রাজু আহমেদ
প্রকাশ : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৩:১১ এএম
আপডেট : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৬:৩৭ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ভালোবাসার ঋতু, প্রেমের কাব্য

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

‘উদাস হাওয়ায় ফাগুন এল, মন গেয়ে ওঠে গান/ শিমুল-পলাশ রঙে রাঙায়, আগুন জ্বালে প্রাণ/ হৃদয় জুড়ে প্রেমের কাব্য, নতুন দিনের ডাক/ মনের কোণে সুরের ধারা/ বেজে যায় বসন্তের ঢাক।

শীতের জড়তা পেরিয়ে এলো ফাগুন। প্রকৃতি যেন ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছে। গ্রাম থেকে শহর, সবখানে ফাগুনের পরশ যেন এক নতুন প্রাণের সঞ্চার। গাছের ডালে ডালে জন্মেছে নতুন কুঁড়ি, কোকিলের সুর, ফুলের মিষ্টি গন্ধ সুবাসিত বাতাস। সবকিছু মিলে চারপাশে যেন এক মোহনীয় রূপ।

বসন্ত মানেই ভালোবাসার ঋতু। অনাবিল আনন্দ বয়ে নিয়ে আসে ফাগুনের আগমন। ভরে ওঠে মন। প্রকৃতির রং যেন প্রেমিক-প্রেমিকার মনের কথাগুলো রংতুলিতে আঁকে। শিমুল, পলাশ আর কৃষ্ণচূড়ার লাল আভায় ভরে ওঠে প্রতিটি গাছ। এ যেন প্রকৃতির ক্যানভাস, যেখানে প্রতিটি রং প্রকাশ করে ভালোবাসার গভীরতা।

প্রেম কি শুধুই মানুষে মানুষে? ফাগুন বলে ‘না’। প্রকৃতি আর মানুষের মধ্যেও রয়েছে গভীর প্রেম। শীতের নির্জীবতা যখন প্রকৃতিকে নিস্তব্ধ করে দেয়, বসন্ত তখন প্রকৃতির প্রতি নতুন প্রেম জাগায়। গাছে গাছে নতুন কুঁড়ি ফোটে, এ দৃশ্য যেন প্রেমের প্রথম চিঠি পাওয়ার আনন্দমাখা। পাখিরা গাইতে শুরু করে ভালোবাসার গান।

বাসন্তী শাড়িতে সেজে ওঠে তরুণীর দল/ প্রেমের আহ্বানে/ পলাশের আগুনে রঙিন হয় চুলের গাঁথা মালায়।

তরুণ বলে, ‘আসো হাতে হাত রাখি, এই ফাগুনে মুগ্ধ হই’ কোকিল সুরে সুর মিলিয়ে, প্রেমের পথে হাওয়ায় ভেসে যাই।

বসন্তের প্রথম দিনটি যেন এক প্রেমময় কবিতা। সবাই সেজেগুজে বেরিয়ে পড়ে। তরুণ-তরুণীর দল বাসন্তী শাড়ি আর পাঞ্জাবিতে রঙিন হয়ে যায়। শহরের পথজুড়ে মানুষের ভিড়, চুলে বেলি ফুলের মালা, হাতে ফুলের তোড়া।

পহেলা ফাল্গুন আমাদের ঐতিহ্যের অন্যতম অংশ। বহু বছর আগে থেকেই এ দিনটি বাঙালির জীবনে বিশেষ হয়ে উঠেছে। ১৯৬০-এর দশকে পূর্ব পাকিস্তানে যখন রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করা হয়, তখন বাঙালিরা নিজেদের আলাদা পরিচয় তুলে ধরার জন্য বসন্তবরণ উৎসবকে আরও গুরুত্ব দেয়। ধীরে ধীরে এটি বাঙালির অন্যতম বড় উৎসবে পরিণত হয়।

গ্রামে এ দিনটি যেন আরও অন্যরকম। বসন্ত মানেই পিঠাপুলি, সার্কাস, মেলা সব মিলিয়ে এ এক অন্যরকম রঙিন দিন। বাড়ির উঠোনে পিঠার ঘ্রাণ, মাঠে খেলাধুলা আর সন্ধ্যায় জাদু বা সার্কাস দেখার জন্য ভিড়—এসব মিলিয়ে বসন্ত এক সম্পূর্ণ জীবনধারা হয়ে ওঠে। যদিও শহুরে পরিবেশে বসন্তের রূপ ভিন্ন, তবে তার আবেদন এখনও সমান।

শুধু বাংলাদেশ নয়, বসন্তের কাব্য ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে। জাপানে এ সময়ে চেরি ব্লসম উৎসব পালিত হয়। ভারতবর্ষে হোলির রঙে মাতে মানুষ। কিন্তু ফাগুনের মতো এত আবেগপূর্ণ ঋতু আর কোথাও নেই।

প্রকৃতির প্রতিটি অংশ যেন এ ঋতুর গল্প বলে। লতাপাতার নতুন সবুজ, ফুলের লালচে আভা আর আকাশের নীল—সব মিলিয়ে ফাগুনের রূপ এক অনন্য চিত্রকল্প সৃষ্টি করে।

‘ফাগুন তুমি রঙিন চাদর, জড়িয়ে রাখো হৃদয়ের কোণে। তোমার ছোঁয়ায়, ফুল ফোটে, প্রেম জমে যায় স্মৃতির বনে।’

বাংলা সংস্কৃতিতে ফাল্গুনের সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক গভীর। আগে থেকেই পহেলা ফাল্গুন ভালোবাসার দিন হিসেবে পালিত হয়ে আসছিল।

পরে পশ্চিমা ভালোবাসা দিবসের (ভ্যালেন্টাইন’স ডে) প্রভাবে ১৪ ফেব্রুয়ারি এ উদযাপনটি আরও রোমাঞ্চকর হয়ে ওঠে। তবে আমাদের ফাগুনের ভালোবাসা অনেক গভীর, অনেক ঐতিহ্যবাহী।

ফাগুনের আগুন শুধু প্রকৃতিতে নয়, মানুষের মনে আগুন জ্বালায়। প্রেমিক-প্রেমিকার মনের মধ্যে যেমন রোমাঞ্চ জাগে, তেমনি প্রকৃতিও প্রেমের ভাষায় কথা বলে। ফাগুনে ভালোবাসা পায় এক নতুন অর্থ। এই ঋতু যেন বলে—ভালোবাসো, প্রকৃতিকে, মানুষকে, জীবনকে।

ফাগুনের সময় একেকটি মুকুল যেন একেকটি গল্প বলে যায়। পলাশের লাল রং বলে আগুনের কথা, যা আমাদের হৃদয়কে জাগিয়ে তোলে। শিমুলের কোমলতা বলে সম্পর্কের গভীরতা আর কোমলতার গল্প।

গ্রামের পথে বসন্ত আসে পায়ে হেঁটে। কাঁচা রাস্তাগুলোর বয়ে যায় শিমুল-পলাশের সারি করা মিছিল। শহরের ব্যস্ত রাস্তায় বসন্ত আসে কিশোরীদের খোঁপায় গুঁজে রাখা বেলি ফুলের সুবাসে। প্রেমিক-প্রেমিকা বসন্তের দিনটিকে আরও স্মরণীয় করতে চলে যায় নদীর ধারে বা কোনো পার্কে।

‘একটি নদী বইছে পাশে, প্রেমের ঢেউয়ে ভাসছে মন। ফাগুন বলে, থেমে থেকো না, জীবন হলো চিরতরুণ।’

ফাগুনের দিনগুলো যেন প্রকৃতির গানে গাঁথা কবিতা। প্রতিটি মুহূর্তে ফাগুন তার প্রেমময়তার কথা বলে। মৃদু বাতাস যখন পলাশ ফুলের গন্ধ নিয়ে আসে, তখন মনে হয় এ গন্ধে লুকিয়ে আছে কোনো অমর কবির প্রেমপত্র। প্রকৃতি যেন সুরের বন্যায় আঁকে মনের ক্যানভাস।

শহরের ব্যস্ত মানুষরাও ফাগুনে থেমে যায়। একটু সময় বের করে তারা প্রকৃতির কাছে ফিরে আসে। শিশুদের কোলাহল, তরুণ-তরুণীর হাসি আর বয়স্কদের স্মৃতিচারণা—সবকিছু মিলে ফাগুন হয়ে ওঠে এক মিলনমেলা।

ফাগুনের কথা বলতে গেলে বাঙালির ইতিহাসের কথাও মনে পড়ে। একুশে ফেব্রুয়ারি—আমাদের ভাষা আন্দোলনের দিন—। বসন্তের আবেগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে এ স্মৃতি। বসন্তের আগুনে যেমন নতুন কুঁড়ি ফোটে, তেমনি ভাষার প্রতি আমাদের ভালোবাসাও এক নতুন রূপ পায়। এই ঋতু যেন আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতীক।

ফাগুন আমাদের জীবনে শুধু একটি ঋতু নয়, এটি একটি অনুভূতি, একটি ভাষা, একটি জীবনধারা। এটি আমাদের মনে আনন্দ আনে, সম্পর্কের বাঁধনকে শক্তিশালী করে আর প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে গভীরতর করে।

ফাগুন এলেই মনে হয়, জীবন নতুন করে শুরু হয়েছে। এই ঋতু আমাদের শেখায়—প্রেম ছাড়া জীবন অসম্পূর্ণ। প্রকৃতির রঙে, মানুষের মনের গভীরতায় আর সংস্কৃতির ঐতিহ্যে ফাগুন চিরকাল আমাদের হৃদয়ে থেকে যাবে।

ফাগুন তোমার আগুনজ্বলা প্রেম, হৃদয় করে উন্মাদ। তোমার ছোঁয়ায় জীবন রাঙে, ভালোবাসা হয় অবিরাম সাধ।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

যে গ্রামে বসবাস করলেই মিলবে ২৭ লাখ টাকা!

পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তে তুমুল সংঘর্ষ

‘শাপলা চত্বর হত্যাকাণ্ডের শহীদ পরিবারকে সহযোগিতা করবে সরকার’

অসুস্থ বিএনপি নেতা ডা. রফিকের খোঁজ নিতে বাসায় জোনায়েদ সাকি

আফগানদের কাছে নাস্তানাবুদ হয়ে বাংলাদেশের সিরিজ হার

যুক্তরাষ্ট্রে ফুটবল ম্যাচ শেষে এলোপাতাড়ি গুলি, নিহত ৪

চট্টগ্রামে কনসার্টে গোলাগুলি, গুলিবিদ্ধ ১

চিহ্নিত ব্যক্তির দায় প্রতিষ্ঠানের ওপর দেওয়া উচিত নয় : বিএনপি

জবি তরুণ কলাম লেখক ফোরামের নেতৃত্বে ইমন-সোহান

এনসিপির ‘পলিসি ও রিসার্চ উইং’ গঠন, দায়িত্ব পেলেন যারা

১০

নড়াইলে সাংবাদিকদের মিলনমেলা

১১

‘তিন মাসের মধ্যে ৬ লেনের কাজ দৃশ্যমান হবে’

১২

শাবিপ্রবির ২৫ শিক্ষার্থীর বহিষ্কারাদেশ বাতিলের সিদ্ধান্ত

১৩

ওমরজাইয়ের বোলিং তোপে বিপদে বাংলাদেশ

১৪

প্রবীণদের পাশে আমাদের দাঁড়াতে হবে : টুকু

১৫

শুধু বক্তব্যে নয়, বাস্তব কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে বিএনপি মানুষের পাশে রয়েছে : আনোয়ারুজ্জামান

১৬

গুম-খুনে জড়িতদের সঙ্গে আপস নেই : আখতার হোসেন

১৭

বিএনপির নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান দুলুর

১৮

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে কাজ চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার

১৯

গুম-দুর্নীতি বন্ধে ধানের শীষে ভোট দিন : আশিক

২০
X