দোতলা বাড়ি। সেটিরই একটি কক্ষে থাকেন এভারেস্টজয়ী বাবর আলী। তার কক্ষে যাওয়ার জন্য সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠার আগে চোখ আটকে গেল দেয়ালে। পর্বতারোহণের ছবি ও অর্ধশতাধিক পদক ঝুলছে দেয়ালজুড়ে। আনন্দচিত্তে মা-বাবা ছেলের সেসব অর্জন ছুঁয়ে স্মৃতি হাতরাচ্ছেন। তবে সঙ্গে রয়েছে দুশ্চিন্তাও। কারণ ছেলে এভারেস্টের চূড়ায় পা রাখলেও এখনো যে নিরাপদে নেমে আসেনি।
ষষ্ঠ বাংলাদেশি হিসেবে রোববার পৃথিবীর উচ্চতম শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টে লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়েছেন চট্টগ্রামের বাবর আলী। সেই আনন্দে ভাসছে তার পরিবার, স্বজন-বন্ধুবান্ধবরা।
জানা গেছে, গত ১৪ মে এভারেস্টের বেস ক্যাম্প থেকে যাত্রা শুরু করেন বাবর। প্রথম দিনেই সরাসরি পৌঁছান ২১ হাজার তিনশ ফুট উঁচুর ক্যাম্প টুতে। এর পরের কয়েকদিনে ক্যাম্প থ্রি ও ক্যাম্প ফোরে পৌঁছে যান তিনি। ২৬ হাজার ফুট উচ্চতার ক্যাম্প ফোরের ওপরের অংশকে বলা হয় ডেথ জোন বা মৃত্যুপুরী। ১৮ মে মাঝরাতে আবারও শুরু হয় বাবরের যাত্রা। যে স্বপ্ন ১৫ বছর আগে দেখেছিলেন তিনি। অবশেষে স্বপ্ন ছুঁয়েছেন তিনি; নাম লিখিয়েছেন অনন্য উচ্চতায়। তবে এখন এভারেস্টচূড়া থেকে নিরাপদে ছেলের ফেরাই ভাবাচ্ছে মা-বাবাকে।
বাবরের মা লুৎফুল নাহার বেগম লেন, ‘দুই মাস ধরে ঘুমাতে পারছি না। ছেলে এমন একটা চ্যালেঞ্জ নিল, যেখানে মৃত্যুঝুঁকি আছে। দিনে মাত্র দু-তিন ঘণ্টা করে ঘুমিয়েছি। ছেলের জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছে। নিরাপদে নেমে এলে এ দুশ্চিন্তা কমবে।’
দুশ্চিন্তা থাকলেও বাবরের মা-বাবা দারুণ আনন্দিত। ছেলের এমন প্রাপ্তিতে তাদের চোখে আনন্দের অশ্রু। তারা বলেন, ‘বাবর দীর্ঘদিন ধরে এভারেস্ট ও আরেক পর্বতশৃঙ্গ লোৎসে আরোহণের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে। দুশ্চিন্তা করব, এ ভয়ে আমাদের বিস্তারিত জানাত না সে। প্রস্তুতি শেষ করে যখন জানিয়েছে, তখন থেকেই ভয়টা বাড়তে থাকে। কারণ, চূড়ায় উঠতে গিয়ে একটু এদিক-সেদিক হলেই মৃত্যু। তবে শেষ পর্যন্ত চূড়া ছুঁতে পারায় আমরা গর্বিত।’ বাবররা চার ভাইবোন। তারা সবাই অত্যন্ত খুশি।
লুৎফুল নাহার বলেন, ‘এটি অত্যন্ত ভয়ংকর স্বপ্ন ও যাত্রা। আমার প্রত্যাশা ছিল, ডাক্তার হয়ে চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত থেকে ভালোভাবে বাকি জীবন কাটিয়ে দেবে। সে চিকিৎসা পেশায় থাকুক, এটাই আমার চাওয়া।’
১৫ মে মা-বাবার সঙ্গে শেষবার কথা হয়েছিল বাবরের। ক্যাম্প থেকে ফোন করেছিলেন। দেখিয়েছিলেন পর্বতমালার অনিঃশেষ সৌন্দর্য। স্মৃতিচারণ করে মা লুৎফুল নাহার বলেন, ‘ক্যাম্প থেকে ফোন করার পর বাবরের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কথা হয়। সে হিমালয়ের দৃশ্য দেখিয়েছিল। তাকে তখনো সাবধান করেছি।’
বাবা লিয়াকত আলী বলেন, ‘রোববার সকাল থেকেই খুব ব্যস্ত। সবাই ফোন করছে, আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীরা আসছে। খোঁজখবর নিচ্ছে বাবরের। তার বন্ধুরাও আসছে। তাদের সবাইকে আপ্যায়ন করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে ভালো লাগছে।’
তিনি বলেন, বাবর ছোটবেলা থেকেই চঞ্চল। স্কুল জীবনে প্রতিটি খেলাধুলায় অংশ নিয়ে পুরস্কার জিতেছে। লেখাপড়ায় ভালো ছিল। এ কারণে স্বপ্ন ছিল ডাক্তারি পড়াব। এমবিবিএস পড়ে সে স্বপ্ন পূরণও করেছে। তবে তার স্বপ্ন ছিল সাংবাদিক হবে। কিন্তু তা হয়ে ওঠেনি। পড়াশোনার পাশাপাশি ৬৪ জেলায় ঘুরে বেড়িয়েছে। ২০১৯ সালে পরিবেশ রক্ষার ব্রত নিয়ে ৬৪ জেলা হেঁটে পার করেছিল। কাশ্মীরে সাইকেলযাত্রায় অংশ নিয়েছিল। লিখেছে ভ্রমণ কাহিনি নিয়ে বইও।
বাড়ির দেয়ালে নানা পদক: তিন ভাই এবং এক বোনের মধ্যে বাবর দ্বিতীয়। থাকেন মা-বাবার সঙ্গেই। ঘুরেছেন দেশ-বিদেশ। পেয়েছেন অসংখ্য পদক ও পুরস্কার। আন্তর্জাতিক পদক রয়েছে তার। সেগুলো সাজানো আছে পুরো বাড়িতে। উল্লেখযোগ্য পদকের মধ্যে কলকাতা পুলিশ সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফ হাফ ম্যারাথন, কাপ্তাই হাফ ম্যারাথন, সাইক্লিং ম্যারাথন জয়ের পদক। এসব দেখে কারও মনে হবে না, এভারেস্টজয়ী বাবর পেশায় চিকিৎসক।
গত বছরের ১৩ এপ্রিল কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর থেকে সাইকেলযাত্রা শুরু করেছিলেন বাবর আলী। এক মাসের চেষ্টায় প্রায় চার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে তামিলনাড়ুর কন্যাকুমারীতে গিয়ে থেমেছিলেন তিনি। পথে যেতে যেতে ১৩টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মনোরম দৃশ্য অবলোকন করার সুযোগ হয়েছিল তার। এসব পথে ঘুরতে গিয়ে নানা বৈচিত্র্যময় শোপিসও সংগ্রহ করেছেন তিনি। ২০১৯ সালে পরিবেশ রক্ষার ব্রত নিয়ে বাংলাদেশের ৬৪ জেলা হেঁটে পার করেন বাবর।
বাবর ঘুরে বেড়াচ্ছেন দেশ-বিদেশ। এ বিষয়ে মা লুৎফুল নাহার বেগম বলেন, বাবর ছোটবেলা থেকেই ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করত। এভারেস্টে যাওয়ার আগেও মা-বাবার সঙ্গে এটা নিয়ে কথা হয়েছে তার। বাবর বলেছিল, এ রকম দুঃসাহসিক ভ্রমণ সে করতে চায়। এজন্য পুরোপুরি প্রস্তুত সে।
ট্র্যাকিং জগতে বাবর আলীর হাতেখড়ি ২০১০ সালে। ওই বছর পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন দুর্গম পাহাড় চষে বেড়ায় সে। ২০২২ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে হিমালয়ের অন্যতম দুর্গম চূড়া আমা দাবলাম (২২ হাজার ৩৪৯ ফুট) আরোহণ করে বাবর।
বাবরের গর্বিত বাবা লিয়াকত আলী বলেন, এভারেস্টে ওঠার পর তার নাম ইতিহাসে লেখা হয়ে গেল। তাকে সবাই চেনে এখন। আগে বাদশা মিয়া সিপাহির বাড়ি বললে চিনত সবাই। এখন বাবর আলীর বাড়ি বললেও সবাই চেনে।
বাবরের জন্ম ও বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাসের পর কাজ করেছেন জনস্বাস্থ্যবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইসিডিডিআর,বিতে। তার প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা’। বইটির পরিচিতিতে লেখা—পেশায় ডাক্তার, নেশায় পাহাড়।