ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান। ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেছেন। কালবেলার সঙ্গে আলোচনায় জুলাই গণঅভ্যুত্থান ও পরবর্তী এক বছর নিয়ে কথা বলেছেন
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানকে আপনি কীভাবে দেখছেন? এটা কি আরেকটি রাজনৈতিক টানাপোড়েন, নাকি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি মৌলিক পালাবদল?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান নিছক একটি সরকার পতনের ঘটনা নয়, বরং আমাদের রাষ্ট্র কাঠামো ও গণতন্ত্রচর্চার দীর্ঘমেয়াদি প্রতিবন্ধকতাগুলোর বিরুদ্ধে এক গাঢ় ও ব্যতিক্রমধর্মী প্রতিবাদ। নব্বইয়ের আন্দোলন ছিল সামরিক শাসনের অবসান এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রত্যাবর্তনের জন্য। কিন্তু চব্বিশের অভ্যুত্থান একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ অন্তঃসারশূন্যতা, একনায়কতান্ত্রিক রাজনীতিকরণ এবং সাধারণ মানুষের নিরবচ্ছিন্ন বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়েছে। এটি এক অর্থে ছিল রাষ্ট্রের আত্মার পুনর্জাগরণ।
ফ্যাসিবাদের কিছু সুবিধাভোগী ও তাদের সমর্থক গোষ্ঠী শিক্ষার্থীদের ওপর তৎকালীন সরকারের প্রাণঘাতী হামলা ও দমন-নিপীড়নকে বাহবা দিচ্ছিল। অথচ দেশের নিরানব্বই শতাংশ মানুষ হাসিনার এ পদক্ষেপকে অগ্রহণযোগ্য হিসেবে দেখেছিল। এখানে কোনো দলের বিষয় নয়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যে স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা কায়েম করেছিল, তা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ঐতিহাসিক চাহিদার বিপরীত। মানুষ ন্যূনতম স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করতে চায়। মানুষ চায় এমন একটি পরিবেশ থাকুক, যেখানে মেধার ভিত্তিতে নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের সুযোগ থাকবে এবং চলাফেরা ও কথা বলার ন্যূনতম স্বাধীনতা থাকবে। মানুষ সুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে এগোতে চায়, সব সুযোগ-সুবিধা কেউ কুক্ষিগত করুক, মানুষ তা চায় না। মানুষ চায় সবকিছুতে ন্যূনতম কিছু নিয়মকানুন বলবৎ থাকুক। অথচ এসব কিছুর বিপরীতে এমন একটি শাসনব্যবস্থা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, যা সার্বিক অর্থে জনসমর্থন হারিয়ে ফেলে। মানুষ মনেপ্রাণে এ শাসনব্যবস্থাকে ছুড়ে ফেলে দিতে চাচ্ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো কোনো চূড়ান্ত উপলক্ষ তাদের সামনে হাজির করতে পারছিল না।
সে সময়কে শুধু শাসনব্যবস্থা বলা যাবে না বরং তাকে একটা অত্যাচারী ব্যবস্থা বলতে হবে। অসংখ্য গুম ও খুন ছিল সেই অত্যাচারী ব্যবস্থার একটি অংশ; আর আরেকটি অংশ হলো হাজার হাজার গায়েবি মামলা। আমি একটি লেখায় বলেছিলাম, আমরা দশ-বারো লাখ রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে চিন্তিত, অথচ গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে খুব নীরবে একটি অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক উদ্বাস্তু গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। আমরা সে বিষয়ের দিকে খুব বেশি নজর দিইনি। অসংখ্য মানুষ বিশেষ করে তরুণরা ঘরছাড়া ছিল। কেউ এক জেলা থেকে অন্য জেলায় গিয়ে রিকশা চালিয়ে বা চায়ের দোকান দিয়ে জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়েছে। কাউকে আবার দেশ ছেড়েই চলে যেতে হয়েছে। এগুলো ছিল খুবই বেদনাদায়ক। বাড়িতে থাকলে পুলিশের ভয়। দীর্ঘ সময় কোথাও স্বস্তিতে কাটাতে পারেনি অনেকে। অসংখ্য ভিত্তিহীন গায়েবি মামলায় তারা জর্জরিত ছিল। তরুণরা প্রতিরোধ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। বারবার তারা সুযোগও তৈরি করেছিল; কিন্তু চূড়ান্ত পর্বটি রাজনৈতিক নেতাদের নেতৃত্বের ব্যর্থতায় বিফল হয়। তবে সর্বশেষ চব্বিশের জুলাই মাসে একটি সফল গণঅভ্যুত্থান ঘটে।
এ অভ্যুত্থান এত দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলনে রূপ নিল কেন?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: কারণ রাষ্ট্র নাগরিকদের সঙ্গে তার চুক্তি ভেঙে ফেলেছিল। ভোটার থেকে নাগরিক হওয়ার যে যাত্রা, সেটি গত দুই দশকে বারবার বিপর্যস্ত হয়েছে। গণতন্ত্রের অন্তর্বস্তুর পরিবর্তে আমরা পেয়েছি একটি ‘কর্তৃত্ববাদ’। জনগণ অনুভব করেছে যে, নাগরিক হিসেবে তাদের কোনো অস্তিত্ব নেই। এ কারণেই আন্দোলনটা ছিল নিজেদের মালিকানা পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম।
চব্বিশের জুলাইয়ে আমরা দেখেছি মানুষ সব ভীতি ঝেড়ে ফেলে বন্দুকের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছে। একই সঙ্গে স্বৈরাচারও বারবার ভুল করতে শুরু করে। তাদের এ ভুলগুলোর কারণে একসময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ১৬ জুলাই, আবু সাঈদ স্বৈরাচারী তাঁবেদার বাহিনীর হাতে প্রাণ দেয়। সে যেভাবে বুক চিতিয়ে গুলির সামনে দাঁড়িয়েছিল, সেটি লাখ লাখ তরুণের মধ্যে সংক্রামিত হয়। আর এটা ছিল সাহসের সংক্রমণ। এর আগে চট্টগ্রামে ওয়াসিম নামেও একজনকে হত্যা করে সরকারি বাহিনী। আবু সাঈদের ঘটনাটি গণমাধ্যমের কল্যাণে বিশ্বব্যাপী দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় মানুষের মধ্যে তার ব্যাপক প্রভাব পড়ে।
এর আগে বারুদ প্রস্তুত ছিল। কিন্তু তাতে আগুনের স্ফুলিঙ্গের অভাব ছিল। আবু সাঈদের আত্মত্যাগ যখন মিডিয়ার কল্যাণে দুনিয়ার মানুষ দেখল, তখন সেটি আগুনের স্ফুলিঙ্গের মতোই কাজ করে। তরুণরা মৃত্যুভয়কে জয় করল এবং রাস্তায় নামল অপ্রতিরোধ্যভাবে। এ সময় আমরা দেখেছি একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলছেন—‘স্যার গুলি করি, একজন মরে, বাকিরা যায় না, দাঁড়িয়ে থাকে।’ পরবর্তীকালে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন দমনের জন্য আওয়ামী লীগ সরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ করে দেয়। তখন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা রাস্তায় নেমে আসে এবং প্রতিবাদ জানাতে থাকে। তখন আর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের সুযোগ আওয়ামী লীগ এবং হাসিনা সরকারের হাতে থাকে না। ছাত্রদের এ আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সম্পৃক্ত হয় শ্রমজীবী থেকে শুরু করে সমাজের সব শ্রেণি ও পেশার মানুষ। এলাকা ধরে ধরে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শুরু হয়।
আন্দোলন জোরদার হয় কখন?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: পরিস্থিতিটা ছিল অনেকটা সাগরের ঢেউয়ের মতো। ঢেউ যেমন বাড়ে-কমে, তেমনি এ আন্দোলনের তীব্রতা ঢেউয়ের মতো বাড়ছিল-কমছিল। শেখ হাসিনা আন্দোলন থামানোর জন্য কারফিউ জারি থেকে শুরু করে হত্যাসহ সব ধরনের প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। কিন্তু মানুষের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ভাঙতে পারার আর কোনো অস্ত্র হাসিনার হাতে ছিল না। জুলাই শেষ হয়ে আগস্ট শুরু হলেও মানুষ জুলাই মাস কাউন্ট করতে থাকল। এ সময় আন্দোলনের সংক্রমণটা সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়ে ঠেকল এবং রাষ্ট্রের মধ্যে বিভাজনগুলো দৃশ্যমান হতে থাকল। সর্বশেষ ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পালানোর মাধ্যমে একটি সফল গণঅভ্যুত্থান সম্পন্ন হলো।
আপনি কি মনে করেন জনগণের এ আন্দোলন পরবর্তী ব্যবস্থাকে ভালোভাবে রূপ দিতে পারবে?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। গণঅভ্যুত্থান এক ধরনের ধ্বংস ঘটাতে পারে কিন্তু কাঠামোগত পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন দর্শন, প্রজ্ঞা ও অন্তর্দৃষ্টি। জনগণ রাজনীতির মালিক হতে চায়, শুধুই ভোটার নয়। কাজেই নতুন ব্যবস্থা হতে হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক, অংশীদারত্বমূলক এবং নাগরিককেন্দ্রিক। নেতৃত্বের ক্ষেত্রে একটি প্রজন্মান্তর ঘটছে, যেখানে তরুণরাই হচ্ছে চালিকাশক্তি। আমি আশাবাদী, যদি আমরা জনগণের এ রাজনৈতিক চেতনা ও অভিজ্ঞতাকে কাঠামোবদ্ধ করতে পারি, তাহলে নতুন এক গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা সম্ভব। জনগণ আর ভয় পাচ্ছে না। তারা প্রশ্ন করছে, দাবি করছে, সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। একসময় এই জাতি শুধু স্বপ্ন দেখত, এখন তারা সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে এগিয়ে এসেছে। এই সাহস—এই আত্মমর্যাদা—এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় আশার উৎস। তবে হতাশার বিষয়ও রয়েছে। যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মানুষ ও তরুণরা এ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল, সেখানে নানা বিচ্যুতি দেখা যাচ্ছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও তাদের খবরদারি বন্ধ হয়নি।
গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। এই এক বছরে বাংলাদেশে কতটুকু পরিবর্তন দেখছেন? সরকার কি মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করতে পারছে?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: প্রথমত গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী এক বছরকে আমরা যেভাবেই মূল্যায়ন করি না কেন, গণঅভ্যুত্থানকে তার সঙ্গে মেলানোর সুযোগ নেই। গণঅভ্যুত্থানটি ছিল আরও অনেক বড় এবং আরও অনেক বেশি কিছু। গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পর অবশ্যই এখন ফিরে তাকানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। প্রথমত, আমাদের মনে রাখতে হবে, স্বৈরাচারী ব্যবস্থার প্রত্যাখ্যানটা ছিল সার্বজনীন। স্বৈরাচারীর পতনটাই আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন।
দ্বিতীয়ত, মানুষের আকাঙ্ক্ষা বহুমাত্রিক এবং অনেক উঁচু। বিশেষ করে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের একটি সুস্থ ও ন্যায়ভিত্তিক মানবাধিকারের নিশ্চয়তাদানকারী প্রতিযোগিতামূলক এবং মেধার সুষ্ঠু মূল্যায়নের ব্যবস্থা চায়। মানুষ রাষ্ট্রীয় সহায়তার চেয়ে বেশি চায় একটি ভালো পরিবেশ। এ দেশের মানুষ শুরু থেকেই নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই গড়তে অভ্যস্ত। তবে স্বাধীনতার পর থেকেই দীর্ঘ সময় মানুষ সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হয়েছে সুষ্ঠু পরিবেশের অভাবে। মানুষ নিজেরা এ পরিবেশটা তৈরি করতে পারছে না। গণঅভ্যুত্থানের পর সেই পরিবেশটা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা বেড়েছে। সরকারও চেষ্টা করছে। কিন্তু এটা এক-দুদিনের বিষয় নয়, এটা একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। তাই আবারও বলছি, আমরা যেটা অর্জন করেছি, তা স্মরণে রাখা প্রতিমুহূর্তে প্রয়োজন।
প্রথমত, আমাদের অর্জন থেকে আমরা সাহস পাব। দ্বিতীয়ত, আমরা দেশ গড়ার অনুপ্রেরণা পাব। তবে দেশ গড়ার এ প্রক্রিয়া অত্যন্ত দীর্ঘ একটি রাস্তা। আমাদের মনে রাখতে হবে, জুলাই শুধু একটি রাজনৈতিক অর্জন নয়, একই সঙ্গে এটি একটি দার্শনিক অর্জন। একে শুধু সংকীর্ণ একটি কারিগরি অর্জন হিসেবে দেখলে চলবে না যে, একটি ক্ষমতাসীন সরকারকে ফেলানো হয়েছে। এখানে অর্জনের চরিত্রটি বোঝা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে এরই মধ্যে আমাদের এ অর্জনে কিছু বিচ্যুতি ঘটেছে। যেখানে সবার আগে দরকার ছিল ঐক্যবদ্ধভাবে রাষ্ট্র নির্মাণের কাজে অগ্রসর হওয়া। কিন্তু দুঃখজনকভাবে পরিবর্তনের কৃতিত্বের দাবি নিয়ে অহেতুক লড়াই দেখছি আমরা। আমরা এর মধ্যেই আটকে যাচ্ছি, যা শেষ বিচারে অত্যন্ত ক্ষতিকর।
আমাদের মনে রাখতে হবে এ কৃতিত্বের দাবি নিয়েই আমাদের জাতিকে আগেও বিভাজিত করা হয়েছে। একাত্তরের কৃতিত্বের দাবি নিয়ে আওয়ামী লীগের স্বৈরাচারী শাসন দাঁড়িয়েছিল। জাতিকে বিভাজিত করার মাধ্যমে তারা তাদের স্বৈরাচারী কর্তৃত্ব চালিয়ে গেছে। আমাদের সুনির্দিষ্টভাবে ইতিহাস লেখা দরকার। আমাদের এ অর্জনের ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং চরিত্র সবই লিপিবদ্ধ করা দরকার। কিন্তু কৃতিত্বের দাবিদারি নিয়ে সংকীর্ণতার জায়গা তৈরি করা উচিত নয়। আমাদের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন ঐক্যকে সংহত করা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা ঐক্যবদ্ধ আছি কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে বিভাজন দেখা যাচ্ছে। এ জায়গা থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে বেরিয়ে এসে দেশের স্বার্থে একই রাস্তায় হাঁটা প্রয়োজন। অবশ্যই সেটি রাস্তাটি হতে হবে জনকল্যাণের এবং মানুষের আকাঙ্ক্ষার।
মন্তব্য করুন