠন করে সংক্ষিপ্ত বিচারের মাধ্যমে রায় প্রদানের জন্য বাণিজ্যিক আদালতের কাছে আবেদন করতে পারবে। বাণিজ্যিক আদালত, উক্ত আবেদন গ্রহণযোগ্য মনে করলে আবেদন দাখিলের তারিখ হতে ১৫ দিনের মধ্যে শুনানির জন্য তারিখ নির্ধারণ করবে। শুনানি সম্পন্ন হওয়ার পর যদি আদালতের নিকট প্রতীয়মান হয় যে, মোকদ্দমায় বাদীর প্রতিকার প্রাপ্তির কিংবা বিবাদীর নিজ দাবি প্রমাণের কোনোরূপ সম্ভাবনা নেই; এবং বিরোধ নিষ্পত্তিতে কোনো মৌখিক সাক্ষ্য গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা নেই; তাহলে বাণিজ্যিক আদালত উভয়পক্ষের লিখিত আরজি-জবাব, দাখিলি দালিলিক প্রমাণ বিবেচনা করে রায় প্রদান করতে পারবে।
মন্তব্য করুন