রোগীর পরম নির্ভরতার নাম চিকিৎসক। চিকিৎসকের আন্তরিকতা ও সঠিক চিকিৎসায় ভরসা খোঁজেন রোগী। তবে একশ্রেণির চিকিৎসক নিয়মিত দায়িত্বের চেয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আত্মপ্রচারে সরব। এতে প্রলুব্ধ হয়ে কুমিল্লার আঁখি-সুমন দম্পতির মতো অনেকেই প্রচারমুখী চিকিৎসকের শরণাপন্ন হচ্ছেন। ফলে সক্ষমতার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি রোগীকে আকর্ষণ করতে গিয়ে অহরহ ভুল চিকিৎসার বিতর্ক তৈরি হচ্ছে। একই সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ার সুনামকে কেন্দ্র করে নিজের নামে রোগী ভর্তি করে অন্যদের দ্বারা চিকিৎসারও অভিযোগ উঠছে। প্রতারিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ রোগী ও তার স্বজনদের।
সম্প্রতি রাজধানীর সেন্ট্রাল হসপিটালে নবজাতক ও মায়ের মৃত্যুর ঘটনায় এসব চিত্র উঠে এসেছে। হাসপাতালের গাইনি চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. সংযুক্তা সাহার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি সব সময় নিশ্চয়তাসহ সোশ্যাল মিডিয়ায় স্বাভাবিক প্রসব বিষয়ে প্রচার চালাতেন। এতে প্রলুব্ধ হয়ে অনেকে এ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতেন। রোগীর চাপ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এ চিকিৎসকও তার অর্থলিপ্সা বাড়াতে থাকেন। নিজের অনুপস্থিতিতে তার নামে রোগী ভর্তির নির্দেশ দেন। কুমিল্লার প্রসূতি মাহবুবা রহমান আঁখির আগেও তার ভুল চিকিৎসায় বেশ কয়েকজনের মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে। তবে ক্ষমতার দাপট আর অনৈতিক প্রচারণায় এসব অভিযোগ চাপা পড়ে যায়।
পান্থপথে অবস্থিত বিআরবি হাসপাতালের স্ত্রী ও প্রসূতি রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. কাজী ফয়েজা আক্তারের বিরুদ্ধেও একই ধরনের অভিযোগ আছে। ব্যথামুক্ত স্বাভাবিক সন্তান জন্মদান বিষয়ে সব সময় ফেসবুকে প্রচারণা চালিয়ে বেড়ান তিনি। প্রচারণার অংশ হিসেবে কাজী ফয়েজা আক্তার নিজের নামে একটি ওয়েবসাইটও তৈরি করেন। সেখানে ব্যথামুক্ত নরমাল ডেলিভারি বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য শেয়ার করেছেন। ফয়েজা ডটকমের তথ্যমতে, ডা. ফয়েজা আক্তার এ পর্যন্ত ২৪ হাজার রোগীকে চিকিৎসাসেবা প্রদান করেছেন। তার মধ্যে ২৩ হাজার রোগীই তার সেবায় সন্তুষ্ট। এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৭০০ ডেলিভারি করিয়েছেন।
এর মধ্যে ২ হাজার ৫০০ জন নরমাল এবং ১ হাজার ২০০ জন সিজারিয়ান ডেলিভারি করেছেন। এসব তথ্য দেখে অনেক নারী প্রলুব্ধ হয়ে ছুটে আসেন তার চেম্বারে। অথচ প্রায় ৬ বছর আগে লক্ষ্মীপুরে এ চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে। ডা. কাজী ফয়েজাসহ অভিযুক্ত চারজনকে তখন আটকও করেছিল পুলিশ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর লক্ষ্মীপুরের বেসরকারি শহীদ মোস্তফা কামাল (এসএমকে) হাসপাতালে ফাতেমা আক্তার বুলিকে (৪৫) ভর্তি করা হয়। জরায়ুর টিউমার অপারেশনের সময় ভুল চিকিৎসায় এক দিন পর রোগীর মৃত্যু হয়। ওই ঘটনায় বিএসএমএমইউর তৎকালীন শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. গোলাম মাইন উদ্দিন, গাইনি ও প্রসূতি সার্জন ডা. কাজী ফয়েজা আক্তার, অ্যানেসথেসিয়া ডা. আলমগীর ও ডিউটি ডাক্তার শরীফুল ইসলামসহ চারজনকে আটক করে পুলিশ। নিহত ফাতেমা আক্তার বুলি হাজিরপাড়া ইউনিয়নের দক্ষিণ জয়পুর গ্রামের মনসুর মাস্টারের স্ত্রী। রোগীর স্বজনরা তখন দাবি করেছিলেন, ডাক্তারের অবহেলায় এবং ভুল চিকিৎসার কারণে রোগীর মৃত্যু হয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জেনারেল ও কলোরেক্টাল সার্জন ডা. মো. নাজমুল হক মাসুম। এ চিকিৎসকের বিরুদ্ধেও চিকিৎসা বিষয়ে আত্মপ্রচারের অভিযোগ করেছেন একাধিক রোগীর স্বজন। শুধু সংযুক্তা সাহা, ফয়েজা কিংবা নাজমুল হক মাসুম নন। দেশের চিকিৎসা খাতে একটি শ্রেণি গড়ে ওঠেছে, যারা চিকিৎসাসেবার চেয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের প্রচারণায় ব্যস্ত। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা। এদিকে বিএমডিসির আইনে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো ধারা নেই। তবে এ ধরনের আত্মপ্রচারকে নৈতিকতার প্রশ্নে নিরুৎসাহিত করেছে। তবু থেমে নেই এ প্রচারণা।
জনস্বাস্থ্য সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ডা. ফয়জুল হাকিম কালবেলাকে বলেন, বিজ্ঞাপন প্রচার করে রোগীকে আকর্ষণ করা ইথিক্যাল না। যারা স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করছেন, তাদের এসব কাজে জড়িয়ে পড়া ঠিক নয়। কিন্তু এটা যারা করছেন, তারা তো অন্যায় করছেন নিশ্চয়ই। সরকারের এবং বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) নজরদারি থাকার কথা। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
মন্তব্য করুন