চায়ের সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক গানের মতো করে বলতে চাইলে, ‘চিরদিনই তুমি যে আমার, যুগে যুগে আমি তোমারি’! চা নিয়ে চার-পাঁচ পাতা লিখে ফেলা আসলে দুষ্কর কিছু নয়। তবে চা নিয়ে একেকজনের চাহিদা থেকে চিন্তাভাবনা—অনেক রকমের হতে পারে। যেটা একজনের জন্য প্রয়োজনীয় বা পরম আকাঙ্ক্ষার, সেটিই হয়তো ঠিক আরেকজনের ‘কাপ অব টি’ হয়ে উঠতে পারে না। তবে যেমনই হোক, তাতে আমাদের জীবন-মৃত্যুর পুরো চক্রেই চায়ের যে প্রবল আধিপত্য, তাকে এড়ানোর উপায় নেই। আন্তর্জাতিক চা দিবস উপলক্ষে বাঙালির পরম প্রিয় এই পানীয় নিয়ে লিখেছেন সামি আল মেহেদী
বিকেলের শেষদিক। মাঝবয়েস পেরোতে থাকা মোটা ফ্রেমের চশমা পরা ভদ্রলোক চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই তৃপ্তি নিয়ে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলে উঠলেন, ‘আসল চায়ের মজাই আলাদা।’ বারান্দায় ফুলের টবে মনোযোগী কন্যা বলে উঠলেন, ‘তুমি সবসময় এ কথা বলো কেন বাবা? আসল চা?’ ভদ্রলোক তখন নিজ-বয়ানের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠার পথে এগোলেন—‘তাহলে তো তোকে দেখাতেই হয়, কেন বলি আসল চা!’ তারপরই আমরা দেখলাম, আবুল হায়াত কন্যাকে নিয়ে গেলেন সিলেটের চা বাগানে, কন্যার সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশবাসীকে বুঝিয়ে ছাড়লেন ওই ‘ব্র্যান্ড’-এর চায়ের শ্রেষ্ঠত্ব।
নব্বই দশকের জনপ্রিয় বিজ্ঞাপনগুলো যদি সামান্য কারও মনে থাকে, তাহলে এ লেখার শুরুতেই তার ধরতে পারার কথা। এ বিজ্ঞাপনের মূলনায়ক আবুল হায়াত বাংলাদেশে বিজ্ঞাপনে পণ্যের ওপর নির্ভরযোগ্যতা বা সোজা ভাষায় ক্রেডিবিলিটি সেঁটে দেওয়ায় মহা ক্ষমতাধর। তিনি যেটাই ধরবেন, সেটাই হয়ে ওঠে বিশ্বাসযোগ্য। এই বিজ্ঞাপন আজ স্মৃতির পাতায়, তবে ফিনলে চায়ের পে-অফ লাইন আজও কিন্তু আবুল হায়াতের আওড়ে দেওয়া বাক্য, ‘ফিনলে চা, আসল চা’। আদতে আসল-নকল যেমনই হোক, ফিনলে চায়ের মূল কারিগর খুঁজতে গেলে আপনার যেতে হবে সেই ব্রিটিশ কলোনিয়াল যুগে, তাদের হাত ধরেনই এ মুল্লুকে চায়ের আগমন। ফিনলের মূল কোম্পানি প্রায় দুই যুগ আগে ব্যবসা বেচাবিক্রি করে চলে গেলেও তাদের বাগান এখনো উৎপাদনে সেরা অবস্থানে আছে। সময়ের পথচলায় চা আমাদের কাছে ভাইরাল কোনো ভিডিও বা রিলসের চেয়েও অনেক বেশি প্রাত্যহিক, আপন আর বাস্তবিক হয়ে গেছে। চায়ের সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক গানের মতো করে বলতে চাইলে, ‘চিরদিনই তুমি যে আমার, যুগে যুগে আমি তোমারি’!
চা নিয়ে চার-পাঁচ পাতা লিখে ফেলা আসলে দুষ্কর কিছু নয়। চায়ের ইতিহাস নিয়ে গণ্ডা গণ্ডা বই আছে বললে অত্যুক্তি হবে না। একসময় মানুষ বই দেখে টুকলি করত, তারপর ইন্টারনেট সহজবোধ্য হওয়ার পথে গুগল থেকে ‘কপি-পেস্ট’আর হাল জমানায় তো চ্যাটজিপিটিকে একটু বুঝিয়ে-শুনিয়ে বলে দিলেই পাতার পর পাতা লেখা নিমেষেই চলে আসে। হয়তো একটা সময় আসবে, যখন চ্যাটজিপিটিকে ‘ওই মামা, চিনি বেশি দিয়া কাঁচাপাত্তি দিয়া একটা স্পেশাল কড়া লিকার চা দেন তো’—লিখে প্রম্পট দিলেও সে কিছু না কিছু একটা করে দিতে পারবে! তবে এখনই চ্যাটজিপিটি চা বানিয়ে খাওয়াতে পারবে না। আর চা ছাড়া আমাদেরও চলবে না। যে এলাকায় একটা চায়ের দোকান থাকে না, সেখানকার বাসিন্দাদের মতো দুর্ভাগ্য আর কারও হতে পারে না। বাসাবাড়ি, অফিস-আদালত, বন্ধুদের আড্ডা, বাসস্ট্যান্ড কিংবা মহল্লার মোড়ে—চায়ের একটা ব্যবস্থা থাকতেই হবে। তা কীভাবে এদিকটায় চা এলো, টিকে গেল আর আমাদের এতটা আপন অনুষঙ্গ হয়ে উঠল, তা একটু সীমিত পরিসরে মনে করার চেষ্টা করা যেতে পারে।
আবিষ্কারের দিক থেকে চা খাঁটি চায়না-প্রোডাক্ট, একেবারেই দামে কম মানে ভালো একটা জিনিস বলা যায়। এ নিয়ে গল্প বা কিংবদন্তি কিন্তু একাধিক। চীনা গল্প জানায়, হাজার হাজার বছর আগে এক চীনা সম্রাট একটু উষ্ণ পানি পান করতে নিচ্ছিলেন, এমন সময় কিছু পাতা উড়ে এসে সেই পাত্রে পড়লে পানির রং বদলে যায় আর সেই পানি পান করে রাজামশাই ব্যাপক তৃপ্তি ও এনার্জি লাভ করেন। এ গল্পের কয়েক ধরনের ‘ভার্সন’আছে চীনা কিংবদন্তিতেই। এরপর রয়েছে জাপানি গল্প। বোধিধর্ম তপস্যার সময় ভুলবশত ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। পরে ঘুম ভেঙে উঠে তিনি এতটাই চটে যান, নিজের চোখের পাতা কেটে ফেলেন আর সেই চোখের পাতা থেকে গজায় গাছ। সেই গাছের পাতার থেকেই চা, যা মানুষের ঘুম কাটিয়ে দেয়। এ গল্পেরও কয়েক রূপ আছে। তবে যত ধরনের গল্পই হোক, চায়ের চলাচল শুরু যে চীনা মুল্লুকেই, সেটা ইতিহাসের কাগজে কলমে সত্যি। আর স্বাদে কিংবা গল্পে যত রকমের চা-ই হোক না কেন, চায়ের মূল যে পাতা, সেই উদ্ভিদে কোনো ভ্যারিয়েশন কিন্তু নেই; সেটি একক এবং অদ্বিতীয়ভাবে -ক্যামেলিয়া সাইনেনসিস! দেশ-বিদেশে বিভিন্ন সময়ে সেটি আলাদাভাবে নাম অর্জন করে নিয়েছে, সেই অনুসারে বিশ্ববাজারে এক অবিচ্ছেদ্য পণ্য হয়ে উঠেছে। ড্রইংরুম থেকে টক শো এর টেবিল কিংবা রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা, সবখানেই চায়ের কাপের উপস্থিতি অটুট।
‘চায়নিজ প্রোডাক্ট’বলে কথা! যে বাজারে ঢোকে, পুরো সয়লাব করে দিতে তার তো সময় লাগে না। এখনকার বিবিধ চীনা পণ্যের মতোই, আদ্যিকালেও চায়ের দাপট ছিল তুমুল। সেই সময়টায় একেক দেশ আবিষ্কার করছে একেক পণ্য, বণিক সওদাগরদের সুবাদে তার পরিচয় পেয়ে আবার আরেক অঞ্চল সেই প্রোডাক্টে পুরো আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে বলা চলে। চায়ের সাথে অন্য দেশগুলোরও অনেকটা সেভাবে একটু একটু করে পরিচয়। ১৬৫০ সালে চীন বাণিজ্যিকভাবে চা উৎপাদন করে আর তার বড় ভোক্তা হয় ব্রিটিশরা। কিন্তু লেনাদেনার কায়দা তখন খুব গোলমেলে, সেখানে তারপর বিনিময় হলো আফিম। এরপর চীন আফিমের নেশায় নড়বড়ে হতে হতে চট করে নড়েচড়ে বসে সিদ্ধান্ত নিল, নো মোর আফিম! ব্রিটিশরা পড়ে গেল মহা ফাঁপরে, তাতে আফিমযুদ্ধ লেগে গেল। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝির সময় বলা যায় তখন। চায়ের পাতার তেজ আর তুমুল চাহিদা ব্রিটিশরা ভালোভাবেই জানত। চীনা-চা আমদানির বিকল্প খুঁজতে তারা মরিয়া ছিল তো বটেই, যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতেও পিছপা হয়নি। এ মনোভাব থেকেই শ্রীমঙ্গল কিংবা জলপাইগুড়ি, শ্রমিকের সরলতা কিংবা বঞ্চনা, অত্যাচার অথবা ছলনা আর অজস্র ইতিহাসকে সাক্ষী মেনে আমাদের অঞ্চলের চা বাগানের একরের পর একর জমি বেড়েছে। চা বাগানের ইতিহাস আর শ্রমিকদের শত শত বছরের বঞ্চনা আর নির্যাতনের ইতিহাস এক সমান্তরাল গল্প। সেখানে ‘মুল্লুক চলো’র মতো রক্তাক্ত ইতিহাসও রয়েছে। সাহেবদের টপ গ্রেডেড চায়ের জোগান দিয়ে মালিকরা ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন সেই আমল থেকেই, কারণ তাদের যে চাওয়া, সেই আসল চায়ের কদরই আলাদা। অথচ সেই আসল চা পাতা যাদের যত্নে পরিশ্রমে তৈরি হয়, তাদের অবস্থা সেই আদিযুগ থেকে এখনো করুণই রয়ে গেল। হীরক রাজার দেশের সেই গানটির মতো—সোনার ফসল ফলায় যে, তার, দুই বেলা জোটে না আহার (কার্যত ‘সোনার ফসল’বলাই যায়, কারণ একটা সময়ে চায়ের দেনদরবার বিনিময় স্বর্ণের মাধ্যমেও ঘটত)! আজ বিশ্বে চায়ের উৎপাদনে আমাদের দেশের স্থান সেরা দশের মধ্যে, বিজ্ঞাপনে আর বিপণনে বাজারের দাপুটে পণ্য, বড় বড় সব কোম্পানি আর গ্রুপের সাম্রাজ্য দিনকে দিন আরও বড় হচ্ছে, চা বাগানের শ্রমিকদের গল্প কতটা বদলাল? সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ সিনেমায় নায়কের বন্ধু তথা সহকারী শুরুতেই বলে দিয়েছিলেন, চোদ্দ টাকা পাউন্ডের চা না হলে ব্রেকফাস্টটা ঠিক হয় না। অর্থাৎ অভিজাতের জন্য চায়ের রকমফেরটাও উচ্চমার্গের হওয়া চাই। তবে সেটার উৎপাদন কে বা কারা করছেন, তাতে মাথা ঘামানোর কিছু কোনোকালেই ছিল না, এখনো নেই। খুবজোর চা বাগান, একরের পর একর বিশাল সবুজ বনানী, বাংলোবাড়ি আর আরও কিছু বলা না বলা বিষয়াশয় আমাদের মধ্যে এক ধরনের রোম্যান্টিসিজমের জায়গা করে নিয়ে রেখেছে।
পর্তুগিজদের থেকে শুরু করে দুনিয়ার তাবৎ বণিকরা এ অঞ্চলের মানুষকে নতুন নতুন পণ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। সেইসঙ্গে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করেছেন, ধনসম্পত্তিতে প্রাচুর্য করেছেন। পর্তুগিজরা এনেছিলেন তামাক আর মরিচ। স্বয়ং সম্রাট আকবরও তামাকের ভক্ত হয়েছিলেন। তার পুত্র জাহাঙ্গীরের ঝোঁক ছিল অবশ্য সুরা আর আফিমের দিকে, তিনি দরবারে তামাককে নিষিদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু যে জিনিস বাজারে জমজমাট, তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে কী-বা হয়? সেখানে চায়ের ব্যাপার তো একেবারেই আলাদা, সেই আদি আমলের বিজ্ঞাপনের ভাষায় ‘যাহাতে নাহি মাদকতা দোষ, কিন্তু পান করে চিত্ত পরিতোষ’! কাজেই চায়ের বিস্তার ঘটতে আমাদের অঞ্চলে সময় তো লাগেইনি, বরং দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। চা আমাদের জন্য পণ্যের চেয়েও অনেক বেশি জীবনের অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। চা শুধু পানীয় নয়, রীতিমতো ঘরে কিংবা বাইরে সরাসরি নিমন্ত্রণের অনুষঙ্গ—‘চায়ের দাওয়াত’! জায়গাভেদে চায়ের কাপে কে কীভাবে চুমুক দিচ্ছে, তাতে কতটুকু ‘সুড়ুৎ’ করে শব্দ হচ্ছে নাকি ‘সাইলেন্স’ থাকছে, সেখানেও অনেক ভদ্রতা আর উচ্চমার্গের পরীক্ষা নিয়ে নেন অনেকে। যে বাড়িতে চায়ের চল রয়েছে আর যে বাড়িতে নেই, তাদের প্রতিদিনের রুটিনেও কিন্তু পার্থক্য বেশ থাকে। সকাল থেকে সন্ধ্যা, আমাদের সবটা সময়ই চা জুড়ে থাকে কোনো না কোনোভাবে। সে কারণে এর বাজারি চাহিদাটাও সর্বত্র বিবিধ চেহারায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। গরম পানিতে চা পাতার হালকা ডুবে থাকা রঙে নয়, কিংবা দুধ-চিনির মিশ্রণেও নয়; চায়ের ভ্যারিয়েশন যে কত কত রকমে এখন চালু, তা হয়তো একটা বিশাল গবেষণার বিষয়। বিভিন্ন চায়ের দোকানের মূল্য তালিকায় আপনি শখানেক চায়ের প্রকরণ পেলেও আজকাল নিশ্চয়ই অবাক হন না! বেশি দিন আগের কথা নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুল আলোচিত টিএসসি এলাকায় নতুন চায়ের আইটেম এসেছিল—‘অপরাজিতা ফুলের চা’! আদতে সেই চা খেতে কেমন তা হয়তো অভিজ্ঞতা নেওয়া ব্যক্তিরাই বলতে পারবেন, তবে প্রায় বেগুনি রঙের সেই চায়ের ছবি ফেসবুকে বেশ কিছুদিন ‘ম্যান্ডেটরি আপলোড’ হিসেবে বেশ বাজার পেয়েছিল বলতে হবে!
তা যত রকম মরিচ চা, মধু চা, হরলিকস চা, মালটোভা চা, পনির চা কিংবা আমার মনে যা চায় তাই চা থাকুক—চায়ের বৈচিত্র্যর ক্ষেত্রে মুখ্য বিষয় হচ্ছে তার বংশপরিচয়, বেড়ে ওঠা এবং দেশের বাড়ি! মানে পাতাগুলো যেভাবে প্রক্রিয়াজাত করা হয় এবং যেসব অঞ্চলে এগুলো উৎপন্ন হয়, তা নির্ধারণ করে বিভিন্ন ধরনের চায়ের স্বাদ ও বৈশিষ্ট্য। আবার সেগুলো পানিতে ফোটানোর জন্যও রয়েছে আলাদা তাপমাত্রা আর সময়সীমা।
চা নিয়ে একেকজনের চাহিদা থেকে চিন্তাভাবনা, অনেক রকমের হতে পারে। যেটা একজনের জন্য প্রয়োজনীয় বা পরম আকাঙ্ক্ষার, সেটিই হয়তো ঠিক আরেকজনের ‘কাপ অভ টি’ হয়ে উঠতে পারে না। তবে যেমনটাই হোক, তাতে আমাদের জীবন-মৃত্যুর পুরো চক্রেই চায়ের যে প্রবল আধিপত্য, তাকে এড়ানোর উপায় নেই। নিজের পছন্দসই এক কাপ চা নিয়ে প্রিয়জনের সঙ্গে কিছুক্ষণ বসুন, অথবা একান্ত নিজের সঙ্গে নিজের কিছু সময় কাটান, দেখবেন দিনকাল খুব একটা খারাপ মনে হবে না।
জীবনের আসল স্বাদ পেতে পছন্দসই চায়ে পরিপূর্ণ করে নিন আপনার পেয়ালা!
মন্তব্য করুন