প্রচণ্ড তাপদাহ বয়ে যাচ্ছে রাজধানীসহ সারা দেশে। ছোট-বড় সবাই গরমে কাবু। শরীরে দেখা দেয় পানিশূন্যতা। এ কারণে হাতের নাগালে থাকা বিভিন্ন অস্বাস্থ্যকর শরবত ও পানি খায় মানুষ। ফলে তারা আক্রান্ত হচ্ছে ডায়রিয়ায়। হাসপাতালে সাধারণ সময়ের তুলনায় এখন ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ রোগী শিশু। ঈদের ছুটি শেষে রাজধানীতে জনসমাগম বাড়লে হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন চিকিৎসকরা।
রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর এলাকা থেকে দেড় বছর বয়সী শিশু রিফাত হোসেনকে নিয়ে রাজধানীর মহাখালীর আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) বা কলেরা হাসপাতালে এসেছেন বাবা রাশেদুল ইসলাম। তার ধারণা, তীব্র গরমের কারণেই তার সন্তান ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। গতকালও আমার বাচ্চা ভালো ছিল। রাতে তাকে সুস্থ নিয়েই ঘুমিয়েছি। রাত ১টার দিকে হঠাৎ বাচ্চার কান্নার আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায়। উঠে দেখি সে কান্না করছে আর বারবার মোচড় দিচ্ছে। এর কিছুক্ষণ পরই শুরু হয় পাতলা পায়খানা। সারারাতই আমাদের এভাবে যায়। এরপর সকালে তাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাই। তিনি ওষুধ লিখে দেন। সেগুলো খাওয়ানোর পরও কোনোভাবে পাতলা পায়খানা কমছিল না। তাই দুপুরের দিকে এই হাসপাতালে আসি।
লালবাগের আরেক বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম। তিনি তার ছোট ভাই রিফাতকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। দুদিন ধরে তার পাতলা পায়খানা হচ্ছে। প্রথমে স্থানীয় ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে খাওয়ানো হয়। কিন্তু তাতে কাজ না হওয়ায় তারা ঢামেকের দ্বারস্থ হন।
আইসিডিডিআর,বি সূত্র জানায়, সাধারণ সময়ে গড়ে সাড়ে ৩০০ রোগী ডায়রিয়া নিয়ে হাসপাতালটিতে আসেন। অথচ গত এক সপ্তাহে গড়ে প্রতিদিন চিকিৎসা নিচ্ছেন সাড়ে পাঁচশর বেশি রোগী। যার বেশিরভাগই শিশু। রোগীর বেশিরভাগই বলছেন গরমের কারণে তারা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলে, বছরে দুই সময় বর্ষার শুরু ও শীতের আগের সময়টায় ডায়রিয়া রোগীর চাপ বাড়ে। বর্তমানে গরমের কারণে ডায়রিয়া আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। তবে এই ডায়রিয়ায় তিন থেকে সাত দিনের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়াই রোগী সুস্থ হয়ে যায়। হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, সেখানে প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ১৫ জন রোগী ভর্তি হচ্ছেন। গত ৭ এপ্রিল ৪৬১ জন, ৮ এপ্রিল ৪৬৯ জন, ৯ এপ্রিল ৪১৪ জন, ১০ এপ্রিল ৪২৯ জন, ১১ এপ্রিল ৪৪৯ জন, ১২ এপ্রিল ৫৯৫ জন, ১৩ এপ্রিল ৫২৫ জন, ১৪ এপ্রিল ৪৩৪ জন, ১৫ এপ্রিল ৪৯১ জন এবং ১৬ এপ্রিল দুপুর ২টা পর্যন্ত ২৬১ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। অর্থাৎ গত ১০ দিনে ৪ হাজার ৫২৮ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন।
ঢাকা শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট, ঢামেক হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, মোহাম্মদপুর ফার্টিলিটি সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত সপ্তাহের শুরু থেকে গরমের কারণে শিশুদের হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে।
ঢামেক হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ডায়রিয়া, জ্বর, টাইফয়েড আর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে শিশুরা। গরম বাড়ার আগে শিশু রোগী আসত ১২০ থেকে ১৫০ জন। এখন সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০০ থেকে ২৫০-এ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ডায়রিয়া পানিবাহিত রোগ। দূষিত পানি পান করার কারণে এই রোগ হয়। সাধারণত দিনে কারও তিন বা তার চেয়ে বেশিবার পাতলা পায়খানা হলে তার ডায়রিয়া হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়। গরম এলেই ডায়রিয়ার সমস্যা মারাত্মক আকার ধারণ করে। বিশেষ করে শিশু-কিশোররা এই রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শহরে টেপের পানি সেপটিক ট্যাঙ্ক বা সুয়ারেজ লাইনের সংস্পর্শে এসে দূষিত হয়। অস্বাস্থ্যকর ও অপরিচ্ছন্ন জীবনযাপন, যেখানে-সেখানে পানির উৎসের কাছে মলত্যাগ, সঠিক উপায়ে হাত না ধোয়া, অপরিচ্ছন্ন উপায়ে খাদ্য সংরক্ষণ এবং ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে দোকান, রেস্তোরাঁ বা বাসায় পচন ধরা ফ্রিজের খাবার খাওয়াও ডায়রিয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। ডায়রিয়া থেকে তাৎক্ষণিক আরোগ্য লাভ হয় না। নিয়ম মেনে খাবার স্যালাইন আর ওষুধ খেলে তা ধীরে ধীরে কমে।
প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ কালবেলাকে বলেন, তীব্র তাপদাহের এই সময়ে মানুষের ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা দেখা দেয়। দুর্বল লাগে, ক্লান্তি ভর করে। রক্তচাপ কমে যায়। মাথা ঘুরায়। অবসাদ ভর করে। এ সময় মানুষ বাইরে বের হলে হাতের নাগালে থাকা বিভিন্ন অস্বাস্থ্যকর শরবত, পানি ও ভাজাপোড়া খাবার খায়। এসব অস্বাস্থ্যকর, ধুলাবালু মেশানো খাবারের কারণে সবচেয়ে বেশি ডায়রিয়া হয়। শিশু ও বৃদ্ধদের মধ্যে এই হার সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া প্রচণ্ড তাপদাহের কারণে হিট স্ট্রোক, টাইফয়েড, নিউমোনিয়া, জ্বর, সর্দি-কাশিতে ভোগে।
প্রতিকারের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, তাপদাহের মধ্যে প্রয়োজন ছাড়া বিকেল ৩টা পর্যন্ত ঘরের বাইরে যাওয়া যাবে না। ঘর থেকে বের হলে অবশ্যই ছাতা ব্যবহার করবেন। খেটে খাওয়া মানুষ রোদের মধ্যে এক নাগাড়ে অনেক্ষণ কাজ করবেন না। এতে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি রয়েছে। পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি পান করবেন। বাইরের শরবত, ভাজাপোড়া খাবার খাবেন না। খাওয়ার আগে ২০ সেকেন্ড ভালোভাবে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। শিশু ও পরিবারের বয়স্কদের রোদ থেকে নিরাপদে রাখতে হবে। এর পরও কেউ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলে বিলম্ব না করে নিকটস্থ হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন।