রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি এফটি-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। সেটি নিয়মিত প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে সোমবার দুপুর ১টা ৬ মিনিটে ঢাকার কুর্মিটোলার বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ঘাঁটি এ কে খন্দকার থেকে উড্ডয়নের পর যান্ত্রিক ত্রুটির সম্মুখীন হয়। ভয়াবহ এ ঘটনার পর এই যুদ্ধবিমানের সক্ষমতা, নির্মাতা সংস্থা, কত সালে উৎপাদন, দুর্ঘটনার ইতিহাস—এসব নিয়ে বিস্তর আলোচনা শুরু হয়েছে।
এফটি-৭ বিজিআই চীনের তৈরি একটি যুদ্ধবিমান। মূলত এফ-৭ সিরিজের একটি উন্নত সংস্করণ হলো এটি। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের তৈরি মিগ-২১ যুদ্ধবিমানের আদলে তৈরি করা হয় এ জঙ্গিবিমান, যা চীনে চেংদু জে-৭ নামেও পরিচিত। মূলত ১৯৬৪ সালের মার্চে চীনের সেন ইয়াং এয়ারক্রাফট ফ্যাক্টরিতে শুরু হয় তৃতীয় প্রজন্মের জে-৭ যুদ্ধবিমান তৈরির কাজ। এরপর থেকে জে-৭ সিরিজের বহু মডেল তৈরি হয়েছে এবং তা বহু দেশে রপ্তানি হয়েছে। ২০১১ সালে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের এমন ১৬টি যুদ্ধবিমান কেনার জন্য চুক্তি হয়। ২০১৩ সাল নাগাদ এই যুদ্ধবিমান হস্তান্তর সম্পন্ন হয়। এফটি-৭ বিজিআই (এখানে আই বলতে ইমপ্রুভড বা আরও উন্নত বোঝানো হয়) যুদ্ধবিমানটি মূলত বাংলাদেশের জন্যই আলাদাভাবে তৈরি করা হয়েছিল। এসব বিমানে অত্যাধুনিক ককপিট, মাল্টি-ফাংশনাল ডিসপ্লে, শক্তিশালী ফায়ার কন্ট্রোল রাডার এবং প্রশিক্ষণের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা সংযুক্ত রয়েছে। চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান চেংদু এয়ারক্রাফট করপোরেশন (সিএসি) এ যুদ্ধবিমানটি নির্মাণ করেছে, যা দেশটির অন্যতম প্রধান বিমান নির্মাতা সংস্থা। এ প্রতিষ্ঠানটি চীনের এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি করপোরেশন অব চায়নার (এভিক) অধীন কাজ করে। সিএসি মূলত সামরিক যুদ্ধবিমান উৎপাদনের জন্য বিশ্বব্যাপী পরিচিত। চীনের বহু মডেলের ফাইটার জেট (যুদ্ধবিমান) এবং উন্নত ট্রেইনার জেট তাদের হাতে তৈরি। চেংদু জে-২০সি চীনের প্রথম পঞ্চম প্রজন্মের স্টেলথ যুদ্ধবিমান তৈরি করেছে, যুক্তরাষ্ট্রের এফ-২২ ও এফ-৩৫-এর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর চাহিদা অনুযায়ী এটি বিশেষভাবে একটি ব্যয়সাশ্রয়ী মাল্টি-রোল যুদ্ধবিমান হিসেবে ডিজাইন করা হয়েছিল। চেংদুর তৈরি এফ সিরিজের বিমানগুলোর মধ্যে এটিকে সবচেয়ে উন্নত সংস্করণ বলে গণ্য করা হয়। তবে জানা গেছে, বাংলাদেশ বিমানবাহিনীকে এ যুদ্ধবিমান সরবরাহের পর ২০১৩ সালেই চীন এ সিরিজের উৎপাদন বন্ধ ঘোষণা করে। মূলত দ্রুত প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও উৎকর্ষতার তুলনায় বর্তমানে এটি বেশ পুরোনো প্রযুক্তিনির্ভর যুদ্ধবিমান।
অ্যারো কর্নারের তথ্য অনুযায়ী, এফটি-৭ যুদ্ধবিমান চীনের তৈরি এক ইঞ্জিনবিশিষ্ট হালকা ও গতিশীল ফাইটার জেট। এ যুদ্ধবিমানগুলো মূলত ইন্টারসেপ্টর হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এতে স্বল্পপাল্লার ইনফ্রারেড হোমিং এয়ার-টু-এয়ার মিসাইল সংযুক্ত থাকে এবং তা মূলত আকাশে স্বল্পপাল্লার যুদ্ধের জন্য ডিজাইন করা। এ বিমান আকাশ থেকে ভূমিতেও আক্রমণ চালাতে সক্ষম।
বিভিন্ন সূত্রের বরাতে জানা গেছে, বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর মোট ৩৬টি এফটি-৭ যুদ্ধবিমান রয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই এফটি-৭ বিজিআই ধরনের। তবে এফটি-৭ এমবি এবং এফটি-৭ মডেলেরও রয়েছে। মোট ফাইটার ভেরিয়েন্ট রয়েছে ৩৬টি।
বাংলাদেশে এফটি-৭ মডেলের যুদ্ধবিমানের দুর্ঘটনা এই প্রথম নয়। এর আগে ২০১৮ সালের নভেম্বরে টাঙ্গাইলের মধুপুরের রসুলপুর ফায়ারিং রেঞ্জে মহড়ার সময় বিমানবাহিনীর এফটি-৭ বিজিআই প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়। এতে উইং কমান্ডার আরিফ আহমেদ দিপু প্রাণ হারান। এরপর ২০২১ সালের নভেম্বরে চট্টগ্রামের জহুরুল হক ঘাঁটি থেকে উড্ডয়নের পর বঙ্গোপসাগরে বিধ্বস্ত হয় এফটি-৭ এমবি। এ সময় ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তাহমিদ প্রাণ হারান।
এভিয়েশন বিশ্লেষকরা বলছেন, এফটি-৭ বিজিআই মডেলের যুদ্ধবিমানটির দীর্ঘমেয়াদি কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমডোর ইশফাক ইলাহী চৌধুরী বেসরকারি একটি টেলিভিশনে বলেন, এর আগে বিমানবাহিনীর অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু বেসামরিক লোকজনের ক্ষতি এবারই প্রথম। তিনি বলেন, চীন ২০১৩ সালে এটার উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে। চীন ও পাকিস্তানে এটার অনেক প্লেন ফ্লাই করেছে। এখন বাংলাদেশ আর উত্তর কোরিয়া ছাড়া এটা আর কোথাও ব্যবহার হচ্ছে না।
তার ভাষ্য, বিমানবাহিনী থেকে বারবার রিকোয়ামেন্ট ছিল, অত্যাধুনিক না হোক, আধুনিক কয়েকটা ফাইটার স্কোয়াড্রন থাকা উচিত। যেগুলো সেইফলি ফ্লাই করবে।
মন্তব্য করুন