পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে পাইপলাইনে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির জন্য আগামী সেপ্টেম্বরে দরদাম নিয়ে আলোচনা শুরু করবে পেট্রোবাংলা। ভারতের বেসরকারি খাতের কোম্পানি এইচ এনার্জির সঙ্গে এলএনজি আমদানি চুক্তির শর্তাবলি নিয়ে আলোচনা চলছে। আগামী আগস্ট মাসের মধ্যে চুক্তির শর্তাবলি চূড়ান্ত করা হবে। তারপর শুরু হবে মূল্য নির্ধারণের আলোচনা পর্ব। সবকিছু ঠিক থাকলে চলতি বছরের শেষে চুক্তি স্বাক্ষর হবে।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার কালবেলাকে বলেন, এইচ এনার্জির সঙ্গে আমাদের আলোচনা চলছে। এখন টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন নিয়ে আলোচনা করছি। আশা করছি আগামী মাসের মধ্যে এ আলোচনা শেষ করতে পারব। তারপর ফিন্যান্সিয়াল নেগোশিয়েশন শুরু হবে। সব ঠিক থাকলে এ বছরেই চুক্তি করা সম্ভব হবে। তিনি জানান, পাইপলাইনের মাধ্যমে এলএনজি এলে এটা আমাদের জন্য সাশ্রয়ী হবে।
পেট্রোবাংলার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে এইচ এনার্জির সঙ্গে এলএনজি আমদানি করতে চুক্তির শর্তাবলি কী কী থাকবে, তা নিয়ে আলোচনা চলছে। এর আগে এ বিষয়টি নিয়ে গত ১০ মে পেট্রোবাংলার প্রস্তাব প্রক্রিয়াকরণ কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় নেগোশিয়েশনের জন্য বেশকিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরে গত মাসের শেষে এইচ এনার্জির প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক সভায় সিদ্ধান্তগুলো প্রস্তাব আকারে উত্থাপন করা হয়েছে। এগুলো নিয়ে এখন দ্বিপক্ষীয় আলোচনা চলছে। এর মধ্যে রয়েছে বার্ষিক ১ মিলিয়ন টন এলএনজি সরবরাহ করা; বাংলাদেশ অংশে পাইপলাইন নির্মাণে এইচ এনার্জি প্রয়োজনীয় ভূমি পেট্রোবাংলার নামে অধিগ্রহণ সম্পন্ন করা এবং এইচ এনার্জির অর্থায়নে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডের (জিটিসিএল) মাধ্যমে বাংলাদেশ অংশের ভূমি অধিগ্রহণ ও গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণ করা; ভূমি অধিগ্রহণ ও পাইপলাইন নির্মাণে বিলম্বের কারণে পেট্রোবাংলা কোন লিক্যুইটি ড্যামেজ (এলডি) বা জরিমানা (পেনাল্টি) প্রদান না করার বিষয়টি খসড়া গ্যাস সেলস অ্যাগ্রিমেন্টে (জিএসএ) অন্তর্ভুক্ত করা; গ্যাসের মূল্য ও ক্যাপাসিটি চার্জ আলাদাভাবে বিবেচনা করা; ক্রেতার সমস্যা ছাড়া অন্য কোনো গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকলে ক্যাপাসিটি চার্জ প্রদান না করার বিষয়টি গ্যাস সেলস অ্যাগ্রিমেন্টে অন্তর্ভুক্ত করা উল্লেখযোগ্য।
জানা গেছে, এইচ এনার্জি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলি নদীর তীরে কুকরাহাটিতে স্থাপিতব্য ‘স্মল স্কেল এলএনজি স্টোরেজ অ্যান্ড রি-গ্যাস’ থেকে ক্রস বর্ডার পাইপলাইনের মাধ্যমে ভারতের পানিতার ও বাংলাদেশের সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে এলএনজি সরবরাহের বিষয়ে ২০১৬ সালের ৮ জুন প্রস্তাব করে। প্রস্তাব দেওয়ার পাঁচ বছর পর ২০২১ সালের ১৬ জুন এইচ এনার্জির সঙ্গে এক সমঝোতা স্মারক সই করেছে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশন-পেট্রোবাংলা। পরে একই বছরের ৯ ডিসেম্বর প্রস্তাবটি ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) (সংশোধিত) আইন, ২০২১’-এর আওতায় প্রক্রিয়াকরণের জন্য সরকার নীতিগত অনুমোদন দেয়।
এদিকে, ভারতে থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে এলএনজি আমদানি করতে বাংলাদেশের অংশে এখনো কোনো কাজ শুরু হয়নি। তবে ভারতীয় অংশের কাজ অনেকখানি এগিয়ে গেছে। ভারতের হিরানন্দানি গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান এইচ এনার্জি বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এলএনজি সরবরাহ করবে। কুকরাহাটিতে টার্মিনাল এলএনজি নিমার্ণ করছে। সেখান থেকে গ্যাস সরবরাহের জন্য দীর্ঘ ২৫০ কিলোমিটার পাইপলাইনও নির্মাণ করা হচ্ছে।
ভারতের পেট্রোলিয়াম অ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস রেগুলেটরি বোর্ডের (পিএনজিআরবি) অনুমোদন নিয়ে এইচ এনার্জি পশ্চিববঙ্গে তাদের এলএনজি টার্মিনালকে যুক্ত করে কানাই চাট্টা থেকে শ্রীরামপুর পর্যন্ত প্রাকৃতিক গ্যাস সঞ্চালন লাইন বসাবে এবং পরিচালনা করবে। এই লাইন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের পাশাপাশি বাংলাদেশ সীমান্তকেও যুক্ত করবে। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের হলদিয়া থেকে বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত নির্মাণ করা হচ্ছে ১৫০ কিলোমিটার পাইপলাইন। সেখান থেকে সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশের খুলনায় এ গ্যাস সরবরাহ করা হবে।
পেট্রোবাংলার পরিকল্পনা অনুযায়ী, সাতক্ষীরা থেকে খুলনা পর্যন্ত ৬০ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণ করবে রাষ্ট্রায়ত্ত গ্যাস সঞ্চালন প্রতিষ্ঠান গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল)। এ পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার কোটি টাকা। জিটিসিএলের তথ্য বলছে, সাতক্ষীরা-খুলনা গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণে প্রকল্পে রুট জরিপ কাজ শেষ হয়েছে। ভারতের সঙ্গে জিআইএ সই হওয়া সাপেক্ষে প্রকল্পের কাজ শুরু করা হবে। এ প্রকল্পে বিদেশি সহায়তার জন্য প্রস্তাবিত প্রকল্পের সংশোধিত পিডিপিপি ২০২১ সালের ২৪ জুন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের নীতিগত অনুমোদন পেয়েছে।
পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে মোট গ্যাসের (দেশে উৎপাদিত ও আমদানি করা এলএনজি মিলিয়ে) সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার হয়। এ ছাড়া শিল্পে ১৯ শতাংশ, শিল্প-কারখানা ক্যাপটিভ পাওয়ারে ১৭ শতাংশ, গৃহস্থালিতে ১৩ শতাংশ, সার কারখানায় ৬ শতাংশ, সিএনজি ৪ শতাংশ, বাণিজ্যিক এক শতাংশ এবং চা বাগানে শূন্য দশমিক ১০ শতাংশ।
মন্তব্য করুন