রাজধানীর মহাখালী প্লাজা। মহাখালী থেকে সাতরাস্তামুখী সড়কের ডান পাশে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ সরণিতে অবস্থিত ৫৫ নম্বর হোল্ডিংয়ের এই ৯ তলা ভবনটি ফায়ার সার্ভিসের তালিকায় অতিঝুঁকিপূর্ণ। এর পাশেই রয়েছে ৫৭ নম্বর হোল্ডিংয়ের জেবা টাওয়ার এবং ৬০ নম্বর হোল্ডিংয়ের শাহীন ম্যানশন। এই ভবন দুটিও রয়েছে ফায়ার সার্ভিসের অতিঝুঁকির তালিকায়। এ নিয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই মার্কেটের ব্যবসায়ীদের। ঝুঁকির বিষয়টি তারা পাত্তাই দিচ্ছেন না। এ ছাড়া অধিকাংশ ব্যবসায়ী ঝুঁকির বিষয়টি জানেনই না। উল্টো মার্কেট কর্তৃপক্ষ দোষ দিলেন ফায়ার সার্ভিসকে। তাদের দাবি, ভবনটিতে কোনো সমস্যা না থাকলেও ফায়ার সার্ভিস তাদের না জানিয়েই অতিঝুঁকির তালিকাভুক্ত করেছে।
সরেজমিন মঙ্গলবার মহাখালী প্লাজায় দেখা যায়, ৯ তলা ভবনটির নিচতলায় রয়েছে মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকারসহ বিভিন্ন মোটর গাড়ির পার্টস বিক্রির দোকানপাট। সারাক্ষণই এখানে মানুষের যাতায়াত থাকে। কোনো দোকানেই অগ্নিনির্বাপণের কোনো প্রস্তুতি চোখে পড়েনি। মার্কেটের সামনে বিভিন্ন দোকানের বিক্রয়কর্মীরা ক্রেতাদের ডাকছিলেন। কয়েকজন দোকানদারের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, ফায়ার সার্ভিসের নোটিশের বিষয়ে তারা কিছু জানেন না।
মহাখালী প্লাজার দ্বিতীয়তলায় রয়েছে এস্কোয়ার ইলেকট্রনিকস লিমিটেডের একটি শোরুম। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, অগ্নিনিরাপত্তা বলতে ১ হাজার ৪শ বর্গফুটের একটি অফিসে মাত্র দুট ফায়ার এক্সটিংগুইশার। আর কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। কথা হয় প্রতিষ্ঠানটির শাখা ব্যবস্থাপক মো. সোলায়মানের সঙ্গে। কালবেলাকে তিনি বলেন, ‘এই ভবনটি যে ফায়ার সার্ভিসের তালিকায় অতিঝুঁকিপূর্ণ, সেটি আমরা জানি না।’
দ্বিতীয়তলা থেকে মার্কেটের বাইরে দিয়ে রয়েছে একটিমাত্র সিঁড়ি। এরপর তৃতীয়তলা থেকে পুরো ৯ তলা পর্যন্ত রয়েছে এসএম গ্রুপের একটি গার্মেন্টস। এ গার্মেন্টসে ওঠানামার জন্য বাঁ পাশ দিয়ে দুটি সরু সিঁড়ি রয়েছে। দুটি সিঁড়িই মার্কেটের ভেতরে দিয়ে। এ ছাড়া একটি লিফট রয়েছে। এই মার্কেটের সামনে প্রধান সড়ক আর বাঁ পাশে সরু গলি। বাকি দুই পাশে লাগোয়া আরও কয়েকটি ভবন। গার্মেন্টসে প্রবেশ করতে গিয়ে দারোয়ানের বাধার মুখে পড়তে হয়। সেখানে ঢুকতে না পেরে লিফটের সামনে কথা হয় যতিন্দ্র নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি নিজেকে গার্মেন্টসের হিসাব শাখার লোক হিসেবে পরিচয় দেন। ভেতরে যেতে না দেওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘গার্মেন্টসের ম্যানেজার বা দায়িত্বশীল কেউ এখন নেই। ওপরে যাওয়া যাবে না।’ অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে চলে যান।
সেখানে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলে দেখা যায়, মধ্যবয়সী এক ব্যক্তি তিনটি ফায়ার এক্সটিংগুইশার নিয়ে ওপরে উঠছেন। তার কাছেও জিজ্ঞাসা করলে তিনি কোনো উত্তর দেননি। এরপর অনেক খোঁজাখুঁজির পরে পাওয়া যায় ভবনের সিকিউরিটি ইনচার্জ মো. আলীকে। অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কয়েকটি ফায়ার এক্সটিংগুইশার দেখিয়ে দাবি করেন, তাদের সব ধরনের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে। তাহলে ফায়ার সার্ভিস অধিকঝুঁকিপূর্ণ তালিকাভুক্ত কেন—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘গত ডিসেম্বরে এসে দেখে গেছে। তারা আমাদের কিছু বলেনি। এই ভবনের মালিক অনেক প্রভাবশালী। আমি এখনই তারে বলতেছি। ফায়ার সার্ভিসকে ধরবে।’ ইমার্জেন্সি ফায়ার এক্সিট সিঁড়ি আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বাঁ পাশের সিঁড়ি দেখিয়ে বলেন, এই সিঁড়িই। এ ছাড়া আর কোনো সিঁড়ি নেই।’
এ নিয়ে কথা হয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে। কালবেলাকে তিনি বলেন, ‘ভবন পরিদর্শন করে ত্রুটি পেলেই নোটিশ দেওয়া হয়।’ নোটিশ দেওয়ার পরও কেন বারবার এমন দুর্ঘটনা ঘটছে বা ফায়ার সার্ভিসের আরও কিছু করণীয় আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আসলে আমাদের নিজেদের ম্যাজিস্ট্রেট নেই। আমাদের জেলা প্রশাসককে বলতে হয়। তারপর তারা ম্যাজিস্ট্রেট দিলে অভিযান চালানো হয়। ফায়ার সার্ভিসের মোবাইল কোর্ট খুবই কম হয়। আমাদের ল ইনফোর্সমেন্ট এবং রেগুলেশন করার ক্ষমতা নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘এর (তদারকি) সঙ্গে সিটি করপোরেশন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, রাজউক, তিতাস, পরিবেশ, বিস্ফোরক অধিদপ্তরসহ ১২ থেকে ১৩টি এজেন্সি জড়িত। তাদের প্রত্যেকেরই দায় আছে।’ এত সংস্থা কাজ করার পরও কেন এত দুর্ঘটনা ঘটছে—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আসলে সব এজেন্সিকে নিয়ে একটা টাস্কফোর্স গঠন করা প্রয়োজন। টাস্কফোর্স হলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে। এটা আমার সুপারিশ।’